ভারত থেকে সভ্যতার অন্যতম লেখক- অগ্নিমিতা দাসের ভিন্নধর্মী গল্প“নীরব উৎস্বর্গ”

607
অগ্নিমিতা দাসের ভিন্ন ধর্মী গল্প “নীরব উৎস্বর্গ ”

নীরব উৎস্বর্গ
অগ্নিমিতা দাস।

আরিষা চুপিচুপি ওর শোওয়ার ঘরের দরজা বন্ধ করে আলমারী থেকে বাক্সটা বার করলো। বাক্সটা যেন সুগন্ধি গন্ধে মৌ মৌ করছে। গন্ধটা আতরের। আতরমাখা রুমাল আছে ওই বাক্সে। বাক্স খুলেই চট করে রুমালটা সরিয়ে দিয়ে ওর ভেতর থেকে মখমলের ভেতরে রাখা দুজোড়া সোনার বালা আর দুটো জড়োয়ার দুল আর হার বার করলো। প্রায় এটা আরিষা বার করে দেখে। আব্বার হাতের ছোঁয়া যেন লেগে রয়েছে ওই গয়নাগুলোতে। আরিষা হাত দিয়ে চোখ বন্ধ করে ওই গয়নাগুলোকে স্পর্শ করে যেন ওর মৃত বাবাকে অনুভব করতে চাইলো। আব্বা আরিষাকে খুব ভালোবাসতো। আব্বার রেখে যাওয়া আরিষার বিয়ের জন্য শেষ সম্বলের মধ্যে ও আব্বার আতরমাখা রুমালটা দিয়ে মুড়িয়ে রাখে।এটা ওদের ভাগের ঘর। মা মেয়েতে থাকে। বিশাল দালানের এক এক অংশে অন্য শরীকদের বাড়ি। আব্বাদের এককালে জমিদারি ছিল। এখন জল তলানিতে ঠেকেছে। বোলবোলওয়ালা চলে গেলে ও বিশাল প্রাসাদটুকু দাঁত মুখ খিঁচিয়ে বার করে রয়েছে। আরিষার আব্বা আর চাচার কাকার কাপড়ের ব্যাবসা ছিল, হঠাৎ আব্বার ইন্তেকাল হয়ে যাওয়ায় ব্যাবসা ওর চাচাজানের হাতে চলে আসে। নামমাত্র কিছু টাকা রাফিয়া বেগমের হাতে ধরিয়ে দিয়ে ওর চাচা পুরো ব্যাবসা নিজের নামে করে নেয়। রাফিয়া বেগম আর আরিষা এই দালানের এই ঘরটাতে থাকে। নীচের ভাগের ঘরে মা _ মেয়ের হেঁসেল। আরিষার মা সেলাই করে সংসার চালায়। আরিষার এখন ষোলো ছুঁই ছুঁই বয়স। অভাবের জন্য লেখাপড়া বন্ধ। মেয়ে বড় হচ্ছে , মাথার ওপর ছাতা নেই তাই রাফিয়া মেয়ের স্কুল বন্ধ করে দেয়। নাহলে সরকারি স্কুলে দিব্যি চালানো যেতো। এই বাড়ির অন্য শরীকদের বাড়ির মেয়েরা গাড়ি চেপে ইংরেজি মিডিয়াম স্কুলে যায়, তখন পর্দা থাকে না। যত পর্দা যত আব্রু এই বাপ মরা মেয়ের ওপর। রাফিয়া মনের রাগ মনে পুষে আরিষার পাত্রের সন্ধান করতে থাকে। আরিষার এই বদ্ধ মহলে দমবন্ধ লাগে। ও বিকেল হলেই ওর ছোটবেলার বন্ধু রিয়ার বাড়ি যায়। এই পাড়া পেরিয়ে বড় রাস্তার মুখের প্রথম বাড়িটাই মুখার্জিদের। ওই বাড়িতে গেলে যেন আরিষা প্রাণ পায়। রিয়া এখন ও স্কুলের উঁচু ক্লাসে পড়ে। ওর কাছ থেকে বন্ধুদের খবর পায়, কত কথা জানতে পারে। সন্ধ্যাবেলায় কাকিমা যখন তুলসীতলায় প্রদীপ জ্বালিয়ে শাঁখ বাজায়। তখন দুই বন্ধু ছাত থেকে নামে। কাকিমা আরিষাকে না খাইয়ে ছাড়েন না। কখনো ফুলকো লুচি, কখনো নারকেল দিয়ে মুড়ি মাখা। সন্ধ্যাবেলা বাড়ি ফিরলে ওদের বাড়ির অনেকের অনেক বাঁকা দৃষ্টি ও হজম করে। রবিবার বা অন্য কোন ছুটির দিন রিয়াদের বাড়িতে আরিষা সারাদিন থাকে। আরিষা ও ঈদের দিন রিয়া আর ওর দিদি দিয়াকে নেমতন্ন করে। ফেরার পথে ওর আম্মী নিজের হাতে বানানো সেমাই, বিরিয়ানি, রুটি বাড়ির জন্য দিয়ে দেয়। আরিষা একদিন সন্ধ্যার পর দিয়াদের ঘর থেকে ফেরার পর দোতলায় ওদের ঘর থেকে রুবেলা ফুপুর চাপা স্বর শুনতে পেলো_ সেধে আসা ধনকে পায়ে ঠেলে দিচ্ছিস। বুঝবি পরে! ভালো বংশ, ভালো কারবার, তোর মেয়ের আর কি চাই? রাফিয়া দৃঢ় গলায় বলে উঠলো তা বলে বেশি বয়সের দোজবরের সাথে বিয়ের কথা ভাবতে পারছি না আপা। আমার আরিষা দেখতে শুনতে সুন্দর, কাজের। ওর বাপ নেই বলে ওকে তো হাত পা বেঁধে জলে ফেলে দিতে পারি না।আরিষা ঠিক সেই সময়ে ঘরে ঢুকতেই রুবেলা ফুপু বিছানা থেকে উঠে ওর দিকে তাকিয়ে কেটে কেটে বললো তা কেন দিবি? ধিঙ্গিপানা করে পাড়ায় পাড়ায় ঘোরা হবে না যে? আমার আর কি? ভাইজান নেই তাই বলা। আজকাল নেকির কোন দাম নেই। ফুপু চলে যেতেই রাফিয়া আরিষাকে জড়িয়ে ধরে ডুকরে কেঁদে উঠলো। আরিষার মায়ের ঘামেভেজা শাড়ির সাথে নিজেকে মিশিয়ে রাখতে ভালো লাগছিলো। করোনার জন্য সবাই ঘরবন্দী। মায়ের কাজ নেই। মানুষ খেতে পাচ্ছে না আবার নতুন জামা সেলাই করাবে কোথা থেকে। মা মেয়েতে ঠোঙা বানিয়ে দিন কাটছিলো। বহুদিন পর আজ আরিষা রিয়াদের বাড়ি এসেছে। পরিস্থিতি একটু ভালো হয়েছে তাই মা টুকটাক সেলাইয়ের কাজ পাচ্ছে। রিয়াদের বাড়িতে আজ খুশির মেজাজ। দিয়াদিকে পাত্রপক্ষ দেখতে এসে, বিয়ের কথা পাকা করে গেছে। দিয়াদি ভারি সুন্দরী আর কলেজে পড়ে। পাত্রপক্ষের না খাওয়া সিঙ্গারা আর মিষ্টি খেতে খেতে দিয়াদিকে রিয়া আর আরিষা রাগাচ্ছিলো। ট্রেতে কাপ প্লেটগুলো গুছিয়ে আরিষা রান্নাঘরে রাখতে যেতে যেতে পেছন থেকে দিয়ার ডাক শুনলো চট করে রেখে চলে আয়। অনেক কথা জমে আছে। রাতে খেয়ে ঘরে যাবি। সত্যি তো কতদিন সামনাসামনি কথা হয় নি। মায়ের পুরনো মোবাইল থেকে আরিষা ওর সাথে কথা বলতো। রান্নাঘরের কাছে আসতেই কাকিমার কন্ঠস্বর ভেসে এলো_ কোন মুখে তুমি বিয়ের কথা শুনে ধেই ধেই করে নাচছো। ছেলের বাড়ি কিছু চাইছে না বলে, আমাদের তো মেয়েকে সাজিয়ে দিতে হবে। তাও তো এই রোগের জন্য নেমতন্নের খরচ থেকে বাঁচা ও। খাট আলমারি না দিই, মেয়েকে একটু গয়না পরিয়ে তো পাঠাতে হবে। কাকু মিনমিন করে বলে উঠলো উনারা শিক্ষিত উদার মনের মানুষ। ছেলে প্রফেসার, এইসব ছোটখাটো জিনিস নিয়ে মাথা ঘামানোর মতো মানসিকতা উনাদের নয়। তাছাড়া মিনু তোমার যা গয়না আছে তাতে দুই মেয়েকে দিয়ে ও বেঁচে যাবে। কাকিমা ফোঁস করে উঠলো আমার কপাল। একবছরের বেশি তোমার কোম্পানী বন্ধ। এই গয়নাগুলো বন্ধক দিয়েই তো এতদিন সংসার চলছে। হে ভগবান! এ কোন জগতে থাকে। আরিষা তাড়াতাড়ি বাইরেই কাপডিস রেখে দিয়াকে আসছি বলে বাড়ির দিকে দৌড় লাগালো। কাল বকরীদ তাই মা হেনাভাবীদের সেলাই করা সালোয়ারের সুটগুলো দিতে ওদের বাড়ি গেছে। ও তাড়াতাড়ি আলমারি থেকে বাক্সটা বার করে দরজা ভেজিয়ে রাস্তায় নামলো। সন্ধ্যা থেকেই বিদ্যুৎ চমকাচ্ছিল। গলির মুখটার কাছে আসতেই গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি নামলো। আরিষার কানে বাজছিলো ওর আরবি মাস্টারের গমগমে স্বর__ কুরবানী মানে কোন পশুকে কিনে এনে বলি দেওয়া নয়। তোমার সব থেকে প্রিয় , আদরের কোন বস্তুকে মায়া না করে আল্লাহুতালার কাছে উৎস্বর্গ করা। আরিষা কোনদিন আল্লাহাকে দেখে নি, কিন্তু তার কাছের মানুষগুলোর মুখে একটু হাসি ফোটাতে ও এই কুরবানী দিতে রাজি। হঠাৎ জোরে বৃষ্টি নামায় আরিষা ওড়না দিয়ে বাক্সটাকে চেপে দৌড়ে রাস্তা পার করলো। আরিষার চোখের বৃষ্টি ততক্ষণে বুকের কাছে ধরা আব্বার উত্তাপকে ভিজিয়ে দিচ্ছিল।
© অগ্নিমিতা দাস

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here