খুঁজে ফিরি
সুজিত কুমার দাস
তোমার মনে পরে,
স্কুলের বারান্দায় দাঁড়িয়ে তুমি আমার দিকে চেয়ে হেসেছিলে
আর আমি শুধু দেখেছিলাম।
সেটাই ছিলো আমার অপরাধ।
তোমার হাসির শব্দে আমাদের গনিতের স্যার বুঝেছিলেন,
তুমি আমাকে নিয়ে হেসেছিলে।
অপরাধের দন্ড হিসাবে আমাকে একশ বার কান ধরে উঠ-বস করার শাস্তি দেওয়া হয়েছিলো।
আমি কোনো অপরাধ করিনি,
একথা বলার সাহস হয়নি কিন্তু অপরাধ না করে শাস্তি পাবার জন্য মনের মধ্যে কেমন যেন অব্যক্ত এক অহংকারের জন্ম হয়েছিলো।
তাই দৃঢ় চিত্তে মাটির দিকে তাকিয়ে,
শুরু করলাম কান ধরে উঠা বসা।
অহংকার গুলো জল হয়ে গলে গলে পড়তে লাগলো দু’চোখ বেয়ে।
সারা স্কুলে রটে গেলো আমার অপরাধের সংবাদ।
কারো মুখের দিকে তাকিয়ে কথা বলার সাহসটাই যেনো হারিয়ে গেলো।
পরদিন স্যার আবার আমাকে ডেক নিয়ে বললেন,
তুমি কৃষকের ছেলে এসবে মন দিও না।
তোমার বাবা অনেক কষ্টে তোমাকে পড়াচ্ছেন।
বাবা-মায়ের কথা একটু ভাবো।
তাদের সন্মানের কথা একটু চিন্তা করো।
বুকের মাঝে জমে থাকা বাবা-মায়ের কষ্ট গুলো দু’চোখের উপর বাষ্প জমিয়ে দিলো।
মায়ের ছেড়া ময়লা শাড়ি, বাবার কর্দমাক্ত ঘামে ভেজা দেহ দু’চোখে জমা বাষ্পের উপর চকচক করতে লাগলো।
আমি স্যারের পা জড়িয়ে ধরলাম।
অপরাধ করিনি তবুও ভেজা কন্ঠ দিয়ে বেরিয়ে এলো, আমার ভুল হয়েছে স্যার।
শাস্তি পেলাম, উপদেশ পেলাম
তবুও মনের মধ্যে কেন জানি না
তোমার জন্য একটু ভালোলাগা তৈরি হলো।
স্কুলে এসেই জানতে ইচ্ছা করতো,
তুমি এসেছো কি না?
তোমার চোখের দিকে চোখ তুলে তাকাবার সাহস হতো না কিন্তু কান পেতে থাকতাম,
তোমার পায়ের শব্দ কখন শুনতে পাবো সেই আশায়।
তুমি যখন সামনে দিয়ে যেতে
তোমার মুখের ছবি বুকে আঁকতাম,
আর তোমার পা দুটি চেয়ে চেয়ে দেখতাম।
তোমার সাথে যেদিন শেষ দেখা হয়েছিলো,
সেদিন তোমার পায়ের শব্দ আমার কাছে অচেনা মনে হয়েছিলো।
তবু পা দেখে চিনেছিলাম।
তুমি চলতি পথে পাশে এসে দাঁড়িয়ে বলেছিলে,
কাল আমি চলে যাচ্ছি,
আর দেখা হবে না।
ইচ্ছা করছিলো তোমার দু’চোখে দু’চোখ রেখে জিজ্ঞাস করি,
কোথায় যাচ্ছ?
কেন যাচ্ছ?
আবার কবে দেখা হবে?
কিন্তু আমি পারলাম না।
মনে হলো ঘাড়টা যেন শক্ত হয়ে আছে।
তুমি হেঁটে চলে গেলে।
কিছুক্ষণ পর ঘাড়টা সচল মনে হলে চোখ তুলে তাকালাম সামনের দিকে।
দেখলাম তুমি হাতের পিঠে চোখ মুছতে মুছতে তোমার আমার মাঝের ভৌগলিক দূরত্ব বাড়িয়ে যাচ্ছ।
আমি আজও খুঁজে ফিরি
নিজের অজান্তে মনের অলি-গলি, রাজপথে
সেই বুকে ধরে রাখা মুখ আর চোখের সামনে দেখা সেই পদযুগল।
আর খুঁজে ফিরি সেই ভালোবাসা যা সেদিন বুঝতেই পারিনি।