“হরিষে বিষাদ” নর্থকেরলীনায় তুষার পাত। বরফের ভ্রমন কাহিনী লিখেছেন আমেরিকা থেকে কাব্য ভারতী কবি কলমযোদ্ধা সাহানুকা হাসান শিখা ।

590
বরফের ভ্রমন কাহিনী লিখেছেন আমেরিকা থেকে কাব্য ভারতী কবি কলমযোদ্ধা সাহানুকা হাসান শিখা ।

হরিষে বিষাদ

সাহানুকা হাসান শিখা

কত আনন্দ উচ্ছাসে ভরা ছিলো এই সময় টুকু যদিও বড় মেয়ে ও নাতনী নিউইর্য়ক এ।
মেঝ মেয়ে নাতনী এখানেই থাকে। ছোট মেয়ের বাড়িতে আসলাম এই প্রথম।
নতুন স্বপ্ন নিকেতন কিনেছে কিছুদিন আগে। দেশে ছিলাম, তাই আসতে পারিনি।
সেদিন রওয়ানা হলাম ওর বাবা আর আমি। সূর্য্য উঠা ভোরে গন্তব্য স্থলে পৌঁছাতেই দেখি
ছোট্ট পুতুলের মত মেয়েটি আমার বাইরে দাঁড়ায়ে আছে গাড়ি নিয়ে।জড়িয়ে ধরলো
আমাদের, কি যে আনন্দ হচ্ছিল বলে বুঝাতে পারবো না। বাসায় ঢুকতেই দেখি, এটা যেন
পাখির নীড় আর চারিদিক জুড়ে সবুজ বনে ঘেরা, যদিও একটু ভাটা পড়েছে সবুজ বনে
শীতের আমেজ শুরু হয়েছে। ছয় একর জায়গা জুড়ে বিশাল সবুজ বনভূমির
মাঝখানে ছোট্ট ডুপ্লেক্স বাড়ি। পুকুর জুড়ে শুধু হাঁস আর পাখির মেলা,
রাজহংসের গর্জন একটু পর পর। পাখির কিচির মিচির, এক কোনে ধ্যানে মগ্ন ঋষি।
মাছরাঙা চেয়ে আছে শিকারের আশায়। মেয়ে বললো পুকুরে নাকি অনেক রকমের মাছ
আছে। এই বাসায় অনেক বড়িশ ও আছে আগের লেন্ড লডের।
বাসার ভিতরেও খুব সুন্দর ছবির মত সাজিয়েছে মনে হয় যেন কোন শিল্পীর হাতের যাদুর ছোঁয়া।


খুব অল্প দিনের মাঝে জব করেও ঘরের সবকিছু এতো পরিপাটি করেছে, না দেখলে বুঝা যায় না।
এতো সুন্দর করে নাস্তার টেবিল রেডি করলো মাত্র দশ মিনিটে, ওর বাবার সব পছন্দের খাবার
দুজনে বসে নাস্তা করছি, ডাইনিংয়ের কাছেই কাঁচের টানা দরজা দিয়ে দেখছি প্রকৃতির
মনোরম দৃশ্য আর পাখ- পাখালির মধুর কুন্জন নাস্তা সেরেই আমাকে নিয়ে হাঁটতে শুরু করলো
ওর বিশাল জমিদার বাড়ি দেখাতে। ওর বাবা তখন রেস্ট নিচ্ছেন।
সব দেখে ফিরে এসে একটু বিছানায় হেলান দিকেই চোখে পড়লো সেই পুকুর ঘাট,ঝাঁক
বেঁধে রাজহংসের সন্তরণ খেলা। প্যঁাক প্যাঁক আওয়াজ করছে আর খেলা করছে
শুয়ে শুয়ে দেখছি নয়ন ভরে, দেখে দেখেও যেন তৃষ্ণা মিটেছ না এই নয়নাভিরাম দৃশ্য।
মেয়ে বলছে আম্মু অপেক্ষা করো সন্ধ্যার একটু আগেই আসবে হরিণ, চুপ করে লুকিয়ে থাকবে পাতার ফাঁকে।
ইতিমধ্যেই আমার মেঝ জামাই ইফতি এসে গেছে বন ফায়ারের সরন্জাম নিয়ে, পুকুর পারে হবে বনফায়ার। আবহাওয়া দফতর
জানিয়েছে আগামি কাল ৮থেকে ১০ ইন্চি বরফ হবে। প্রস্তুতি চলছে স্নো কে সামাল দেয়ার সাথে সাথে উপভোগ করা আর ছবি তোলা।
পাঁচটায় সূর্য্য বিদায় নিলো, বিকালের চা নাস্তা সেরে সবাই মিলে বন ফায়ারের আগুন পোহাতে
লাগলো, প্রচণ্ড শীতের মাঝে গরম কাপড় পরে খুবই মজা লাগছিলো সাথে বারবিকিউ।
ধীরে ধীরে ঠাণ্ডা বাড়তে শুরু করলো, আর বাইরে থাকা সম্ভব নয়। ঘরে এসে গল্প গুজবে
সবাই ব্যস্ত। আমি তো জার্নি করে এসে ঘুমাতে পারিনি তাই একটু তাড়াতাড়ি বেডে গেলাম।
মেয়ে বললো টিভি দেখো আম্মু, অন করো, আমার তো জলদি ঘুম আসবে না
হঠাৎ চমকে উঠলাম একি !! আমি তো বসে আছি, অটমেটিক খাটটা
উঁচু হয়ে গেলো হাসপাতাল এর খাটের মত। মেয়েকে বললাম এটা কি হাসপাতাল ??
নামিয়ে দাও আমি এবার ঘুমাবো। একটু পর দেখি আমার সারা শরীর ঝিনঝিন
করছে, সাথে সাথে টের পেলাম এটা মাসাজ খাটের মাঝেই মাসাজ ফিট করা।
সব ক্লান্তি চলে গিয়ে চলে গেলাম নিদ্রাবতির কোলে। কতক্ষণ ঘুম হলো জানি না
বাতরুমে যাওয়ার জন্য উঠলাম, ফোনে টাইম দেখলাম রাত দু’টো বাজে।
জানালার পর্দা সরাতেই দেখি এ কি কান্ড!! আমি তো সেই বাড়িতে নেই, সাদা ধবধবে
তুষার নগরী তে। তুলার মত রাশিরাশি তুষার পড়ছে, বাসার সবাই গভীর নিদ্রায় মগ্ন।
গাছপালা পুকুর ঘাট, বাগান সব সাদা। বেশ কয়েক ইন্চি হয়ে গেছে স্নো। বাকি রাত টা
তুষার কন্যাদের কান্ড দেখেই কাটালাম। আর ঘুম হলো না। আস্তে আস্তে সবার ঘুম ভাঙলো,তুষার মানব
বানানোর জন্য সবাই ব্যস্ত হয়ে উঠলো। প্রতিবেশী একটি সুন্দর তুষার মানব (স্নো ম্যান) বানিয়েছে তার বাগানে।


নাস্তা সেরেই বেরিয়ে পড়লাম ঘরের বাইরে শুধু ছবি তোলা আর বরফের মাঝে খেলা করা। আমার ছোট মেয়ের হাতেই তার ফোন ও আমার ফোন, আমার ফোনে বেশী ছবি তোলা হচ্ছে। দুপুরের দিকে আর ঠান্ডা সহ্য
হচ্ছিলো না, তাই সবাই চলে এলাম ঘরে। শুধু ফিরলো না আমাদের স্মৃতি,
মেয়ে হঠাৎ চিৎকার দিয়ে বললো, আম্মুর ফোন নেই, স্নো তে পড়ে গেছে, রিং করলে মেসেজে যাচ্ছে। এতক্ষণে নীথর হয়ে পড়ে আছে দশ ইন্চি তুষারের নীচে। সবাই আবার বেরুলো খুঁজতে কিন্তু পেলো না। সকল আনন্দ সুখের স্মৃতি বন্দি ছিলো এই ফ্রেমে, এখন সবার মন খারাপ। আমি এফ বি তে যেতে পারছি না। অশান্তি লাগছে।

তিন দিন পরের ঘটনা। প্রতিদিন একটু একটু করে স্নো কমছে, আর সবাই ফোন খুঁজতে বের হচ্ছে পুকুর পাড়ে আর বাগান বাড়িতে।
তৃতীয় দিন দুপুর বেলা আমি একা বের হলাম দোয়া দুরুদ পাঠ করে বেলচা হাতে নিয়ে খুচিয়ে খুচিয়ে দেখছি। হঠাৎ চোখে পডলো গোলাপি রঙের ফোনের কাভারের কিছু অংশ। ভীষণ আননন্দে লাফিয়ে উঠলাম, সেই আর্কিমিডিসের সূত্রের মত। ইউরেখা ইউরেখা।
পেলাম সেই প্রাণহীন দেহ। তিন দিনের ঠাণ্ডায় পাথর হয়ে গিয়েছে, বিকল কোন কাজ করছে না চার্জ নিচ্ছে না।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here