অনুভবে রয়ে যায়
কলমেঃ সুনন্দা দাস
ছেলেবেলা মানে এক মুঠো কল্পনা। তার উপর সওয়ার করে লক্ষ হাজার যোজন পথ পাড়ি দেওয়া যায়। কেউ বলবেন 'কেন, বুড়ো বয়সে কল্পনার তরী বেয়ে কি হাজার যোজন পথ ভেসে বেড়ানো যায় না?' যায়। কিন্তু মুহূর্তে বাস্তবের শক্ত মাটিতে আছড়ে পড়তে হয়। ছেলেবেলায় সে সবের বালাই থাকে না।
ছেলেবেলা একটা অনুভূতি। স্থান কাল পাত্র ভেদেও এর পরিবর্তন হয় না। যদিও আমরা প্রায় সময় আমাদের আত্মজদের বলে থাকি, "তোদের তো ছেলেবেলা বলে কিছুই নেই রে। আমরা মাঠে ঘাটে দৌড়ে বেড়িয়েছি, কালবৈশাখী ঝড়ে আম কুড়িয়েছি, চুরি করে তেঁতুল -আচার খেয়েছি। " গদগদ হয়ে নিজের ছেলেবেলার ঝাঁপি খুলে বসি। লম্বা লিস্ট। শেষ হতেই চায় না। আমাদের ছেলেবেলায় আমাদের মা বাবা ও একই কথা বলেছে। তাদের লিস্টে ও এমন কিছু থাকতো, যেগুলোর সুযোগ আমরা হয়তো পায় নি। কিন্তু তাতে অনুভূতির কি কোন বদল ঘটেছে?
শৈশবে মুখে আধোআধো বুলি ফুটলেই 'চাঁদ উঠেছে ফুল ফুটেছে ','আতা গাছে তোতা পাখি ',
‘খোকা গেছে মাছ ধরতে ‘এই সব ছড়া গুলো আমরা মায়েরা বাচ্চাদের শোনাতে শুরু করি। আমরাও এই ছড়া গুলো শুনতে শুনতে বড় হয়ে উঠেছি – না, তার থেকে বলা ভালো কল্পনা করতে শিখেছি। প্রতিটি শব্দের অর্থ বুঝে কল্পনা করার বয়স তখনও হয় না। কিন্তু কল্পনা একটা আসেই। এই ছড়া গুলোর বিশেষ কিছু জায়গায় প্রতিটি বাচ্চাকে আমি বেশি মজা পেতে দেখেছি। ‘হাতি নাচে ঘোড়া নাচে, সোনা মনির বে’ – তারা বিয়ের অর্থ বোঝে না, কিন্তু হাতি ঘোড়ার নাচ আর সোনামণির বিয়ে শিশু মনে একটা ম্যাজিকের সৃষ্টি করে। তারা অনাবিল আনন্দে খিলখিল করে হেসে ওঠে। এই অনুভূতিটুকু আমার মনে হয় জেনারেশনের পর জেনারেশন একই আছে বা থাকবে। শুধু বদলাবে কি? শোনার মাধ্যম। আমরা আমাদের মা মাসীর মুখ থেকে এসব শুনেছি। আমার ছেলে ও আমার মুখ থেকেই শুনেছে। ওর শৈশবে মোবাইল ফোন এসে গেলেও স্মার্টফোনের এত রমরমা ছিল না। তার পরে পরেই স্মার্টফোন এসে গেল, ইউটিউব এসে গেল। বাচ্চারা চোখ খুলে চারপাশটা ভালো করে দেখতে না দেখতেই তারা স্মার্টফোন অপারেট করতে শিখে যাচ্ছে। ছড়া কবিতা গান গল্প সব তারা স্মার্টফোনেই শুনছে। শুনছে শুধু নয়, দেখছে ও।অনেকেই এবার বলবেন,এই তো বাবা, তুমি বলছো শৈশব মানে কল্পনা। তা এখনকার ছেলেপুলেরা কল্পনা করতেই তো শিখছে না।ছড়া গল্প শুনে বা পড়ে কল্পনা আসে। চোখের সামনে মোবাইলে দৃশ্যপট ফুটে উঠলে তাদের কল্পনা করার প্রয়োজন-ই তো পড়ে না। এখানে আমি একটা বাচ্চা মেয়ের গল্প বলি। নীনেল – আমার খুব কাছের বন্ধুর মেয়ে। বয়স ছয় সাত। কিছু দিন আগেই ওর মা আমাকে মেয়ের একটা ভিডিও পাঠায়। ভিডিও টি নীনেল নিজেই করেছে। মেয়েটি আঁকতে ভালো বাসে। আবার নতুন প্রজন্মের মেয়ে। দিনরাত ইউটিউবে গল্প শোনে, থুড়ি দেখে। ওর দেখা একটি গল্পের সব চরিত্র গুলো ও কাগজে এঁকে কেটে নিয়েছে। শুধু চরিত্র না, ব্যাকগ্রাউন্ডে গাছ বাড়ি যা আছে সব। এবার সেগুলো কে নিয়ে ও একটা ভিডিও করেছে। ও গল্পটা বলছে ওর মত করে, সাথে সাথে ওর আঁকা কাগজের টুকরো গুলো দিয়ে দৃশ্য পট তৈরি করেছে। এটা ওর মা ওকে শেখায় নি। তার মানে ইউটিউবে গল্প দেখতে দেখতে ও কল্পনা করেছে ওর মত করে।
আবার আমি একটু পিছিয়ে যায়, আমাদের ছেলেবেলায়। টিভি তে রামায়ণ দেখে কল্পনার সাগরে ভাসি নি, এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া কিন্তু বেশ মুসকিল বলেই আমার মনে হয়। আমি আমার কথাই বলি। রামায়ণের গল্প নিয়ে যে খেলা যায় এটা টিভিতে রামায়ণ না দেখলে হয়তো ভাবতেই পারতাম না বা খেলতাম ও না। আমার খেলার সাথী ছিল আমার ভাই। দুজনে মিলে কত খেলেছি- সিতা হরণ,রাম রাবন যুদ্ধ, হনুমানের লঙ্কা কাণ্ড – আরও কত কি! শুধু প্রতিবার খেলার আগে একচোট মারামারি নিজেরা করে নিতাম কে রাম আর কে রাবণ হবে এনিয়ে বা কে বীর হনুমান হবে বা কে রাক্ষস হবে এনিয়ে। এখনও মনে পরে, গোলগোল পাতার একরকম আগাছা বাড়িতে মাটি ভর্তি হয়ে থাকতো। সীতা হলে গলায়, হাতে, কোমরে ঐ আগাছা জড়িয়ে নিয়ে, মাথায় গামছা জড়িয়ে লম্বা চুল করে নিজেকে সত্যিকারের সীতাই ভাবতাম। হনুমান হলে কোমরে গামছা গুঁজে লেজ করতাম। সীতা হরণের সময় কপালের দুপাশ দিয়ে নিজের দুই হাত উঁচিয়ে ধরে সোনার হরিণের শিং করেছিলাম। তারপর গুঁড়ি হয়ে সারা বাগান দৌড়ে বেড়িয়েছি ‘সীতা- সীতা -লক্ষ্মণ বাঁচাও’ করে চিৎকার করতে করতে। পিছনে ভাঙা ঝুড়ি থেকে খুলে নেওয়া একটা কঞ্চি দিয়ে তৈরী ধনুক আর ঝাঁটার কাঠির তীর নিয়ে রাম তারা করছে যে।
আমি জানি আমার মত অনেকের স্মৃতির ঝুলিতে এমন অনেক কথা লুকিয়ে আছে।
তাহলে দুই প্রজন্মের ছেলেবেলায় তফাত কি নেই? আছে। অনেক তফাত আছে। জীবন যাত্রার তফাত আছে। কিন্তু তার জন্য কল্পনা কে বেঁধে রাখা যায় না। এই কল্পনা দেশ কাল সময়ের গণ্ডি পেরিয়ে অনেক অনেক দূর উড়ে যেতে পারে। আমি ছেলেবেলায় ‘আম আঁটির ভেঁপু’ বারবার পড়েছি। বারবার কেন? কারণ কল্পনায় বারবার অপু দুর্গার সংগে ওদের জীবনে হারিয়ে গিয়ে অনাবিল এক আনন্দে ভেসেছি। আবার যখন মার্কস টোয়াইন এর ‘টম সোয়ার’,আর ‘হাকল বেরি ফিন’ পড়েছি, ওদের দেশ-সংস্কৃতি সম্পর্কে ভালো করে কিছুই না জানলেও টম বা তার বন্ধু হাকল্ এর সঙ্গে একাত্ম হতে কোনো সমস্যা ই হয় নি। বহু বছর আগে পড়া। ঘটনা প্রবাহ তেমন ভাবে মনে নেই। তবে এটুকু মনে আছে আমার কল্পনায় হাকল বারবার ইন্দ্র (শরৎচন্দ্রের ‘শ্রীকান্ত’এর চরিত্র) হয়ে উঠছিল। তারমানে এক শিশু- কিশোরের কল্পনা দেশ কাল ভেদে বদল ঘটে না, তবে একাত্ম হওয়াটা জরুরী বলে আমি মনে করি। একাত্ম হতে না পারলে কল্পনা ডানা মেলতে পারবে না, বদ্ধ খাঁচায় গুমরে মরবে ।
এই বর্তমান প্রজন্মের সঙ্গে আমাদের ছেলেবেলার জীবন যাত্রার যে তফাত, তার জন্য একমাত্র আমরাই দায়ী। ওদের থেকে আমরা কেড়ে নিয়েছি অনেক কিছু। তারা ভর্তি আকাশ কেড়ে নিয়েছি, প্রাণ খুলে দৌড়ে বেড়ানোর জন্য খোলা মাঠ কেড়ে নিয়েছি। ছক কেটে চু-কিতকিত, কানা মাছি খেলার জন্য কেড়ে নিয়েছি উঠান। একান্নবর্তী পরিবার কেড়ে নিয়েছি, এমনকি নিউক্লিয়ার পরিবারে খেলার সাথী হিসেবে একটা ভাই বোন দিদি দাদা থাকার আনন্দটুকু ও কেড়ে নিয়েছি। দুপা ফেলতে না ফেলতেই পিঠে বইয়ের বোঝা নিয়ে পাঠিয়ে দিচ্ছি স্কুল। এত কিছু থেকে ওদের বঞ্চিত করে ” তোদের জীবনে তো শৈশব বলতে কিছুই নেই ” বলতে আমরা এতটুকু লজ্জা বোধ করি না।
আমাদের এত এত বঞ্চনার পরেও ফুটফুটে সবুজ কিশলয়রা কিন্তু চেটেপুটে উপভোগ করছে তাদের শৈশবকে, ছেলেবেলাকে। ছেলেবেলা ওদের প্রত্যেকের জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান অনুভূতি হয়ে থেকে যাবে আজীবন। ওদের পরের প্রজন্মের কাছে ওরাও একদিন গদগদ হয়ে ওদের ছেলেবেলার ঝাঁপি খুলে বসবে তা সে রাজার ছেলেই হোক বা ভিখারির, সে রাস্তায় জন্মাক বা অট্টালিকায়। জীবন যাত্রার মানের আকাশ পাতাল তফাত থাকলেও ছেলেবেলাকে ঘিরে যে অনুভূতি সেটা একই থাকবে। কারণ এক আদিম পবিত্রতা ছেলেবেলাকে, শৈশবকে ঘিরে থাকে, দ্বেষ হিংসা কাছ ঘেষতে ও পারে না। তবে যুদ্ধের মত ভয়ংকর পরিস্থিতিতে একমাত্র জীবনের সবচেয়ে সুন্দর, পবিত্র, আনন্দঘন দিনগুলো ভয়ংকর বিষময় হয়ে উঠতে পারে। আর সে লড়াই দুই রাষ্ট্র শক্তির মধ্যেই হতে হবে তাও না। যে কোনো লড়াই, দুই ধর্ম সম্প্রদায়ের মধ্যে হোক বা পারিবারিক। ঐ যে বললাম ছেলেবেলা এক অনুভূতি – তার কোনো ধর্ম নেই, রঙ নেই। তাই সব শেষে সমস্ত মানুষের কাছে আমার বিনীত অনুরোধ ছেলেবেলাকে বড়দের ঈর্ষা লালসা কুদৃষ্টির কোপ থেকে মুক্তি দিন। ছেলেবেলাকে মুক্ত বিহঙ্গ মেলে উড়তে দিন।