বেতিয়ারা যুদ্ধ
( ১১ নভেম্বর ’১৯৭১ সালে কুমিল্লার বেতিয়ারা নামক স্থানে ভয়াবহ এই যুদ্ধ হয়েছিল যা ইতিহাসে ‘বেতিয়ারা’ যুদ্ধ নামে পরিচিত।)
হাসানুজ্জামান
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে সারাদেশেই পাকিস্থানী বাহিনী এবং তাদের এদেশীয় দোসরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে মুক্তিযোদ্ধারা। যে যুদ্ধে এদেশের ত্রিশ লক্ষ মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হয়েছে। সম্ভ্রমহানি হয়েছে এদেশের মা-বোনদের। অনেক যুদ্ধের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধ হিসাবে পরিচিত কুমিল্লার ‘বেতিয়ারা যুদ্ধ’। এই যুদ্ধটি সংগঠিত হয় ১১ নভেম্বর’১৯৭১। যুদ্ধে বেশির ভাগ যোদ্ধা ছিল বাম প্রগতিশীল ঘরোনার। সেখানে পাক-বাহিনীর বিরুদ্ধে সন্মুখযুদ্ধে ন্যাপ-কমিউনিষ্ট-ছাত্রইউনিয়ন, খেলাঘর গেরিলা বাহিনীর ৯ জন যোদ্ধা নিহত হয়। তাদের মধ্যে খেলাঘরের শহীদ বন্ধুর নাম শহীদুল্লা সাউদ একজন। তিনি নারায়ণগঞ্জ জেলার অর্ন্তগত ঝিলিমিলি খেলাঘর আসরের সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন। তিনি ২ নং ঢাকেশ্বরী কটনমিলের কর্মচারী মোঃ জাবেদ আলী সাউদ ও মোসাম্মৎ জায়েদা খাতুনের চার সন্তানের মধ্যে তৃতীয় ছিলেন। গোদানাইল প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা শেষ করে তিনি ভর্তি হোন গোদানাইল হাই স্কুলে। এরই মধ্যে তিনি ঝিলিমিলি খেলাঘর আসরের সাথে জড়িয়ে পড়েন। সাংগঠনিক সম্পাদকের পদ থেকে আসরের কর্মকান্ড পরিচালনা করে আসছেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি আর বাড়ীতে থাকেননি। দেশপ্রেম তাকে বার বার তাড়িত করেছে যুদ্ধে যেতে। মাত্র ১৪ বছর বয়সে অন্যবন্ধুদের সাথে তিনি যুদ্ধের ট্রেনিং নিতে ভারতের আসামের তেজপুরে গিয়ে পৌছেন। সেখানে বাইখোলা বেইস ক্যাম্পে দীর্ঘ ৪ মাস যাবৎ ট্রেনিং শেষ করে তিনি একজন যোদ্ধা হয়ে ওঠেন।
যারা মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছেন তারা সকলেই যে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে গেছেন এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই । কিন্তু ন্যাপ-কমিউনিস্ট-ছাত্রইউনিয়নের ছেলেরা একটু ভিন্ন মাত্রার। সকলেই জানে তাদের নীতি,নৈতিকতা,মূল্যবোধ ,বিশ্বাস, দেশপ্রেম ,চেতনাবোধের জায়গায় কোন ঘাটতি নেই। ফলে তাদের সাথে অন্যদের মিল নাও ঘটতে পারে। ২৫ শে মার্চের কালোরাত্রির ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞের পর প্রথমে ঢাকার লোকজন এলাকা ছাড়তে শুরু করে। পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী ঢাকার বাইরেও তাদের আক্রমন শুরু করলে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষজন আর বাড়ীতে থাকতে পারেনি। তারা কখনো একা কখনো দলবদ্ধভাবে দেশ ছেড়ে প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতে গিয়ে আশ্রয় নেয়। ভারত সরকার সব রকম সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়। আমাদের দেশের সীমান্তবর্তী এলাকাতে ভারতের অভ্যন্তরে ক্যাম্প বসিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিং এর ব্যবস্থা করে দেয়। অনেক ক্যাম্পের মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য ক্যাম্প হলো আসামের তেজপুরের বাইখোলা বেইস ক্যাম্প। একাত্তরের মে মাসে ন্যাপ-কমিউনিস্ট-ছাত্রইউনিয়নের প্রায় ২০০ জনের মত কর্মী/সংগঠক এই ক্যাম্পে নাম লেখায়। এদের মধ্যে বর্তমানে কমিনিস্ট পার্টির উপদেষ্টা কমরেড মজ্ঞুরুল আহসান খান, দৈনিক প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিমন্ত্রী ইয়াফেস ওসমান ছিলেন। ট্রেনিং শেষ হয়েছে বেশ কিছুদিন আগে। কিন্তু অনুমতি না পাওয়ায় তারা দেশে প্রবেশ করতে পারছে না। ট্রেনিংপ্রাপ্ত যোদ্ধাদের এখন আর সময় কাটে না। বেইস ক্যাম্পে তারা বেশিরভাগ সময় তাস খেলে, গল্প করে সময় কাটায়। দুই একজনের কাছে রেডিও আছে। পাকিস্থানী রেডিও থেকে বার বার বলা হচ্ছে মিসক্রিয়ন্টরা পালিয়েছে। দেশ তাদের পুরো নিয়ণÍ্রণে। দুই/একটি খন্ড খন্ড যুদ্ধের কথা বলা হলেও সেখানে তাদের বিজয়ের কথাই বলা হচ্ছে । পাকিস্থানী রেডিওর খবর কেউ শুনতে চায় না। বিবিসির খবরের উপরেই সবাই নির্ভর করে। নভেম্বরের প্রথম থেকে বিজয়ের খবর আসতে থাকে। দেশের উত্তরাজ্ঞলের চাঁপাইনবাবগজ্ঞ,রংপুর,যশোর, কুষ্ঠিয়া. খুলনা ইতোমধ্যে শত্রুমুক্ত হয়েছে। ট্রেনিংপ্রাপ্ত যোদ্ধারা আর বসে থাকতে চায় না । তারা যুদ্ধে যেতে পুরোপুরি প্রস্তুত হয়ে অপেক্ষা করছে সিগনালের। বেইস ক্যাম্পে প্রতিদিনই গান, কবিতার আসর বসে, স্বাধীনতা প্রাপ্ত দেশের সাহসী মুক্তিযোদ্ধাদের গল্প শোনানো হয়। সাহসী হয়ে ওঠে যোদ্ধারা। মৃত্যুকে তুচ্ছ করে দেশ মাতৃকার লড়াইয়ে ঝাপিয়ে পড়ার অপেক্ষায় তারা। সিনিয়র লিডাররা ৭৮ জনের বাহিনীকে তিন ভাগে ভাগ করেন। কৃষক গেরিলা গ্রুপের নেতৃত্বে নিজামউদ্দিন আজাদ, শ্রমিক গেরিলা গ্রুপের নেতৃত্বে মীর মোশাররফ হোসেন ও ছাত্র গেরিলা গ্রুপের নেতৃত্বে ইয়াফেস ওসমানকে সিলকশন দিলেন। তারা যুদ্ধের সকল প্রস্তুতি শেষ করে অপেক্ষায় আছেন কখন ডাক পড়ে। অবশেষে সিনিয়র লিডার মজ্ঞুরুল আহসান খান এসে খবর দিলেন আগামী নভেম্বরের ৭/৮ তারিখে তোমাদের দেশে যাওয়ার অনুমতি মেলেছে। এ খবর শুনে সকলেই আনন্দে আত্বহারা। সকলেই সেই সময়ের অপেক্ষায় আছে। শরীরের মধ্যে উত্তেজনা অনুভব করছে । শত্রু নিধনের আকাক্সক্ষা তাদের মনের মধ্যে উত্তেজনা বাড়িয়ে দিয়েছে। সময় আর কাটে না। অবশেষে ৭/৮ নয়, ১১ নভেম্বর দুপুরের পর ভারতীয় এসএসবি’র ট্রাকগুলো ্র ক্যাম্পের সামনেই এসে দাড়িয়ে গেল। জোয়ানরা যার যার মত ট্রাকে চেপে বসলো। জোয়ানদের বহনকারি ট্রাকগুলো বিকেলের মধ্যে ভৈরব টিলায় গিয়ে পৌছলো। ট্রাক থেকে জোয়ানরা নেমে সিগন্যালের জন্য অপেক্ষা করতে শুরু করলো। ভৈরব টিলা থেকে দেশের সবুজ প্রান্তর দেখা যাচ্ছে। সবাই উৎসুক হয়ে তাকিয়ে প্রিয় মাতৃভুমির দিকে। এদিকে দেশে প্রবেশের যাবতীয় নকশা প্রণয়নের দায়িত্বে ছিলেন আবু তাহের ও সামসুল আলম। গাইডারের দায়িত্ব পালন করেন স্থানীয় আব্দুল কাদের ও আব্দুল মান্নান। ভৈরব টিলা থেকে সবচেয়ে কাছের গ্রামের নাম বেতিয়ারা। বেতিযারা কুমিল্লা জেলার চৌদ্দগ্রাম উপজেলায় অবস্থিত। বেতিয়ারা গ্রামের পাশদিয়ে ঢাকা-চট্রগ্রাম রাস্তা চলে গেছে। রাস্তা অতিক্রম করে গ্রামের মধ্যেদিয়ে জোয়ানরা সামনে এগুতে চায়। বেতিয়ারা গ্রামের উত্তরে জগন্নাথ দিঘী এলাকায় পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর ক্যাম্প রয়েছে। পাক-বাহিনীর এই ক্যাম্পটি অন্য ক্যাম্প থেকে একটু আলাদা। কেননা ভারতের সাথে বেতিয়ারার যোগাযোগ ব্যবস্থা অন্য এলাকার তুলনায় ভাল। দেশে প্রবেশের জন্য মুক্তিযোদ্ধারা এই রুটকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করে। একই ভাবে শত্রু বাহিনীর প্রবেশ ঠেকাতে হানাদার বাহিনী সর্বদা তৎপর থাকে। গাইডার কাদের ও মান্নান ইতোপূর্বে মুক্তিযোদ্ধাদের বেশ কয়েকটি দলকে এই রাস্তা দিয়ে দেশে প্রবেশ করতে সাহায্য করেছে। ফলে তারা মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে বিশ্বস্ত হয়ে উঠেছে। গাইডাররা ঢাকা-চট্রগ্রাম রাস্তা বার বার রেকি করে মুক্তিযোদ্ধাদের দেশে প্রবেশের সিগন্যাল দেয়। ভৈরবটিলা থেকে জোয়ানরা যখন নেমে আসে তখন সন্ধ্যা গড়িয়ে রাতের অন্ধকার নেমে এসেছে। শীতের প্রকোপ পড়েনি ঠিকই। কিন্তু সোয়েটার বা চাদর গাঁয়ে না দিলে বেশ শীত অনুভ’ত হয়। চারিদিকে জঙ্গলে ভরা। সাপ -পোকামাকড়কে দেখে আর কি ভয়। যেখানে জীবন দিতে তারা একটুও কার্পণ্য করতে চায় না। সেখানে আবার কিসের ভয় ? চারিদিকে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক। গাড় অন্ধকার চারিদিকে। জমির আইলের উপরদিয়ে তারা হেটে চলেছে সামনের দিকে। সন্মুখে রয়েছে গাইডার কাদের ও মান্নান। তারা স্থানীয় সাহসী যুবক, মুক্তিযোদ্ধা। তাদের দেখানো পথেই জোয়ানরা হেঁেট চলেছে সাহসী পদচারণায়। রাত তখন বেশ গভীর। ঘড়ির কাঁটায় ১১ টা ছুঁই ছুঁই। সামনেই ঢাকা-চট্রগ্রাম মহাসড়ক। এই রাস্তা অতিক্রম করে তারা গ্রামের মধ্যদিয়ে সামনে এগিয়ে যাবে এই তাদের লক্ষ্য। জোয়ানদের হাতে রয়েছে হালকা,মাঝারী সব রকম গোলাবারুদ। চারিদিকে চুপচাপ, কোন শব্দ নেই। রাস্তায় কোন গাড়ীও নেই। সামনের কালভার্ট পার হলেই রাস্তা। কালভার্টের উপর পা রাখামাত্র পাকিস্তানী মিলিটারী গুলিবর্ষণ শুরু করে দেয়। বৃষ্টির মত গুলিবর্ষণ চলতে থাকে। শুধু একদিক থেকে নয় তিনদিক থেকে গুলিবর্ষণ চলতে থাকে। পাক-বাহিনী এ্যাম্বুশ করে আগে থেকে অপেক্ষা করছিল । নিজামউদ্দিন আজাদ ও তার জোয়ানরা জয় বাংলা শ্লোগান দিয়ে পাল্টাগুলি চালায়। জোয়ানরা মনবল ধরে রাখতে সমস্বরে শ্লোগান দিতে থাকে।‘ জয় বাংলা, জয় সমাজতন্ত্র। দুনিয়ার মজদুর এক হও’। কিন্তু হানাদার বাহিনীর আকস্মিক আক্রমণে হতচকিত হয়ে যায় জোয়ানরা। রাস্তার পাশে শুয়ে পড়ে আজাদ পাল্টা গুলি চালাতে থাকে। এক সময় আজাদ বুঝতে পারে পূর্বপ্রস্তুতিতে থাকা হানাদার বাহিনীর সাথে লড়াই চালিয়ে যাওয়া কঠিন হবে। সে তার জোয়ানদের পিছন ফিরে যাওয়ার নির্দেশ দিলেও আজাদ যুদ্ধ চালিয়ে যেতে থাকে। আজাদের বেঁচে যাওয়া সঙ্গীদের মধ্যে অনেকেই বলেছেন আজাদ নিজ দলের সাথীদের জীবন বাঁচাতে তাদের পিছনে ফিরে যাওয়ার নির্দেশ দেয়। সেই সময় আজাদ গুলি চালানো বন্ধ করলে দলের জোয়ানদের ব্যাপক ক্ষতি হতো। জোয়ানদের রক্ষা করতেই সে কয়েকজন মিলে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে থাকে। এক সময় পাক-হানাদার বাহিনীর ছোঁড়া একটি গুলি এসে লাগে আজাদের গাঁয়ে। আজাদ রাস্তার পাশে লুটিয়ে পড়ে। আজাদের মুখ থেকে উচ্চারিত হতে থাকে ‘ জয় বাংলা’। গুরুতর আহত আজাদকে সহযোদ্ধারা ধরাধরি করে ভারতীয় সীমান্তের দিকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্ঠা করে। ঠিক এই সময় শত্রু বাহিনীর গুলিবর্ষণের তীব্রতা আরো বেড়ে যায়। এই যুদ্ধে আজাদের পাশ থেকে পাক-হানাদার বাহিনীর গুলি খেয়ে একের পর এক হারিয়ে যায় শহিদুল্লাহ সাউদ,মোঃ সিরাজুম মনির জাহাঙ্গীর, বশিরুল ইসলাম মাস্টার,আওলাদ হোসেন,দুদু মিয়া,আব্দুল কাউয়ুম,আব্দুল কাদের,মোহাম্মদ শফিউল্লা। একের পর এক সাথীদের মৃত্যু যণÍ্রণায় আজাদও মৃত্যুকোলে ঢলে পড়ে। এখানেই যুদ্ধ থেমে যায়নি। সারারাত পাকিস্থানী বিমান ভারতীয় সীমান্তবতী এলাকায় ব্যাপক বোমাবর্ষণ করে। ভারতীয় সেনাবাহিনীর বিশেজ্ঞরা এই যুদ্ধের ব্যাপারে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেছেন ‘ এই ধরনের যুদ্ধে যে পরিমান ক্ষতিহওয়ার কথা সেই ক্ষতি হয়নি। জোয়ানদের কৌশলের কারণে রক্ষা পাওয়া সম্ভব হয়েছে’।
এই লাশগুলি রাস্তার ধারে পড়ে থাকে। কয়েকদিন পর স্থানীয় লোকজন ঘটনাস্তলে এসে লাশ দেখে হতভম্ব হয়ে পড়ে। ঢাকা-চট্রগ্রামের রাস্তার ধারেই লাশগুলো মাটি দেয়ার ব্যবস্থা করে। পরবর্তীতে সরকার শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে এখানে একটি শহীদ মিনার নির্মাণ করে দেন। এই যুদ্ধ ইতিহাসে ‘বেতিয়ারা যুদ্ধ’ নামে পরিচিত।
লেখক ঃ সদস্য, খেলাঘর কেন্দ্রিয় কমিটির সদস্য। মোবাঃ ০১৭১১-১০৮৭৩৬