শান্তিনিকেতন
হাসানুজ্জামান
সেদিনই দুপুরে মুর্শিদাবাদ থেকে ঘুরে এলো রানা। পরের দিন সে শান্তি নিকেতনে যাবে। তার সাথে আরো তিনজন। সকলেই বাংলাদেশী। রাতে ঘুমানোর আগে শান্তি নিকেতনের প্রতিচ্ছবি বারবার চোখের সামনে ভেসে উঠছে। বই-পুস্তকে শান্তিনিকেতন সম্পর্কে বেশ পড়া আছে তার। কিছুদিন আগে রানার এক বন্ধু শান্তিনিকেতন ঘুরে এসেছে। সেই বন্ধু ফেসবুকে বেশ কয়েকটি ছবি ছেড়েছে। সেই ছবি দেখে শান্তিনিকেতন সম্পর্কে কিছু বোঝার চেষ্টা করেছে রানা। কিন্তু সে বোঝাটা ছিল নিতান্তই সামান্য। শান্তিনিকেতন নিয়ে রানার কল্পনা জগত ক্ষুদ্র ছিল না। অনেক কিছু ভাবতো সে। ইতিপূর্বেও রানা দেশ থেকে ভারতে এসেছে কয়েকবার, কিন্তু বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কোলকাতার জোড়াসাঁকোর বাড়িতে গেলেও শান্তিনিকেতনে যাওয়া হয়নি। ফলে এবার সে আর মিস করতে চায় না। সকাল ৭-২০ মিনিটে ট্রেন। শিয়ালদহ রেলওয়ে স্টেশন থেকে ট্রেনটি ছেড়ে যাবে। কোলকাতা শহরে এমনিতে কোন রিকসা নেই। টাক্সি রয়েছে কিন্তু ভাড়াটা বেশি। আঁধারের রেশ কাটতে না কাটতেই রানা বের হয়ে গেল। কোলকাতা শহরের মৌলালী মোড় থেকে ২০-২৫ মিনিটের রাস্তা। রাস্তার বামদিক দিয়ে হাঁটছে রানা। দুই/একটা যাত্রীবাহী বাস যাতায়াত শুরু করেছে সবেমাত্র। রাস্তায় লোকজন তখনও নামেনি। তবে কিছু কুলি মজুরকে দেখা যাচ্ছে। ঠেলাগাড়ীতে করে তারা মালামাল বহন করে নিয়ে চলেছে। রাস্তার পাশের তেলপাম্পের সামনে কিছু ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে আছে। তারা পেট্রোলের জন্য অপেক্ষা করছে। তেল পাম্প পার হয়ে ডান দিকের গলির সামনে দাঁড়িয়ে আছে আরো কয়েকটি ট্যাক্সি গাড়ী। গাড়ীগুলো ধোয়া- মোছা চলছে। কয়েকজন বালককে দেখা গেল তারা বগলের মধ্য করে পত্রিকা নিয়ে রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। পত্রিকা বিক্রির তখনও তাড়া তাদের মধ্যে নেই। হয়তো বিক্রির তাগিদ আর কিছুক্ষণের মধ্যেই শুরু হবে। রানা হাঁটতে হাঁটতে শিয়ালদহ স্টেশনে পৌঁছে গেল। অনুসন্ধানের সামনে যেতেই দেখে লম্বা লাইন দিয়ে যাত্রীরা টিকেট কিনছে। রানার অন্য সাথীরা ইতোমধ্যে স্টেশনে পৌঁছে টিকেট কাটতে লাইন ধরেছে। টিকেট কাটার পর রানা ট্রেনের দিকে যেতে চাইলো। সঙ্গের সাথীরা ট্রেনের দিকে না গিয়ে হোটেলে গেল নাস্তা করতে। একসাথে নাস্তা সেরে তারা ট্রেনের দিকে ছুটলো। ট্রেনের কাছে গিয়ে দেখে কোন সিট আর ফাঁকা নেই। অনেক খোঁজাখুজি করেও কোন সিট পাওয়া গেল না। গত্যান্তর না দেখে রানা ও তার সাথীরা মালগাড়ীর কামরায় উঠে পেপার পেতে বসে পড়লো। রানাদের দেখাদেখি আরো কয়েকটি পরিবার মালগাড়ীর কামরায় গিয়ে উঠে বসলো। কয়েক মিনিটের মধ্যে কামরার অন্যান্য যাত্রীদের সাথে রানাদের পরিচয় হয়ে গেল। তারপরে শুরু হলো গল্প আর আড্ডা। আড্ডার সাথে নারী স্বাধীনতার বিষয়টি নিয়ে দীর্ঘসময় ধরে আলোচনা চললো। ইতোমধ্যে মালগাড়ীর কামরা যাত্রীদের আগমনে পরিপূর্ণ হয়ে গেল। কে যেন একজন মালগাড়ীর দরজাটা টেনে বন্ধ করে দিলো যাতে আর কোন যাত্রী এই কামরায় না আসতে পারে। হুইসেল বাজার সাথে সাথে ট্রেন ছেড়ে দিল। কামরার দরজাটা এমনি এমনি খুলে গেল। এবারে চোখ যতদূর যায় শুধু হলুদের সমারোহ। মাঠের পর মাঠ সরিষা গাছ। হলুদ রঙে ছেয়ে গেছে মাঠ। মাঠের দু’এক জায়গায় কিছু গরু দেখা যাচ্ছে। মাঠে চরে বেড়াচ্ছে। শিয়ালদহ স্টেশন থেকে দমদম তারপর বিধাননগর স্টেশন। তারপর ছুটেচলা ট্রেনের। স্টেশনগুলোতে ট্রেন থামছে তবে ১০ মিনিটের মত। এই থামছে এই চলছে। যে কারণে যাত্রীদের দূর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে না। সামনে একটি নদী, নদীর উপর ব্রীজ। ্নদীটি বেশ বড় নদী মনে হচ্ছে। জিজ্ঞাসা করতেই পাশের যাত্রী জানালেন গঙ্গা নদী। ভারতে গঙ্গা নামে পরিচিত হলেও বাংলাদেশে পদ্মা নদী নামে পরিচিত। রানা ট্রেন থেকে একটু তাকিয়ে দেখলেন পানিতে ভরপুর নদী। নদীতে স্রোত বইয়ে যাচ্ছে। পাশের যাত্রী আরো জানালেন গঙ্গার পানি এমনই থাকে, কখনো শুকোয় না। রানার মনে পড়ে গেল তার বাড়ির পাশ দিয়ে বইয়ে যাওয়া পদ্মাতে তখন আর পানি থাকে না। বর্ষাকালে পদ্মায় একটু যৌবন দেখা দিলেও ভাদ্র মাস থেকে নদী আবার শুকিয়ে যায়। ভারত ফারাক্কা বাঁধ দিয়ে পদ্মার পানিকে আটকে দিয়েছে। জোবরদস্তি করে এই পানি নিজের দেশের শাখা-প্রশাখা নদীতে ছড়িয়ে দিয়েছে। এই পানি দিয়ে ফসল উৎপাদন করছে। অপরদিকে শুকিয়ে মারছে বাংলাদেশকে। ফারাক্কা বাঁধের ফলেই বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চল আজ মরু ভূমিতে রূপ নিয়েছে। জীববৈচিত্র মারা যাচ্ছে। ফসল উৎপাদন কমে গেছে।কুষ্ঠিয়ার ভেড়ামারার জিকে প্রজেক্ট পদ্মার পানির অভাবে মাঝে মধ্যে বন্ধ হয়ে যায়। রানার মনের মধ্যে এসব বিষয়গুলো বারবার খেলা করছে। সেই সাথে ভারতের এই বিমাতাসূলভ আচরণে ক্ষুব্ধ হচ্ছে রানা।
এদিকে দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলেছে ট্রেন। রানাঘাট, কৃষ্ণনগর, ব্যান্ডেল পার হয়ে বর্ধমানের দিকে ছুটে চলেছে ট্রেন। চারিদিকে মাঠ আর মাঠ। মাঠের পরে দেখা যাচ্ছে গ্রাম। এ যেন বাংলার শ্যামল রূপ। কামরায় অবস্থানকারী যাত্রীরা অনেকটা নিশ্চুপ। এতোক্ষণ তারা নানা বিষয় নিয়ে আড্ডায় মেতেছিল। সেই আড্ডাও থেমে গেছে। সবাই অপেক্ষা করছে কখন অজয়নদীর দেখা মিলবে। অজয়নদীর পরেই সেই প্রত্যাশিত বোলপুর শান্তিনিকেতন। ইতোমধ্যে যাত্রীরা সবকিছুই গুছিয়ে নিতে শুরু করেছে। কেউ কউ আয়না সামনে রেখে চুলগুলো ঠিকঠাক করে নিচ্ছে। মেয়ে যাত্রীরা নতুন করে ঠোঁটে লিপিস্টিক মাখিয়ে নিচ্ছে। অবশেষে সেই কাক্সিক্ষত বোলপুর স্টেশনে ট্রেন পৌঁছার পর হাজার হাজার যাত্রী ট্রেন থেকে নেমে গেল। এই স্টেশনে এসে ট্রেন অনেকটা ফাঁকা হয়ে গেল। রানা তার পরিচিত শান্তি নিকেতনের এক ছাত্রকে হোটেল বুক দেওয়া কথা বলেছিল। কিন্তু সে আগেই জানিয়েছিল শান্তিনিকেতনে পৌষমেলা চলার কারণে লজ, হোটেলে কোন জায়গা নেই।
স্টেশনের সিঁড়ি থেকে নামার পর পরই দেখা গেল শান্তিনিকেতনে যাওয়ার জন্য কোন অটো পাওয়া যাচ্ছে না। দু’একটি যা পাওয়া গেল ট্রেন যাত্রীরা যে যার মত অটো নিয়ে রওনা দিল শান্তিনিকেতনের দিকে। বোলপুর স্টেশন থেকে শান্তিনিকেতনের দূরত্ব মাত্র ৩/৪ কিলোমিটার হবে। অটোতে ১০ টাকা ভাড়ার জায়গায় চালকরা ৫০ টাকা দাবী করছে। যাত্রীরা চালকদের দাবী মেনেও হাতের কাছে অটো পাচ্ছে না। ফলে অনেক যাত্রীকে দেখা গেল হেটে হেটে শান্তিনিকেতনের দিকে রওনা দিতে। রানা ও তার অপর তিনজন সাথী জনপ্রতি ৫০ টাকা ভাড়া দিয়ে একটি অটো নিয়ে রওনা দিলো। রাস্তায় বারবার জ্যামে পড়ছে অটো। জ্যাম অতিক্রম করতে বেশ সময় লাগছে অটোর। ট্রাফিক পুলিশকে হিমশিম খেতে হচ্ছে জ্যাম ছাড়াতে। পুলিশ কখনো কখনো লঠি দিয়ে দ্রিম দ্রিম করে আঘাত হানছে অটোর উপর। বিপরীত দিক থেকে আসা কয়েকটি মটর সাইকেল চোখে পড়লো রানার। মটর সাইকেল চালক মেয়েরা। রানা জানে ভারতে মেয়েরা সাইকেল, মটর সাইকেল চালায়। ফলে এ নিয়ে সে বেশী অবাক হয়নি। অবাক যা হয়েছে তা রানার সাথীরা। তারাতো এর আগে কখনো ভারতে আসেনি। এই প্রথম দেশ ছেড়ে অন্য দেশে আসা। ফলে তাদের কাছে এসব নতুন কিছু মনে হতে পারে। তবে মেয়ে চালকদের দিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকা যে ভদ্রতা নয় তা তারা জানে। পুলিশি তৎপরতায় জ্যাম কেটে গেল। কিছুদূর যেতেই রানার চোখে পড়লো আকাশবানী কোলকাতার অফিস। আকাশ বানী কোলকাতার সাথে রানার পরিচয় ঘটে একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময়। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে আকাশ বাণী কোলকাতার খবর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রেরণা জোগাত। আকাশবাণী অফিস পার হয়েই রাস্তার বাম দিকে ফাঁকা জায়গায় অটো থেমে গেল। চালক রানাকে বললেন এখানে নেমে যান, সামনে শান্তিনিকেতন। রানা ও তার সাথীরা প্রশস্ত রাস্তা দিয়ে সামনে হাঁটতে লাগলেন। হাঁটার ফলে শুধু রানা বা তার সাথীরা নয়। এ কাফেলায় হাজার হাজার দর্শনার্থী। একদিকে শান্তি নিকেতনে পৌষমেলা অপরদিকে খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বীদের বড় দিনের উৎসব। সবকিছু একাকার হয়ে গেছে শান্তিনিকেতনে। কিছুদূর যেতেই রাস্তার ডান দিকে তাকালেই চোখে পড়ে দৃষ্টিনন্দন অট্টালিকা। প্রথমে রানার মনে হয়েছে এ বাড়ীগুলো নিকেতনের অংশ। কিন্তু স্থানীয় একজন ভদ্রলোক জানালেন এই বড় বড় অট্টালিকার মালিকরা দিল্লি বা দেশের বড় বড় শহরে বসবাস করেন। শান্তি নিকেতনে বড় কোন উৎসব হলে সেই উৎসব উপলক্ষে তারা এখানে আসেন। সপ্তাহখানেক এখানে থেকে আবার নিজ গৌন্তব্যস্থলেচলে যান। রাস্তার বাম দিকে প্রশস্ত মাঠে পৌষমেলা বসেছে। এতো বড় পৌষমেলা ভারতবর্ষের অন্য কোথাও হয়তো হয় না। এক সময় এই মেলা বছরের শেষে ২২ ডিসেম্বর থেকে ২৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত চলতো। কিন্তু দিন দিন চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় পৌষমেলা এখন আরো ৩ দিন বৃদ্ধি পেয়ে ২৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত চলে। এ মেলায় দেশ বিদেশ থেকে প্রতি বছর হাজার হাজার দর্শনার্থীর আগমন ঘটে।
বড় রাস্তা থেকে বাম দিকে টান নিতে হবে। ডান দিকে ছাত্র নিবাসকে পিছনে ফেলে সামনে এগিয়ে গেলে আরো একটি বড় রাস্তার সাথে মিলিত হয়েছে এই রাস্তাটি। একটু সামনে এগুলো চোখে পড়বে দৌহলী। বামদিকে মৃণালিনী ছাত্রী নিবাস। মাঝখান দিয়ে রাস্তা গিয়ে আম্রকুঞ্জের সামনে গিয়ে মিশেছে। এই আম্রকুঞ্জে বিভিন্ন অনুষ্ঠানমালা হয়। ১৯১৩ সালে গীতাঞ্জলী কাব্যে নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পর এখানেই কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে গণসংবর্ধনা দেওয়া হয়। সেদিন রেলওয়ের ট্রেন রিজার্ভ করে এই শান্তিনিকেতনে এসেছিল কোলকাতার কবি ভক্ত লোকজন। এখানে কবির উদ্যোগে শরৎচন্দ্র ও সুভাষচন্দ্র বসুকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়। ইন্দিরাগান্ধী ১৯৩৪ সালে এখানকার কলাবিভাগের ছাত্রী ছিলেন। ১৯৩৯ সালে জওহরুলাল নেহেরুকে কবি গুরুর উদ্যোগে সংবর্ধনা দেওয়া হয়।
আম্রকুঞ্জের সামনে এই শান্তি নিকেতনের মূলগৃহ। কথিত আছে মহির্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর হিমালয় থেকে বাড়ি ফেরার পথে রায়পুরের জমিদার সত্যেন্দ্্র প্রসন্ন সিংহের নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে এখানে আসেন। এখানে এসে ছাতিম গাছতলায় তিনি কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেন। এসময় তিনি স্বাচ্ছন্দবোধ করেন। পরবর্তীতে জমিদারের কাছ থেকে ষোলো আনার বিনিময়ে ২০ বিঘা জমি গ্রহণ করেন। এই জমির উপর কোলকাতার বাড়ির আদলে একটি গৃহ নির্মাণ করেন যার নামকরণ করেন শান্তিনিকেতন। এই শান্তিনিকেতন গৃহ থেকে আরো দক্ষিণে ব্রাহ্মধর্ম প্রচারের লক্ষ্যে একটি উপাসনালয় নির্মাণ করেন। উপসনালয়ের ডান দিকে ছাতিমতলা অবস্থিত। সেই ছাতিম গাছগুলো এখন আর নেই। তদস্থলে নতুন করে কয়েকটি ছাতিম গাছ রোপন করা হয়েছে। এই জায়গাটি দর্শকদের জন্য উন্মুক্ত রাখা হয়নি। বালক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বোলপুরে আসলে এই শান্তিনিকেতন গৃহে থাকতেন। ১৯০১ সাল থেকে কবি এখানে নিয়মিত থাকার ব্যবস্থা করেন। সেই সময় থেকে কবির জন্মোৎসব শান্তি নিকেতনে উদযাপিত হতে থাকে।
শান্তিনিকেতনের কলেবর বৃদ্ধিতে বেশ কয়েকজন বিদেশী গুণীব্যক্তি সক্রিয় ভূমিকা রেখেছেন। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য চার্লস ফিয়ার এন্ডুজ এবং লেনার্ড নাইট এলমহাস্ট। এন্ড্রজ ১৯১৪ সালে শান্তিনিকেতনে আসেন এবং শান্তিনিকেতনে সক্রিয়ভাবে কাজ করতে থাকেন। কাজ করতে গিয়ে সকলের সাথে তার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এজন্য লোকে তাকে দীনবন্ধু বলে ডাকতেন। ১৯৪০ সালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় কলকাতায় এন্ড্রজের মৃত্যু হয়। শান্তি নিকেতনের একটি হাসপাতালের নামকরণ করা হয় এন্ড্রজের নামে। অপরদিকে ১৯২০ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাথে আমেরিকায় ভ্রমণের সময় পরিচয় হয় লেনার্ড নাইট এলমহাস্টের সাথে। এলমহাস্টকে শান্তি নিকেতনে নিমন্ত্রণ জানালে এলমহাস্ট তা গ্রহণ করেন এবং শান্তি নিকেতনের কলেবর বৃদ্ধিতে সক্রিয়ভাবে কাজে নেমে পড়েন।
১৯২১ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবদ্দশায় বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। এ অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন শিক্ষাবিদ ব্রজেন্দ্রনাথ শীল। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মৃত্যুর পর ১৯৫১ সালে কবি পুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চেষ্টায় ও জহরুলাল নেহেরুর সহযোগিতায় শান্তি নিকেতন পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় রূপে আত্মপ্রকাশ করে। পন্ডিত জওহরুলাল বিশ্বভারতীর প্রথম আচার্য এবং কবি পুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর উপাচার্য পদে নির্বাচিত হয়ে কিছুদিন দায়িত্ব পালন করেন।
মহির্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৮৪৩ সালের ৭ই পৌষ বুধবার রামচন্দ্র বিদ্যাবাগীসের কাছে দীক্ষা গ্রহণ করেন। সেই দিনটিকে বিশেষভাবে স্মরণ রাখতে প্রতি বছর এই সময়ে পৌষ মেলার আয়োজন করা হয়। ৭ই পৌষ থেকে ৯ই পৌষ অর্থাৎ ২২ শে ডিসেম্বর থেকে ২৪শে ডিসেম্বর এই তিনদিন পৌষ মেলা চলে। বর্তমানে এই মেলার গুরুত্বের কথা বিবেচনা করে মেলার সময়সীমা বৃদ্ধি করে ২৮ শে ডিসেম্বর পর্যন্ত বর্ধিত করা হয়েছে। মেলাতে প্রতিদিন ভাটিয়ালী, জারী, লালনগীতি গানের পসরা বসে। এসময় পুরো ভারতবর্ষ থেকে গানের শিল্পীরা এখানে সমবেত হয়। মেলায় নিত্য প্রয়োজনীয় অনেক পণ্য বেচাকেনা হয়। মেলা দেখতে দেশ-বিদেশের অনেক গুণি মানুষের আগমন ঘটে। শান্তিনিকেতনের মত এতো বড় পরিসরের মেলা ভারতবর্ষের আর কোথাও হয় কিনা তা জানা নেই।
রানা যেদিকে তাকায় তার চোখে ভেসে আসে সবুজ গাছের সমারোহ। শান্তি নিকেতনের এই মাটিতে ১৮২৮ এর ১৫ জুলাই থেকে বৃক্ষরোপণ অভিযান শুরু হয়। এই অভিযান এখনও অব্যাহত আছে। তবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মৃত্যু দিবস ২২ শে শ্রাবনকে স্মরণীয় করে রাখতে এই দিবসে বিকাল ৩-৩০ মিনিট থেকে বৃক্ষরোপণ শুরু করে সন্ধ্যা পর্যন্ত চলে। এই বৃক্ষরোপণে বিশ্বভারতীয় ছাত্র-ছাত্রীরা থেকে শুরু করে শিক্ষকরা অংশগ্রহণ করে। শান্তি নিকেতনে দর্শকদের কাছে আকর্ষনীয় স্থান হচ্ছে রবীন্দ্র মিউজিয়াম। গুরুদেবের ব্যবহৃত গাড়ীসহ নিত্য ব্যবহৃত অনেক জিনিস এখানে রক্ষিত হয়েছে। ফলে রবীন্দ্রভক্ত মানুষের কাছে এই ভবনটির আকর্ষণ অনেক বেশি। রবীন্দ্র মিউজিয়াম না দেখে শান্তি নিকেতন থেকে কেও ফিরে না। মিউজিয়ামের প্রবেশ মূল্য সাধারণের জন্য ৪০/- টাকা, শিক্ষার্থীদের জন্য ১০/- টাকা এবং বিদেশীদের জন্য ১০০/- টাকা।
শান্তি নিকেতনে বাংলা নববর্ষ উদযাপন হয় বেশ ঢাক-ঢোল পিটিয়ে। এ উৎসবটি পালিত হয় উত্তর পশ্চিম পাঠ ভবনের মাঝখানের বিশাল মাঠে। এ উপলক্ষে একটিস্থায়ী মঞ্চও এখানে নির্মাণ করা হয়েছে। শান্তিনিকেতনের ছাত্র-ছাত্রী ও শিক্ষকরা দিনব্যাপী হৈ-হুল্লোড় করে বাংলা নববর্ষ উদযাপন করে। এ উৎসবে সকল ধর্মের মানুষ আনন্দ চিত্তে অংশগ্রহণ করে। ফলে এদিন পুরো মাঠ দর্শকে ভরপুর থাকে।
রানা ও তার সাথীদের এবার ফেরার পালা। ফিরতে গিয়ে পৌষমেলার ভেতরে প্রবেশ করে। কয়েক হাজার স্টল রয়েছে এখানে। ষ্টলগুলো শ্রেণী বিন্যাস করা হয়েছে বিভিন্ন পণ্যের গুরুত্ব বিবেচনা করে। ষ্টলের উত্তর দিকে সারি সারি খাওয়ার হোটেল। রানা ও তার সাথীরা একটি হোটেলে প্রবেশ করে। হোটেলের মালিকের শ্বশুরবাড়ি বাংলাদেশে। ফলে হোটেল মালিকের কাছে রানাদের গুরুত্ব একটু বেশীই মনে হলো। খাওয়া-দাওয়া শেষ করে রানা ও তার সাথীরা মেলার স্টলগুলো দেখে নিলো। তারপর ফিরে আসার পালা। পিছনে রবীন্দ্র স্মৃতির বিশাল ভান্ডার।
লেখক : প্রগতিশীল সংস্কৃতি কর্মী।