ভারতের সৃজনশীল লেখক-অন্তরা ঘোষ এর স্মৃতিচারণ মূলক বিশ্লেষণ ধর্মী লেখা“কাশ্মীরি কাওয়ার সম্মোহনী ছোঁয়া”

330
অন্তরা ঘোষ এর স্মৃতিচারণ মূলক বিশ্লেষণ ধর্মী লেখা “কাশ্মীরি কাওয়ার সম্মোহনী ছোঁয়া ”

কাশ্মীরি কাওয়ার সম্মোহনী ছোঁয়া
অন্তরা ঘোষ

সম্রাট জাহাঙ্গীর যখন কাশ্মীরে এসেছিলেন তিনি কাশ্মীরের সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ হয়ে বলেছিলেন যে পৃথিবীতে যদি কোথাও স্বর্গ থেকে থাকে তাহলে সেটা এখানেই। সম্রাট যে শুধু কাশ্মীরের রূপে মজেছিলেন তাই নয় কাশ্মীরের সুগন্ধি পানীয় তাকে ভীষণভাবে আকর্ষণ করেছিল।
কাশ্মীরের পানীয় বা কাশ্মীরি কাওয়া হচ্ছে সেই ম্যাজিক চা যা একবার খেলে পর্যটক বিশেষ করে চা প্রেমী বাঙালি কাশ্মীরি চায়ের প্রেমে পড়বেই।
কাশ্মীরে গিয়ে আমার দু রকমের চা খাওয়ার অভিজ্ঞতা হয়েছে। একটা হচ্ছে কাশ্মীরি নুন চা, আরেকটা হচ্ছে কাশ্মীরি কাওয়া(kahwa)।
কাটরা থেকে পহেলগাঁও যাওয়ার পথে আমাদের ট্রাভেলার্স গাড়ি চা জলখাবার এর জন্য একটা রাস্তার ধারে রেস্টুরেন্টে দাঁড়ায়। সেখানে দেখি ট্রেতে একটা ছাতুর মত দেখতে পাউডার টাইপের কিছু মিশ্রিত জিনিস রাখা আছে। এই জিনিসটাই আবার প্যাকেট করে করে রাখা বিক্রির জন্য। আমি প্রথমে ছাতু ভেবেছিলাম।জিজ্ঞাসা করাতে দোকানের মালিক বলল এটা কাশ্মীরি নুন চা তে ব্যবহার করা হয়। আমি একটু অবাক জিজ্ঞেস করলাম নুন চা? সেটা আবার কেমন খেতে হয়?
মালিক হেসে আমাকে বলল, এক কাপ খাকে দেখিয়ে হমারে কাশ্মীরকে নমক চায়ে.. বহুৎ টেস্টি হোতা হ্যায়।
এই বলে এক কাপ দুধ চা তে এক চামচ ওই মশলাটা ওপর থেকে দিয়ে চামচে গুলে আমাকে খেতে দিল।
এত আন্তরিকতার সাথে দিল যে না করতে পারলাম না। পয়সা দিতে গেলাম কিছুতেই নিলো না। বললো ওটা আপনাকে খেতে দিয়েছি। ট্যুরিস্টদের প্রতি আন্তরিক ব্যবহার দেখে ভীষণ ভালো লাগলো। যদিও চা টা মুখে দিয়ে আমার খুব ভালো লাগে নি ।তার কারণ প্রথমত আমরা নুন চা খেতে অভ্যস্ত নই। দ্বিতীয়তঃ ওই মসলা টাতে নুন ছাড়াও আরো অনেক কিছু মিক্স ছিল যা এলাচ দেওয়া দুধ চা এর ফ্লেভারটাকে নিয়ন্ত্রণ করছিল। যাইহোক আমি দোকানের মালিককে বললাম যে খুব টেস্টি লাগলো। কেননা দোকানের মালিক সাগ্রহে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে একটা ইতিবাচক উত্তর আশা করছিল। দোকানের মালিককে ধন্যবাদ জানিয়ে আবার গাড়িতে চেপে বসলাম।
এবার আসি কাশ্মীরের বিখ্যাত ম্যাজিকাল চা কাশ্মীরি কাওয়ার কথায়। পহেলগাঁও থেকে শ্রীনগর যাবার পথে আমাদের ট্রাভেলার্স গাড়ি “জামিনদার কেশর মহল” বলে একটা গভরমেন্ট এর দোকানে দাঁড়ালো। আমরা সকলেই দোকানে গেলাম কেশর ও ড্রাই ফ্রুটস কিনতে। এখানেই দেখলাম কাশ্মীরি কাওয়া’র প্রচুর কৌটো বিক্রি হচ্ছে। বিক্রেতা ছেলেটি জানালো যে এই কাওয়া হচ্ছে এলাচ, লবঙ্গ, দারচিনি, গ্রিনটি, ড্রাই আদা সামান্য চিনির সংমিশ্রণে তৈরি। ছেলেটা বলে দিল কী করে এই চা টা বানাতে হয়। দোকানের পাশে এক জায়গায় এই কাশ্মীরি কাওয়া দেখলাম বিক্রি হচ্ছে। দেখলাম একটা গোল টেবিলের মধ্যে সমাবার এ চা রাখা। সমাবার হলো এক ধরনের চায়ের কেটলি পিতলের বা ব্রাশ মেটালের হয় ও প্রত্যেক কাশ্মীরিদের ঘরে থাকে। এটা ভারতের একমাত্র কাশ্মীরেই চায়ের জন্য ব্যবহার করা হয়।এটা দেখতে অনেকটা নবাবি আমলের কেটলির মত। সমাবার এর ভেতরে মাঝখানে একটা নল থাকে যেখানে কয়লা ঢালার জায়গা আছে। ফলে চা টা সবসময় গরম থাকে এই কেটলির মধ্যে। এমনিতে প্রত্যেক কাশ্মীরিদের ঘরে ছোট সাইজের সমাবার থাকে। কিন্তু বিয়ের মতন বড় উৎসব থাকলে সেখানে হাফ মানুষ সমান বড় সমাবার ব্যবহার করা হয়।
এক কাপ চায়ে চুমুক দিয়ে সত্যি জার্নির ক্লান্তিটা ভুলে গেলাম। ভীষণ রিফ্রেশিং চা। আমি একটা কাশ্মীরি কাওয়া কৌটো কিনে নিলাম।
এবার কাশ্মীরি কাওয়া সম্পর্কে একটু বলি। এক কথায় বলতে গেলে এটা হচ্ছে সুগন্ধি কেশরীয়া হার্বাল চা। কাওয়া নানা ভাবে তৈরি করা যায়। তবে কাশ্মীরিরা প্রধানত তিন ধরনের কাওয়া তৈরি করে। যেহেতু এটা কাশ্মীরের খুবই বিখ্যাত পানিও তাই কাশ্মীরের বিশেষ অনুষ্ঠান যেমন বিয়ের অনুষ্ঠান বা সন্তান হওয়ার খুশিতে অনুষ্ঠান ইত্যাদি ক্ষেত্রে কাশ্মীরিরা তাদের অতিথি অভ্যাগত জন্য স্পেশাল কাওয়া অর্থাৎ দুধ কেশরিয়া কাওয়া বানিয়ে থাকে। এতে দুধকে এলাচ লবঙ্গ দারচিনির সাথে ফুটিয়ে গাঢ় করা হয়। তারপর কাপে মিহি করে কাটা ড্রাই ফ্রুটস যেমন পেস্তা আমন্ড বাদাম কাজু ইত্যাদি দিয়ে গাঢ় করা দুধটা ঢেলে দিয়ে ওপর থেকে কেশর মেশানো দুধ ও আরও কিছুটা ড্রাই ফ্রুটস ছড়িয়ে পরিবেশন করা হয়।
দ্বিতীয় ধরনের কাওয়া ছোটখাটো ঘরোয়া অনুষ্ঠানের অতিথিদের জন্য তৈরি করা হয়। এতে প্রথমে দশ-বারোটা এলাচ হাফ কাপ জলে ভালোভাবে ফুটিয়ে ঠাণ্ডা করে ছেঁকে নিতে হবে। এবার দু’কাপ চা এর জন্য দু’কাপ জল নিয়ে এতে দারচিনি লবঙ্গ এলাচ দিয়ে গ্রীন টি বা যেকোনো চায়ের পাতা দিয়ে ফুটাতে হবে। তিন চামচ চিনি দিতে হবে। এলাচ ফোটানো জল টা দিয়ে দিতে হবে। সবশেষে কেশর ভেজানো জল দিয়ে ৫ মিনিট ফুটিয়ে কাপে ছেঁকে নিতে হবে। ওপর থেকে ড্রাই ফ্রুটস দিয়ে দিতে হবে। এটা এক ধরনের রিচ হারবাল টি তৈরি হয়ে গেল।
আর তৃতীয় ধরনের কাওয়া প্রত্যেক কাশ্মীরিরা প্রত্যেকদিন ঘরে খেয়ে থাকে। দু’কাপ চা এর জন্য দুধ জ্বাল দিয়ে এতে এলাচ লবঙ্গ দারচিনি গোলমরিচ আদা সব দিয়ে ফুটিয়ে কাপে ছেঁকে কেশর ভিজানো জল ও ড্রাই ফ্রুটস দিয়ে পরিবেশন করতে হবে। এটা এক ধরনের কাড়া টাইপ হারবাল টি।
কাশ্মীরি কাওয়ার উৎপত্তি নিয়ে কিন্তু নানান মতভেদ আছে। একটা মত অনুযায়ী কাশ্মীরি
কাওয়া চা চীন থেকে তিব্বত হয়ে স্পাইস রুট দিয়ে কাশ্মীরে এসেছে। আবার কেউ কেউ বলে থাকেন এর উৎপত্তি হয়েছিল কুষান রাজত্বকালে অর্থাৎ প্রথম ও দ্বিতীয় শতকে ইয়ারখন্ড ভ্যালিতে।
তবে উৎপত্তি নিয়ে যত মতভেদ থাক না কেন কাশ্মীরের সৌন্দর্য আভিজাত্য ও গরিমার সাথে কাশ্মীরি কাওয়া নিবিড় ভাবে জড়িয়ে আছে। এই চা কে ম্যাজিক টি ও বলা হয়। তার কারণ এই সুগন্ধি চা শুধু যে শরীরে ও মনে এক অদ্ভুত আমেজ ও এনার্জি এনে দেয় তাই নয় এই চায়ের অনেক উপকারিতাও আছে।
কাশ্মীরি কাওয়া মনসংযোগ বৃদ্ধিতে সাহায্য করে, হজম শক্তি বাড়ায়, চোখের দৃষ্টিশক্তি ভালো রাখে ,হজমে সাহায্য করে, এন্টিঅক্সিডেন্ট এর কাজ করে এমনকি মাইগ্রেনের সমস্যা থেকেও সাময়িক মুক্তি দেয়।
পরিশেষে বলি আমাদের বাঙ্গালীদের চায়ের সাথে মনের নিবিড় বন্ধন। কাপের পর কাপ চায়ের সাথে বাঙালির আড্ডা জমে ওঠে। রাজনীতি থেকে নিয়ে খেলাধুলা বা চলচ্চিত্র.. চায়ের কাপে তুফান তুলে জমাটি আলোচনায় মেতে ওঠে বাঙালি। শুধু স্বাস্থ্যকর আলোচনা কেন গরম ধূমায়িত চায়ের সাথে রয়েছে বাঙালির রোমান্টিসিজম। বাঙালির এই চা প্রেম কাশ্মীরিদের অবগত ।তাইতো করোনাকালের আগে বইমেলাতে সুদূর কাশ্মীর থেকে চা-বিক্রেতা এসেছিলেন বই মেলায় কাশ্মীরি কাওয়া চা নিয়ে। ফেব্রুয়ারির শীতে কেশরিয়া চায়ের আঘ্রাণ নিতে নিতে বইমেলায় বাঙালি যেন এক টুকরো কাশ্মীরকে অনুভব করেছিল। এবারেও বইমেলায় কাশ্মীরের ম্যাজিক চা বাঙ্গালী তথা বইমেলার পর্যটকদের অনেক বেশি তরতাজা ও চনমনে করে তুলবে বলেই আমার বিশ্বাস।
শীতের সকালে বেড টিতে সুগন্ধি কাশ্মীরি কাওয়ার কাপে চুমুক দিয়ে যেন ভূস্বর্গ কাশ্মীরকে মনেপ্রাণে অনুভব করা যায়।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here