ভারত থেকে কলমযোদ্ধা-অগ্নিমিতা দাসের বিশ্লেষণ ধর্মী স্তনকর ব্যাবস্থার ভয়ংকর কাহিনী নিয়ে লেখা “বিভেদের বিষবৃক্ষ”

264
অগ্নিমিতা দাসের বিশ্লেষণ ধর্মী স্তনকর ব্যাবস্থার ভয়ংকর কাহিনী নিয়ে লেখা “ বিভেদের বিষবৃক্ষ”

“বিভেদের বিষবৃক্ষ”
কলমে_ অগ্নিমিতা দাস

ভূমিকা – সাবিত্রী ফুলে ও তার স্বামী জ্যোতি ফুলে জাতপাতের বিরুদ্ধে গিয়ে প্রথম অস্পৃশ্য সমাজের বালিকাদের
জন্য বানিয়েছিলেন বিদ্যালয়। ভারতের ইতিহাসে সেই প্রথম।সাবিত্রীবাই শতছিন্ন শাড়ি নিম্নবর্ণের মানুষদের পাড়া দিয়ে হেঁটে স্কুলে যেতেন, কারন পথে সবর্ণ সমাজের মানুষরা তার গায়ে কাদা, ইট, পাটকেল ছুড়তো।বেশ্যা, ডাইনি বলে অপবাদ দিত।সাবিত্রীবাই স্কুলে গিয়ে ব্যাগ থেকে পরিচ্ছন্ন শাড়ি পড়ত।
যুগ যুগ ধরে মেয়েরা বিভিন্ন ভাবে প্রতিবাদে সামিল হয়েছে।
বাল্মীক জাতের মেয়েদের সম্মিলিত প্রতিবাদে বন্ধ হয়েছে উচ্চবর্ণের লোকেদের শৌচাগার সাফ করার কাজ।আজও কী মেয়েরা নিস্তার পেয়েছে এই অত্যাচার থেকে ? বর্ণ বৈষম্য কী ঘোচাতে পেরেছি আমরা ? ধর্মের, জাতের নামে, কতদিন এই অমানবিক পাশবিক অত্যাচার চলবে?কেউ জানে না। ভাবতেও গা শিউরে ওঠে এ কোন সমাজে আমরা বাস করছি।

বেশ কিছু বছর কাগজের প্রথম পাতায় খবর টা পড়ে চমকে গেছিলাম। গুজরাটের ভুজে,’ শ্রী সহজানন্দ গার্লস ইনস্টিটিউটে’ অন্তর্বাস খুলিয়ে ঋতুমতী কিনা পরীক্ষা করা হয়। ঋতুচলাকালীন মেয়েদের মন্দির ও রান্নাঘর চত্বরে থাকা মানা। তারা যে তখন অস্পৃশ্য।
এ কোন সমাজে বাস করছি!

আমরা কেতাদুরস্ত পোষাক পড়ে ইন্টারনেটের দৌলতে গোটা দুনিয়া কে হাতের মুঠোয় পুরে নিয়ে ভাবছি অনেক এগিয়ে গেছি। সরকার # বেটি পড়াহো প্রজেক্ট নিয়ে মাতামাতি করছে।
কিন্তু ব্রাহ্মণবাদের অন্ধসংস্কারের জালে জড়িয়ে ক্রমে কোথায় তলিয়ে যাচ্ছি।
এবারে নারী শক্তি জাগো!
গুড়িয়ে দাও ধর্মের নামে এই নোংরামি!

আমাদের কাছে কলম ছাড়া আর কিছু নেই। তাই কলমের মাধ্যমেই জানাতে চাই,মেয়েরাও মানুষ। তাদেরও রক্ত মাংসের শরীর। শীত,গ্রীষ্ম সবই অনুভব করতে পারে। ছেঁকা লাগলে তাদেরও গায়ে ফোস্কা পড়ে। জোর করে সহমরণে পাঠিয়ে দিয়ে যখন পুড়িয়ে মারা হয় , তাদের অসহ্য যন্ত্রনা হয়। লোভী শৃগাল যখন বলাৎকার করে তার জীভ কেটে নিয়ে মেরুদন্ড ভেঙে দেয়,তখনও ভীষণ কষ্ট হয়। আর কত দিন মনুষত্ব প্রমাণের জন্য মেয়েদের অগ্নিপরীক্ষা দিতে হবে, তা কেউ জানে না। এই পরিপ্রেক্ষিতে একটি সত্যি গল্প আবার বলার চেষ্টা করছি।

দক্ষিণ ভারতে ‘ব্রেস্ট ট্যাক্স’ ( স্তন কর) প্রথা চালু ছিল নিম্ন বর্ণের হিন্দু নারীদের জন্য। এই নারীরা দেহের উর্ধাংশ অনাবৃত রাখতে বাধ্য হত। যদি কোন নারী ঊর্ধ্বাংশ কাপড় দিয়ে ঢাকতো, তাহলে তাকে স্তন কর দিতে হত। ছোট স্তনের জন্য কম কর , যাদের স্তনের আকার বড় তাহলে তাদের বেশি কর দিতে হত।
ব্রাহ্মণ সমাজ ও তথাকথিত কিছু উচ্চ শ্রেণীর নারীদের জন্য এই বিধান ছিল না। এই স্তন করের কিছু অর্থ ভোগ করতো সমাজের কিছু মুষ্টিমেয় উচ্চবর্ণের মানুষ।
বাকি অর্থ জমা হতো দক্ষিণ ভারতের পদ্মনাভ মন্দিরের তহবিলে।
এই মন্দির বিশ্বের সবচেয়ে ধনী মন্দির হিসাবে আখ্যা পায়।
এই মন্দিরের পুরোহিতদের দাবি ছিল নিম্নবর্ণের হিন্দু নারীদের বক্ষ আবৃত করার কোন অধিকার নেই। এটা অর্ধম। মহা পাপ। যদি কেউ এই বক্ষ নিরাভরণ রাখতে লজ্জা পায় তাহলে তাকে অবশ্যই দেবতা কে কর দিতে হবে।
এই করের অর্থের ভার বহন করাএই দিন আনা দিন খাওয়া মানুষ গুলোর পক্ষে অত্যন্ত মুস্কিল ছিল।

এই স্তন করের প্রতিবাদ করে প্রথম নাংগেলী নামক এক নিঃস্তান নারী। সে ও তার স্বামী চিরুকান্দান ট্রাকানভোরের চিরুথালাতে বসবাস করতো।
তারা এজহাভা সম্প্রদায়ের ছিল।
নাংগেলী দেহের উপরিভাগ বস্ত্র দিয়ে ঢেকে রাখতে শুরু করে।। স্থানীয় স্তন করের শুল্ক কর্তা কর আদায় করতে এসে দেখে নাংগেলীর উর্ধাংশ ঢাকা। শুল্ককর্তারা স্তন কর দিতে জোর করে।
নাংগেলী অকুতোভয় হয়ে স্তন কর না দিয়ে নিজের দেহের উর্ধাংশ আবৃত রাখতো। বিষয়টি পদ্মনাভ মন্দিরের পূরোহিতদের দৃষ্টিগোচর হয়।

এই সব বিকৃত কাম ভেকধারী পূজারী ব্রাহ্মণরা ঘরের বাইরে এই নীচুশ্রেণীর নারীদের অনাবৃত বক্ষ দেখে নিজেদের লালসা নিবৃত্ত করতো।
তাই তাদের এই মনোবাসনা পূর্ণ না হওয়াতে তারা নাংগেলীর স্তনের কর আরো বাড়াতে থাকেএবং তা দেওয়ার জন্য চাপ দিতে থাকে।

এই চাপ সহ্য করতে না পেরে নাংগেলী ঘরে শুল্ককর্তাদের ডাকে। নাংগেলী ধারালো অস্ত্রের সাহায্যে নিজের বক্ষ দুটি কেটে কলাপাতায় মুড়িয়ে শুল্ক সংগ্রাহকদের উপহার দেয়।
অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে নাংগেলীর মৃত্যু হয়।নাংগেলীর মৃত্যুতে শোকাহত তার স্বামী চিরুকান্দান চিতাতে সহমরণ যায়। এটি বোধহয় প্রথম পুরুষের নারীর জন্য সহমরণে যাওয়া।
নাংগেলীর মৃত্যুতে নিম্ন বর্ণের মানুষের মনে প্রভাব আনে। এই প্রতিবাদ জোরালো হয় ১৮৫৯ সালে ট্রাভানকোরে।
এই দাঙ্গার মূল লক্ষ্য ছিল নিম্ন বর্ণের হিন্দু নারীদের উর্ধাংশের বস্ত্র পরিধানের অধিকার বিনা শুল্ক দিয়ে।এটি” কাপড় দাঙ্গা” নামে ব্যাপক হারে পরিচিতি পায়।আইনের মাধ্যমে ট্রাভানকোরে ‘স্তন কর’ বা’ব্রেস্ট ট্যাক্স’ রোধ হয়।

ভাবতে অবাক লাগে সেই সময়ের ব্রাহ্মণসমাজের নারকীয় ঘটনা এখনও বহাল তবিয়তে চলছে!বিনা প্রতিবাদে!আমরা যেন ধর্মের নামে সমস্ত রকমের নোংরামিরবিরূদ্ধে গিয়ে প্রতিবাদে সোচ্চার হই।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here