ভারত থেকে সমাজ বিশ্লেষক-নন্দিতা মিশ্র এর লকডাউনে লকড: ০১ এ বিশ্লেষণ ধর্মী অসাধারণ লেখা “ব্যবসায়ী”

339
নন্দিতা মিশ্র এর লকডাউনে লকড: ০১ এ বিশ্লেষণ ধর্মী অসাধারণ লেখা “ ব্যবসায়ী ”

লকডাউনে লকড: ০১


ব্যবসায়ী
নন্দিতা মিশ্র

(১)
রক্তিমের জীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময় গরমকাল। গরমে পৃথিবীর মানুষ যখন হাঁসফাঁস করছে, দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে সকলের, বাইরের সূর্যের দিকে তাকানো যাচ্ছে না, রোদে ঝলসে যাচ্ছে পৃথিবী, সবাই যখন বলছে, ‘উফফফ, আর পারছি না!’ মুখে তখন প্রশান্তির হাসি রক্তিমের, এক বুক ভর্তি স্বপ্ন নিয়ে গরমকে তুচ্ছ করে গরমের সমুদ্রে সাঁতার কেটে আগামী একটা বছরের সুখ, স্বাচ্ছন্দ্য, ভালোলাগাকে অর্জন করে সে। অক্লান্ত পরিশ্রমে পরিবারকে দেয় এক অনাবিল জীবন।
শীতটা জাকিয়ে পড়েছিল এবার। তারই মাঝে তাজপুরের সি বিচে দুটো দিন কাটিয়ে ফিরল ব্যবসায়ী বন্ধুদের সাথে। এবছরের টার্গেট একটু বেশি নিয়ে ফেলেছে সে, ডিস্ট্রিবিউটরদের নিয়ে বছরের শুরুতেই তাই এমন ব্যবসায়িক মিটিংটা সেরে ফেলল।
জানুয়ারি তখন, শীতের প্রকোপে কাঁপছে মানুষ। আর রক্তিমের গুদামের সামনে লরির পর লরি এসে প্যাকেট নামিয়ে দিচ্ছে। রক্তিম প্যাকেট আনলোডিং এর সময় কোম্পানির ম্যানেজারকে জানায়, ‘এবারে রমজান মাস পুরো বৈশাখে, মানে তপ্ত গরম। একটু বেশি বোতল পাঠান। নইলে আমি সাপ্লাই দিতে পারব না! রোজা শেষে কোল্ড ড্রিঙ্কসের বোতলে চুমুক দেবেই মানুষ। আর সেটাই আমার লাভ!’
ম্যানেজার কৌশিক বাবু হেসে বলেন, ‘আরে! চিন্তা করছেন কেন? ঠিক পৌঁছে যাবে। এবারে কিন্তু অনেক বড় টার্গেট আপনার রক্তিম বাবু।’
‘আরে! আপনি শুধুই চিন্তা করছেন। আজ পর্যন্ত কোনো টার্গেট মিস হয়েছে? প্রতিবার আমি কিন্তু টার্গেট ক্রস করেছি। এবারেও অন্যথা হবে না!’
শীত টি-টোয়েন্টির আবহ পার করে, এবার টেস্ট ম্যাচের ব্যাট ধরেছে। ঠুক ঠুক করে খেলেই চলেছে। কিন্তু গরমের ইনিংস যে আরো বেশি বড় হবে এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই রক্তিমের। তাই স্টকের পরিমাণটা বাড়িয়ে চলল, বাড়িয়েই চলল। যত গরম বাড়বে, তত তার জিনিসের চাহিদা বাড়বে। তপ্ত গরমে এক ঢোক ঠাণ্ডা পানীয় মানুষ মাত্রেরই স্বপ্ন।
একরাশ স্বপ্নেই এ বছরটা শুরু করেছিল রক্তিম। গত বছরের শেষে এন আর সির কারণে ভাইজ্যাগটা ঘুরতে যাওয়া হয়নি। পরিবারের মুখে নেমে এসেছিল ঘন মেঘ। নেহাত লস কম হয়নি, না ঘুরেও পঞ্চাশ হাজার টাকা হাত থেকে খসে যাওয়ার কষ্টটা তাড়া করে নিয়ে বেড়াচ্ছে।
তাই এ বছর বেশ একটু মোটা টাকা জমিয়ে আন্দামানটাই ঘুরে আসবে ছেলে মেয়ের পরীক্ষাটা হয়ে গেলে। বছরের শুরুতেই শীতের কম্বলের তলায় শুয়ে স্বপ্নটা দেখেই ফেলল রক্তিম।
(২)
মার্চের বারো তারিখ, বিশ্ব স্বাস্থ্য দপ্তর ঘোষণা করল, করোনা বিশ্ব মহামারী রূপ ধারণ করেছে। তখনো রক্তিম বুঝতে পারেনি একটা লাল সংকেত দিচ্ছে দুনিয়া। তারপর, তারপর, তারপর….
তারপরের ঘটনা প্রবাহ যত সংক্ষিপ্ত, জীবন প্রবাহ তত বৃহৎ। কর্মপন্থা যত সরল, জটিল হল ততই সাধারণ মানুষের জীবন। বিষয়টা জটিল থেকে জটিলতর হয়ে উঠল।
বিশে মার্চ যেদিন জাতির উদ্দেশ্যে দেওয়া ভাষণে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ঘোষণা করলেন, ‘করোনাভাইরাসের মোকাবিলায় রবিবার ২২শে মার্চ সারা দেশে ‘জনতা কারফিউ’ বলবৎ থাকবে।’ সেদিনও রক্তিম মার্কেটিং করে বেড়িয়েছে… শহরের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত চষে বেরিয়েছে স্টক তাড়াতাড়ি ক্লিয়ারের আশায়।
বাড়ির কাছের মানুষের অনুরোধে বাইশে মার্চ সারাদিন নিজেকে বন্দি করেছে অবলীলায়… প্রধানমন্ত্রীর কথার থেকে গৃহমন্ত্রীর কথা বেশি প্রাধান্য পেয়েছিল সেদিন। ভাবেনি তখনো সেই বন্দিদশা কবে কাটবে জানা নেই কারো। একদিনের চৌদ্দ ঘণ্টার বন্দি দশা পার করতে না করতেই পরের দিন ঘোষিত হলো একুশ দিনের লকডাউন। লকড হবে সমস্ত ভারতবাসী।
পঁচিশ তারিখ রাত বারোটা থেকে নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য ছাড়া সমস্ত ব্যবসা বন্ধ, বন্ধ ট্রেন ও উড়ান পরিষেবা, বন্ধ পরিবহন ব্যবস্থা, আগেই বন্ধ হয়েছে স্কুল ও কলেজ, বন্ধ হলো সরকারি অফিস কাচারী। হঠাৎ যেন গতিময়তা হারিয়ে গেল পৃথিবীর। শান্ত, নিস্তব্ধ এক আকালবেলা। বনবন করে ঘুরতে থাকা পৃথিবীর সাথে সাইসাই করে ছুটতে থাকা মানুষগুলো যেন কোন এক অদৃশ্য চুম্বকের টানে গৃহবন্দি।
চোখের সামনে পৃথিবীর টলে যাওয়াটা অনুভব করল সে। বুঝতে পারল স্বাভাবিক জীবনে যেন একটা ছন্দপতন ঘটেছে।
মেজাজ ঠিক রাখার চেষ্টা করতে থাকল অনবরত। কিন্ত বারেবারেই মেজাজ হারাল।
এরই মধ্যে এস ডি ও ম্যাডামের কাছে গাড়ি চালাতে দেবার পারমিশন করে আনল। কিন্তু ভাবনা ও ঘটনার মেল বন্ধন হলো না। যে দোকানে প্রোডাক্ট পাঠাবে তারা বিক্রি করবে কীভাবে? কে কিনবে? সবাই তো গৃহবন্দি। মানুষ নিতান্ত প্রয়োজন ছাড়া বের হচ্ছে না। যারা বের হচ্ছে তারা প্রয়োজনীয় জিনিসের বাইরে কিছু কিনছে না।
তারপর এমন আবহাওয়া। বৈশাখ মাস, ফ্যান বন্ধ বরং কম্বলটা টেনে নিয়ে ঘুমোতেই যেন আরাম লাগছে।
তাতে করোনা ভীতি। গলায় সংক্রমণের ভয়। মানুষ কোল্ড ড্রিঙ্কস কেনার কথা আর ভাবছেও না। আর চোখের সামনে সম্ভবনাগুলোকে ঝলসে যেতে দেখছে রক্তিম। রাত মান দুই চোখের পাতা এক করতে পারছে না।
সন্ধ্যে নেমেছে, লাখ লাখ টাকার কোল্ড ড্রিঙ্কসের বোতলের হাত বুলোতে থাকে রক্তিম।
মিতা এসে বলল, ‘উপরে চলো। বাবা মা ডাকছেন।’
যেন শুনতেই পেল না তার কথা, আবার বলে ওঠে মিতা, ‘তোমার এভাবে চিন্তায় তোমারই শরীরের ক্ষতি হবে! কোনো ফল তো হবে না?’
ভাসা ভাসা দৃষ্টিতে তাকায় স্ত্রীর দিকে, ‘এভাবে আমাকে জ্ঞান দিচ্ছ এখন? আসলে ঠিকই বলে সবাই, হাতি যখন পাঁকে পড়ে মশাতেও লাথি মারে।’
মিতার চোখটা ছলছল করে ওঠে, কিন্ত সামনে কাঁদতেও পারে না। এক অসহায়তা কাজ করে তার মধ্যে। নিজের স্বামীর পরিস্থিতি সে বুঝতে পেরেই তো বলতে এসেছিল, কিন্তু…
একটাও কথা না বলে। চুপ করে রক্তিমের বকবক করা কথাগুলো শুনে উপরে উঠে আসে।
ব্যথায় বুকটা মোচড় দিয়ে ওঠে রক্তিমের। সে বোঝে, যে এভাবে মিতাকে বলাটা তার অন্যায়। সে যোগ্য স্ত্রীর কাজটাই করতে এসেছিল। কিন্তু যত রাগটা গিয়ে তো তার উপরেই পড়ে, কাছের মানুষকেই তো রাগ দেখানো যায়।
(৩)
‘বাবা, আমার ভূগোল স্যার কিছু প্রশ্ন দিয়ে পাঠিয়েছে তোমার হোয়াটস আপে, প্রিন্ট আউট করে দিতে পারবে?’
কোনো উত্তর দিল না রক্তিম। দ্বিতীয় বার কিছু না বলেই সে চলে গেল পাশের ঘরে। মেয়ের চলে যাওয়ার দিকে স্তব্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল সে। রক্তিম জানে মেয়ে আর বলবে না, সে সাহস তার নেই।
মেয়েও বুঝতে পারছে যথেষ্ট তার বাবার মানসিক অবস্থা। কিন্তু মেয়েটা লকডাউনে প্রতিকূলতার মধ্যেও নিজের পড়াগুলো করে যেতে চাইছে আপ্রাণ। বাবাকে দেখলে তারও বড্ড ভয় করছে।
রক্তিম ধীরে ধীরে গিয়ে বসল ল্যাপটপে। মেয়ের প্রশ্নগুলো প্রিন্ট করে দিয়ে এল মেয়ের কাছে। অসহায়তা দুজনের চোখেই। দুজনের চোখ বলে গেল ছুঁয়ে ছুঁয়ে, ‘কবে পাবো নিস্তার এর থেকে?’

রক্তিম বেরিয়ে এল বাইরে। খুব সুন্দর বাতাস দিয়েছে। ঝোড়ো হাওয়ায় উড়ছে চুল। কিছু মানুষ জীবনে থাকে যারা দূরে থেকেও পাশে থাকার আপ্রাণ চেষ্টা করে। অবলীলায় বলতে পারে, ‘আরে আমার কথায় ভরসা রেখো, সব ঠিক হয়ে যাবে! এত চিন্তা কোরো না তো, আমি তো আছি।’
হয়তো রক্তিমের সেই কথা শুনে বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে, কেউ তো আছে… কিন্ত কারো উপরে নির্ভর করে বাঁচতে শেখেনি। কথার ঝড় থেমে গেল ফোনটা বন্ধ করে দেয় সে, সবার সাথে ফোনে কথা বলতে ভালো লাগছে না তার। সেই তো একই কথা…
‘দেখেছিস কীভাবে বাড়ছে? লকডাউন আরো বাড়বে মনে হয়?’ … ভালো লাগছে না তার এসব শুনতে। কারো কাছে একটু আশার বাণী শুনতে পাচ্ছে না, কারো মুখে নেই নির্ভরতার কথা। বরং অনেকের মধ্যে আছে প্রচ্ছন্ন একটা ভালো লাগা। হঠাৎ তার এভাবে উন্নতি অনেকেরই গাত্রদাহের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। চুপ করে কিছুক্ষণ বসে থাকে গঙ্গার ধারে। ফিরে আসে বাড়িতে। এ বন্দিদশায় ছটফট করছে ওর মনটা।

রাতের খাবার টেবিলে কথা নেই কারো। চুপ গোটা পরিবার। যেন আসন্ন ঝড় উঠতে চলেছে। থমথমে পরিস্থিতি। ভয়ঙ্কর গুমোট…
বৃদ্ধ বাবা বলেন, ‘এত ভেঙে পড়িস না সব ঠিক হয়ে যাবে।’
মা এসে পাশে বসেন কিছুক্ষণ। কোনো উত্তর দিতে ইচ্ছে করে না তার। চুপ করে খাবারটা খেয়ে বিছানায় শুতে যায়।
যে ছেলেটা বাবা বাড়িতে ফিরলেই ঝাঁপিয়ে পড়ে বুকের উপর, বাবার সব সময় রাগী মুখটা দেখে সেও কাছে ঘেঁষতে ভয় পাচ্ছে আজকাল। দূর থেকেই দেখছিল বাবা শুয়ে শুয়ে নিজের পা টা নিজেই টিপছে। একটু সাহস করে এগিয়ে এসে বলে, ‘আমি টিপে দিই, তোমার পা।’

বুকে তুলে নেয় ছেলেকে। কী শান্তি নিজের সন্তানকে বুকে আঁকড়ে ধরার মধ্যে। কিন্তু গুদাম ঘরের ওই বোতলগুলো যেন বাবা ছেলের এই মধুর সম্পর্কের মধ্যেও এসে পড়তে চাইছে।
বাড়িতে আলো বন্ধ হয়। ঘুমিয়ে পড়ে সব্বাই। এত চিন্তা করা সহধর্মিনী, সেও সারাদিনের পর ঘুমে অচেতন। শুধু নির্ঘুম দুটি চোখ সম্ভবনার আলো খুঁজে বেড়াচ্ছে দিগ্বিদিক।
ঘুম আসে না রক্তিমের। ঘুমন্ত পরিবারের দিকে তাকিয়ে ভাবতে থাকে, পারবই এই নিশ্চিন্ত, শান্তির ঘুমটুকু ওদের আমি দিতে পারবই। কিন্তু নিজে ঘুমোতে পারে না। বেরিয়ে আসে বারান্দায়, রাত পাখিগুলো তীব্র চিৎকারে খানখান করে দিতে থাকে গভীর নিস্তব্ধতা। উদ্বেগ, ভয়, উত্তেজনা, অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কথা ভাবতে ভাবতে দ্রুত পায়চারি করতে থাকে সে। আকাশে লাল আভা… ক্লান্তিতে চোখটা জড়িয়ে আসে। চুপ করে শুয়ে পড়ে।
আর এক স্বপ্নের দুনিয়ায় চলে যায় সে, এক নতুন সকাল। স্বাভাবিক ব্যস্ত সকাল। বাড়ির সামনে ছোট হাতি গাড়িগুলো দাঁড়িয়ে, ওই বিল্টু, সুমন জিনিসগুলো লরিতে তুলছে। ড্রাইভার জিনিস দোকানে নামিয়ে ফোন করছে, আরো, আরো অনেক প্রোডাক্ট চাই ওদের… সামনে ঈদ!
নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়ে রক্তিম।
(৪)
একটু দেরি করে ওঠে। নীচের বারান্দায় এসে বসে সে। ব্যবসার মূল কেন্দ্র সেটা। চারিদিকে তার স্টক করা প্রোডাক্টগুলো যেন কাঁদছে। কাঁদছে রক্তিমের অন্তরটাও। আক্ষেপ বেরিয়ে আসছে প্রিয়জনের কাছে,
‘খুব অসহায় লাগছে। বড় ক্ষতির সম্মুখীন হতে চলেছি মনে হচ্ছে। আমার মনের অবস্থা কেউ বুঝছে না।’
নীরব শ্রোতা সকলে। বুঝতে পেরেও তো সবার কিছু করার থাকছে না।
এপ্রিল মাসটাও শেষের দিকে। বাড়িতে ভরা সংসার… বাবা, মা, স্ত্রী, সন্তান। চৌদ্দয় এপ্রিলের কথা চিন্তা করে একমাসের বাজার করেই রেখেছিল রক্তিম। মাস শেষেও পরিস্থিতি একই, একটু ভাবনায় রক্তিম। বরং পরিস্থিতির ভয়াবহতা বিচার করে বলে চলেছে বিশেষজ্ঞ মহল, করোনা পরবর্তী অবস্থা আরো জটিল হবে। হতে পারে দুর্ভিক্ষ, হতে পারে অভাব-অনটন। তাই একটু বেশি করে বাজার করে রাখা খুব দরকার ছিল।
‘দাদা এমাসের টাকাটা একটু আগে দিতে পারবে?’ …বিল্টুর গলায় ভাবনায় ছেদ পড়ল রক্তিমের।
‘কিছু বললি?’
‘বলছি, এ মাসের টাকাটা একটু আগে দিতে পারবে? বাজারটা কিছুটা করে রাখতাম!’
‘আচ্ছা, দাঁড়া…’ বলে ঘরের ক্যাশ বাক্স থেকে বিল্টুর আগামী মাসের মাইনেটা বের করে এনে দিল।
চেয়ারে ক্লান্ত হয়ে বসল। সে জানে এবারে অন্য কর্মীরাও দ্রুত আসবে। পাঁচজন কর্মীর টাকা তাকে প্রতিমাসে দিয়ে যেতে হবে। কিন্তু তার ক্যাশ বাক্সে ক্যাশ আসার রাস্তা বন্ধ।
মাথায় হাত দিয়ে সেটা ভাবতেই সুমন এসে হাজির, দাদা…
‘আগামী মাসের বেতনটা লাগবে তো…’
‘হ্যাঁ, মানে বাজারগুলো…’
সুমনের কথা শেষ হবার আগে ঘরে ঢুকল। বলল, ‘সবাইকে ডাক, আমি বেতনটা সবার দিয়ে দিই। কিন্তু এভাবে চলতে থাকলে আমি…’
‘দাদা, আমরা বুঝতে পারছি, কিন্ত আমাদেরও কোনো উপায় নেই তাই… তিন তারিখের পর সব ঠিক হয়ে যাবে আশাকরি।’
‘আচ্ছা, এখন যা। আমিও একটু বাজারে যাই…’
বলে বাজার বের হলো রক্তিম। হাঁটবার উদ্যম যেন সে হারিয়ে ফেলেছে। সব চেয়ে লাভের সময়টা ক্ষতির অন্ধকারে ঢেকে যেতে দেখছে সে।
বাজার করে বাড়ি ফিরল। বাড়ির বারান্দা থেকে উঠোন সব জায়গায় শুধু কোল্ড ড্রিঙ্কসের বোতলগুলো যেন বিদ্রুপ করছে তাকে। সোজা গিয়ে ঘরে ঢুকে নিজেকে বন্দি করল সে।
(৫)
লকডাউন… দিকে দিকে হাহাকার উঠল, গরিব মানুষরা কী খাবে? তারা আজ অসহায়। স্বাভাবিকভাবেই তাদের পাশে এসে দাঁড়ালো সরকার থেকে সমাজসেবী বা দরদী বা যারা প্রচারমুখী তারা সকলেই। ফল স্বরূপ, হয়তো আহ্লাদিত জীবন তারা পেল না, কিন্তু কিছুটা হয়তো উপকৃত হয়েছেই। সরকারি রেশনে চাল, গম, আলু বিতরণ সেটাও আছে সাথে।
কিন্তু আরেক শ্রেণির মানুষ, যারা তিলে তিলে তাদের ভবিষ্যৎ গড়ে তুলে, একটু সুখে থাকার স্বপ্ন দেখছিল। তাদের পাশে আজ কেউ নেই। তারা আজ অন্ধকারে পথ হাতরাচ্ছে।
রক্তিমের মত ছোট ছোট ব্যবসায়ীদের ঘাড়ে আজ তাদের স্টাফ, তাদের সংসার সব। কাউকে ঝেড়ে ফেলার মানসিকতা আজও তাদের নেই। কিন্তু চলবে কী করে? সেই চিন্তায় রাতের পর রাত দুচোখ এক করতে পারছে না তাঁরা। তাদের বুকে জমে থাকা কষ্ট বোঝার ক্ষমতা সমাজের বেশিরভাগ শ্রেণির মানুষের নেই।
রক্তিম আশৈশব লড়াই করে তিলে তিলে দাঁড় করিয়েছে তার সাধের ব্যবসা ক্ষেত্র। তাঁর গুদামে এখন লাখ লাখ টাকার জিনিস। কিন্তু দোকান বন্ধ… সরকার ঘোষিত লকডাউন।
রাস্তায় রাস্তায় মানুষ অবাধে ভাঙছে লকডাউন। রাস্তায় ভিড়, ব্যাংকে ভিড়, স্কুলের সামনে ভিড়, রেশন ডিলারের সামনে ভিড়, সবজি বাজারে ভিড়, মাছের দোকানে ভিড়, মাংসের দোকানে ভিড়, ওষুধের দোকানে ভিড়… কেউ অনেক দিন গৃহবন্দি হয়ে হাঁফিয়ে গিয়ে রাস্তায় আড্ডা মারতে বের হচ্ছে, কেউ সরকার ঘোষিত টাকা ব্যাংকে পড়েছে কিনা দেখতে বের হচ্ছে, কেউ রেশন নিতে যাচ্ছে, কেউ স্কুলে চাল নিতে যাচ্ছে, কেউ আগামী তিনমাসের নূন্যতম সঞ্চয় করে রাখতে বের হচ্ছে, কেউ বা ছুটির আমেজে তারিয়ে তারিয়ে ফ্রায়েড রাইস ও খাসির মাংসের ঝোল খাবার জন্য বের হচ্ছে, কেউ প্রয়োজনের কিছু ওষুধ আনতে বের হচ্ছে…. বের কিন্তু সবাই হচ্ছেই। পালিত হচ্ছে না লকডাউন।
কিন্তু রক্তিমের মত কিছু মানুষ না বের হতে পারছে, না বের করতে পারছে। লকডাউন লক করেছে তাদের ভাগ্যকে। দিনের শেষে খবরের হেডলাইনে চোখ, চোখ স্ট্যাটিস্টিকাল গ্রাফে… আর কত বাড়ল? নাকি কমল… কতটা কমল? তবে কী লকডাউনটা উঠবে? লাখ লাখ টাকার জিনিসগুলো বের হবে গুদাম থেকে? না এক্সপায়ারি ডেট দেখে জিনিস নয়, বুকের রক্ত জল করা টাকাগুলোকে ফেলে দিতে হবে?
প্রতিদিন স্বপ্ন দেখছে, কাল থেকে ঠিক হয়ে যাবে সব। এ শুধু স্বপ্ন নয়। এ বিশ্বাস। একটা সম্পূর্ণ শ্রেণির বিশ্বাস। একটা মানুষের বিশ্বাস, আপনার বিশ্বাস, আমার বিশ্বাস। এ শুধু স্বপ্ন নয়।

রক্তিমও নতুন আশায় দিন শুরু করে। হিসেবের খাতাগুলো টেনে নিয়ে বসে। স্বপ্নটা সত্যি হবেই এই বিশ্বাসে যেখানে যেটুকু পাঠাতে পারা যেতে পারে সেই কাজে হাত দেয়।
ঘুরে দাঁড়াবে তো লকডাউনে লক হয়ে যাওয়া রক্তিমের ভাগ্য?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here