প্রথম স্পর্শ
নাসরিন আক্তার
নভেম্বরের মাঝামাঝি অল্প অল্প শীত পড়েছে আবার ঝিরিঝিরি বৃষ্টি সেই সন্ধ্যা থেকে, রাতটাকে যেনো আটকে নিয়েছে ওমের মায়াজালে, চারিদিকে শুনশান নিরবতা। তাই মনে হলো আজই উপযুক্ত সময়। ক’দিন যাবত ভাবনাটা মাথার ভিতর কটকুট করছে, এ খেলাটা এখানেই শেষ হওয়া দরকার, দিন দিন ব্যাকরণ বইএর পেটটা মোটা হয়েই যাচ্ছে । প্রতি রাতেই একটা করে চিঠি জানালা দিয়ে টেবিলে এসে পড়ে, এক দুই তিন করে, আট-দশটা আসার পর থেকেই একটা অস্থিরতা ও আতংক কাজ করছে। এই হয়তো চিঠি আসবে আবার চিঠি আসার পর সেটা পড়া ও লুকানো সব মিলিয়ে একটা যাচ্ছেতাই অবস্থা আমার। না আমি আর এর ভিতর নেই যা হয় আজই একটা হেস্তনেস্ত করবো। সরাসরি বলে দিবো আমি এর মাঝে নেই। তাই কচি মাথায় নয়-ছয় না ভেবে বিপদের আশংকা না করেই বেরিয়ে পরলাম।
গল্পটা আর একটু পিছন থেকে বলি ।আমি তখন ক্লাশ নাইনের ছাত্রী । সামনে বার্ষিক পরীক্ষা, রাত জেগে পড়ি। জানালা খোলা রাখা অভ্যাস। বন্ধ করলে দম বন্ধ, দম বন্ধ লাগে। রাত যত গভির হয় রাতকে ততই আপন মনে হয়, তাই রাতের সাথে গভীর মিতালী। জানালা কৌনিক বরাবর জোনাক পোকার মত ছোট একটা আলো প্রতিদিন জ্বলে জ্বলে নিজেকে পোড়ায়,সেই সাথে ২২/২৩ বছরের এক তরুণ ধোয়া টেনেটেনে নিজের ফুসফুস ভারি করে। কথাটা আমি জানতাম না কারণ বরাবরই আমি একটু বোকা। একদিন চঠিতে নিজেই লিখলো জানালাটা বন্ধ করো না, তোমায় দেখতে পাইনি কাল। ঠিক তার পরদিন থেকেই জানালাটা বন্ধ করে ফেলি। তবুও প্রতিদিন চিঠি আসে, দাদার আমলের কারুকাজ করা টিনের ভেন্টিলেশনের ফাঁক গলে। এক একদিন দু তিন পাতার চিঠি – নিজের বালক বেলার কথা, নিজের প্রথম প্রেম ও তা হারানোর কথা, মাকে হারানো ও সৎ মায়ের সংসারে দুঃখ কস্টের কথা, আরো কতশত কথা লিখা থাকতো তাতে । প্রতিদিন সে সব পড়তে পড়তে আমার বয়সি যে কোন মেয়ে প্রেমে পড়ে যাওয়ার কথা, কিন্ত আমার ভিতর কেনো জানি না প্রেম জাগেনি যেটুকু জেগেছিলো তা ছিলো একটা মায়া!, নয়তো এমন পাগলামো চিন্তা মাথায় এলো কেনো ?!
রাত বারোটা, গ্রামে বারোটা মানে গভীর রাত। মাঝে মাঝে বুড়োবুড়ির খুক খুক কাশির আওয়াজ ছাড়া কোন শব্দ নেই। নেড়ি কিকুর গুলোও লেজগুটিয়ে ওম নিচ্ছে খড়ের গাদায়। মাথায় ওড়না প্যাচিয়ে বেরিয়ে পড়লাম ওর সাথে কথা বলতে। রাতটা কোনো বেছে নিয়েছিলাম জানো? প্রথমত একটা বয়সের পর সরকার বাড়ির মেয়েদের কাচারি ঘরে যাওয়া বারণ, দ্বিতীয়ত লজিং মাষ্টারদের ভিতর বাড়িতে আসাও বারণ । কিন্তু আমি ডেকে এনে যে কথা বলবো সে সাহস ছিলো না তখন । আবার চিঠির বিষয়টা বাড়িতে জানা জানি হলে ওর এই বাড়িতে আর থাকা হবে না। আমি বেচারার এত বড় ক্ষতি হোক তা চাই নি।
জানলা দিয়ে দেখে নিলাম কাচারি ঘরে হ্যারিকেনের আলো মিটনিট জ্বলছে। বিশ্বাস ছিলো যেহেতু আমার জানালায় আলো তাই সেও জেগে। যখন কাচারি ঘরের দরজায় গিয়ে দাঁড়ালাম ভুত দেখার মত চমকে লাফ দিয়ে নামলো বিছানা থেকে। ঠোঁটের ফাঁকে আধখাওয়া সিগারেটটা ফেলে দিলো থু দিয়ে। আলনা থেকে গামছাটা টেনে নেজের উদাম শরীরটা ঢেকে নিলো। এরপর আমার হাত ধরে টানতে টানতে বাড়ির ভিতর নিয়ে এলো। গ্রামের বাড়ির রান্না ঘরগুলো শোয়ার ঘর থেকে কিছুটা দূরে হয় । রান্না ঘরের শিকল খুলে ভিতরে ঢুকলো দরজা খোলা রেখেই দরজার এক একপাশে হেলাম দিয়ে চুপকরে দাঁড়িয়ে মুচকি মুকচি হাসতে লাগলো। আমার শরীরটা রাগে আর ভয়ে কেঁপে কেঁপে উঠছিলো। আমাকে বললো –
এভাবে,এতরাতে কাচারি ঘরে আসতে আছে কেউ যদি দেখে নিতো?! এবার বলো কি বলবে?
আমি মিন মিন করে বললাম, আসলে আমি আপনাকে ভালোবাসি না। আমাকে আর চিঠি দিবেন না। সে কি ভাবলো বুঝিনি তখন এতশত বুঝতাম না, প্রেম বা ভালোবাসা কি? এটা পেলে কি সুখ বা না পেলে কি অসুখ। শুধু বুঝতাম এ আমার দ্বারা হবে না। হয়তো তখনো মনটাই নাবালেগ ছিলো।
সে তার নিজের অনেক কথা বললো, বুঝাতে চাইলো, চিঠিতে লিখা কথাগুলো পুনরাবৃত্তি করলো। কিছুতেই আমার কিছু হলো না আমি মাথা নেড়ে শুধু একটা কথাই বলতে লাগলাম আমি এসবে নেই। তবে একটু একটু মায়া হচ্ছিলো ওর জন্য। ও আমার ডানহাতটা ধরলো, ভয়ে না কেনো জানি না শরীরে কাঁটা দিলো। সে হাতটা টেনে নিয়ে তার উদাম বুকে রাখলো বললো – বুঝতে পারছো কিছু?
সত্যিই আমি কিছু বুঝলাম না । শুধু বললাম আপনি বাড়িতে প্রস্তাব দিন, বাড়িতে যদি বিয়েতে রাজি থাকে তাহলে,,,, আব্বা আম্মার ইচ্ছেই আমার ইচ্ছে । লোকটা একটু করুন হাসি দিয়ে বললো
-আমি তো ছাত্র , আমার কাছে তোমার বাবা তোমাকে দিবেন কেন?
– আপনি প্রতিষ্ঠিতো হয়ে আসুন!
– ততদিনে তুমি আমার জন্য অপেক্ষা করবে?
– আমি জানি না, আব্বা আম্মা যা বলবে তাই হবে।
ছেলেটা একটু কেমন করে যেনো বললো –আমি প্রস্তাব দিলে তোমার বাবা আমার কাছে তোমাকে দিবে না। জানতো বড় বড় রুই কাতল মাছ গুলো বড় বড় লোকেরাই খায়। গরিবরা তার কাটাকুটুও পায় না।
কথাটা শুনে আমার রাগ হলো। একটু রেগেই বললাম
-তাহলে আমি কি করতে পারি। আমি আপনাকে কোন কথাই দিবো না।
বলে জোড় করে ডান হাতটা ছাড়িয়ে নিতে চাইলাম, সে আরো শক্ত করে ধরে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আঙ্গুল গুলো নাড়াচাড়া করতে লাগলো। তখন কেমন যেনো ভয় ভয় হতে লাগলো। মনে হলো খুব ভুল হয়ে গেছে, এভাবে আসাটা একদমই ঠিক করিনি। হাঠাৎ আব্বা ঘুম থেকে জেগে কেশে উঠলেন।আমি হাতটা ছাড়িয়ে জোড় পায়ে শোয়ার ঘরের দিকে চলে এলেম আসতে আসতে পিছন ফিরে তাকালাম, তখনি হঠাৎ বিদুৎ চমকালো সেই আলোতে দেখতে পেলাম ছেলেটা তখনো রান্না ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে তাকিয়ে আছে।মনের ভুল কি না জানি না, মনে হলো চোখ ভেজা। আমি ঘরে ঢুকে দরোজা বন্ধ করে দিলাম। এরপর, একজন পুরুষের স্পর্শ করা হাত নিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লাম । সে স্পর্শে ভালোবাসা বা ঘৃনা কোনটারই অনুভূতি আসেনি ।