বাংলা সাহিত্যের অন্যতম সারথি লেখক ও প্রবন্ধকার হাসান আহমেদ চিশতীর বিশ্লেষণ ধর্মী ওগবেষণা লব্ধ লেখা “সাংস্কৃতিক জীবনবোধে কবিতার অনুসঙ্গ”

728

সাংস্কৃতিক জীবনবোধে কবিতার অনুসঙ্গ
–হাসান আহমেদ চিশতী–

কাব্য ভাবনা মূলত: সাংস্কৃতিক জীবন বোধেরই একান্ত অনুসঙ্গ। সভ্যতার আদিপর্বে কাব্যধারা ছিল জনজীবনের সঙ্গ ও সংস্কৃতি সৌন্দর্যের কলা এবং তার পরেই চিত্ত-বিত্তের বৃন্তে নির্মিত হয়েছে কলাকার। ইতিহাসের আদিপর্ব, মধ্যপর্ব কিংবা কলাকার নিয়ে বিস্তৃত কথা অনেক। তবে কবিতা ঐ সকল পরিক্রমা বলয়ের মধ্যমনি তো বটেই। কারণ প্রতিটি শিল্প বিকাশের অন্তরই পোয়েট্রিক সোল ((Poetic Soul)। সহজ কথা হলো কাব্য না থাকলে কলা হয় না। সুতরাং কবিতার সময়কাল নির্ধারিত করে দেয় কলা আর কীর্তিমানের সাংস্কৃতিক জীবন মানে মনন মাত্রা। তারই ছন্দ ও লয়ে সাংস্কৃতিক জীবনবোধে চলে সভ্যতার বুনন যাত্রা। মস্তিষ্ক নিসৃত হৃদয় রক্ত ক্ষরণের কায় ও ক্লেশে নির্মিত হয় কবিতা।” কবিতা কোনও কলকি পুরাণের বাণী নয় বরং কালের প্রতিচ্ছবি। কোনও কাশি ধামেও কবিতার স্থিতি নয় বরং আদি আধুনিক সভ্যতার অট্টালিকা থেকে মহাকালের বস্তিতেই তার যাত্রা জয়।
কবিতা সে তো নিশ্চল শব্দের সচল পদান্তর। অন্ত:করণের করণগুলো কারণ না হওয়া অব্দি কোনও যতি চিহ্নি কার এ যুক্ত হয় না। আত্মিক ঘটক যতটুকু কারে যুক্ত থাকে ততটুকুই তার আকার ততটুকুই তার কৃতি। শিল্পী প্রবৃত্তে থেকে যতটুকু করে ফেলে তা কৃত। কৃত এর বহমানতাই কৃতি। এভাবে দেখলে কবিতা ও কবি কার-কৃতির পরিপূরক। এ এক অনন্য অনন্ত:লীলা ভিত নির্মাণের মহড়া অর্থাৎ ভিতরে ঢোকার প্রযত্ন। শব্দ ব্রহ্মের প্রসাদ পেতে ও প্রসাদ গড়তে করতে হয় জ্ঞানময় কোষের কোষ্ঠ নির্মাণের ঠিকাদারী। উত্তীর্ণ কবি জঙ্গম কুশল, সঙ্গম পটু। উত্তরণের আরাধনায় নিবেদিত পদ পুজারী। সুতরাং জীবন ছন্দে গতি প্রণয়ের ছায়া মানবিই হলো কবিতা। যার সাথে কবির সম্পর্ক একান্ত আত্মিক।
আজ বিশ্বায়নের ডিজিটাল কম্পোজিশনের প্রত্যেক ডিজিটেই সমাজটা যেন গরম জলের মতই ফুটতে শুরু করেছে। পরিবর্তনের বিশাল অভিঘাত প্লাবনরে মত আছড়ে পড়ছে আধুনিকিকরণের কসমিট প্লাটুন। আমরা জরথ্রুস্তের আগুন উপাসনার কারণ খুঁজতে চাইনা, চাই জীবনের একান্ত প্রাসঙ্গিক উত্তাপ। জনম কুন্ডলীতে আস্থা অনাস্থায় কোনও ব্যাপার নেই এবং কুল রক্ষার কবচ এন্টিক ধারণার অন্তর্গত। সুতরাং সাংস্কৃতিক অন্তর্ঘাত আর অবক্ষয় যেন জীবনমানে পূর্বনির্ধারিত। সৃজনশীল সাহিত্যের অভিজ্ঞতার যে অভিধা তা, মূলত: যে অভিশাপ একদা তার অন্ধকার আফ্রিকায় প্রজন্মের কানে ভেসে এসেছিল যোদ্ধারা পন্ডিতদের সঙ্গে লড়াই করে সংগীন তছনছ করে দেবে। আগাছায় পথ-ঘাট ছেয়ে যাবে। জমির উর্বরতা কমে গিয়ে উৎপাদনের হার দিনদিন কমে যাবে আর ওদিকে উত্তোরত্তর বংশবৃদ্ধি হতে থাকবে। বাড়ীঘর ভেসে যেতে থাকবে বন্যায় আর ওদিকে মাটি ফুটিফাটা হবে ক্ষরায়। তোমাদের সন্তানেরা কোদাল ছেড়ে বেকার ঘুরে বেড়াবে শূন্যতায়। তোমরা লোক ঠকানোর কায়দা শিখবে। বন্ধুকে বিষ দিতে শিখবে। দেখবে সব চুরমার হয়ে যাবে, খুলে খুলে পড়ে যাবে! নাইজেরিয়ার উপন্যাসিক চিনুয়া আচেবে এই অভিশাপটি ধরে রেখেছেন তাঁর প্রথম উপন্যাসে, থিংস ফল অ্যাপার্ট- এ আবৃত করে। অতীতকে ফেলে দিয়ে যে ভবিষ্যৎ দাঁড়াতে পারে না, থাকে পাপ, বর্তমান হয় বিভ্রান্ত। আর্য্য-অনার্য্য কি দ্রাবিড় মস্তিষ্কের শিরায় তার উপমা স্থবির নয়। অপরাপর জার্মান কবি হাইনরিষ হাইনে বলেন, যারা কবির রচনাতে “নির্ভেজাল” আর্জিন্যালিটি খোঁজে তারা চিবাক মাকড়ের জাল, কারণ একমাত্র মাকড়ই তার জালটি তৈরী করে আপন পেটের মাল দিয়ে, ষোল আনা অরিজিনাল, আমি কিন্তু মধু খেতে ভালবাসি; যদিও সেটা ভালভাবেই জানি মধুভান্ডের প্রতিটি ফোঁটাই ফুলের কাছ থেকে চোরাই করা মাল। সুতরাং সৃজন ভাবনার যে প্রকৃতি সত্যের সন্ধান দেয় মানব কল্যাণের কালউর্ত্তীণ মুখপাত্র সেই হয়। ক্ষেত্র বিশেষ আজকের আধুনিক রূপরেখা কি উত্তরাধুনিকতায় সাংঘর্ষিক নয়! মননের মাত্রা বুনন সেই শিল্প, সাহিত্য আর সংস্কৃতিতে কোথায়? শার্লক হোমসের মত আতসী কাঁচ দিয়ে জুতোর দাগ পরীক্ষা করবে কে? আমাদের আতপ চাউলের মত সরল বিশ্বাসের খুঁটি উপড়ে ফেলছে যারা, তাদের কেউ আর কবিতার পদযাত্রায় নেই। যারা লুটেরা সংস্কৃতিতে গাধার কান ধরে টানাটানিতে উন্মাতাল। পৃথিবী জুড়ে লুম্ফেন পুঁজির নোঙড়ে লটকে গেছে আজকের সংস্কৃতি। ভেক যেখানে রব ছেড়েছে সেখানে কোকিলের পক্ষে মৌনতাই শ্রেয়; ভদ্রং কৃতংকৃতং মৌনং কোকিল জলদাগমে। অপরাপর কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলছেন কবিতার বিশেষত্ব হচ্ছে তার গতিশীলতা, সে শেষ হয়েও শেষ হয় না। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম বলেন, গণ-মানুষকে জাগিয়ে তোলার জন্য কবিতা অস্ত্রস্বরূপ। কোল রজি এর মত হলো, শ্রেষ্ঠতম বিন্যাস শ্রেষ্ঠতম শব্দ সমূহের প্রকাশই কবিতা।
স্বাতন্ত্রের চিহ্ন বুকে করেই এক একটি কালখন্ডে কাব্য আধুনিক বলে খ্যাত। বুদ্ধদেব বসুর কথায় সাল তারিখ দিয়ে আধুনিক কবিতার যাচাই চলে না; অধুনা রচিত অনাধুনিক কবিতারও যাচাই চলে না; অধুনা রচিত অনাধুনিক কবিতারও উদাহরণ প্রচুর। তাই আধুনিক কালের কবি হলেও আধুনিক কবি হয় না। Modern amounts to more than chronological description.
প্রসঙ্গত: রবীন্দ্রনাথ বক্তব্য স্মরণীয়- পাঁজি মিলিয়ে মডারণের সীমানা নির্ণয় করবে কে? এটা কালের কথা ততটা নয়, যতটা ভাবের কথা। নদী সামনের দিকে চলতে চলতে হঠাৎ বাঁক ফেরে, সাহিত্যও তেমনি বরাবর সিধে চলে না। যখন সে বাঁক নেয়; তখন সেই বাঁকটাকেই বলতে হয় মডার্ণ। বাংলায় বলা যাক আধুনিক। এই আধুনিকতা সময় নিয়ে নয়; মর্জি নিয়ে। একটি কবিতা একই সঙ্গে তার স্বকালের বিচারে যেমন আধুনিক তেমন সৎ কবিতা হিসাবে চিরকালের। কেননা কবির তৃতীয় নেত্র সৃজন ভাবের পাঁনশিতে পূর্ব সংকেত বাহিত করেন।
এ পর্যায়ে আধুনিকতার স্বরূপ নির্ধারণে কর্ডওয়েলের মন্তব্য: “When we use word ‘modern’ in a general sense we use it to describe a whole complex of culture which developed in Europe and spread beyond it from the fifteenth century to the present day… this complex rest on economic foundation. The complex itself is changeful.”
[The Development of modern poetry. Illusion and Reality ‘c’ Cardwell]
অপরদিকে আধুনিকতাকে পাশ কাটাতে কিংবা গতির ধারা বদলের অভিধা নিয়ে প্রথম ১৮৭০ সালে ওয়াটকিনসচ্যাপ ম্যান নামে একজন চিত্রকর সর্বপ্রথম “পোষ্ট মডার্নিজম” শব্দটি ব্যবহার করেন। এরপর থেকে এই নিয়ে বিতর্কের যেন শেষ নেই। কবিতা কোন কার্বন কাগজের কালি নয়। কবিতা কাল থেকে কালান্তরের এক নির্জলা ছবি। জীবনের নিবিষ্ট চিত্তের বেদীতে দাঁড়িয়ে কবি শিল্পের আরাধনায় মত্ত থাকেন। তাই তো কবিতায় কবি এঁকে যান, রেখে যান মানুষের আসল সত্য।
কবিতা কোন ভূঁইফোঁড় শিল্প নয়। তার বিকাশের পশ্চাতে নিহিত থাকে পারিপার্শ্ব সংলগ্নতার গভীর এক পরোক্ষ ও নিঃশব্দ ইতিহাস। চেতনাবাহী অনুসন্ধিৎসু মন সেই অন্তরালাবর্তী সত্যকে সনাক্ত করেই শব্দের মালা গেঁথে সৌধ নির্মাণ করেন। কাব্য ইতিহাসের যে যুগ বিভাজন সেই সাহিত্য কর্ম আজ আধুনিক, উত্তরাধুনিক চেতনার ঐশ্বর্য নিয়ে শিল্পের রূপ পরিগ্রহ করেছে। সময় ও কালের মাত্রায় বিশ্বসাহিত্যের সঙ্গে বাংলা সাহিত্যের সংযোগ সূত্রও দৃঢ় হয়ে উঠেছে। এছাড়াও বিভিন্ন মাত্রার আঙ্গিকে ব্যক্তি অনুভূতির জটিল ও দুর্বোধ্য প্রবণতাকে ভাষার মানচিত্রে শব্দের গাঁথুনিতে অঙ্কিত করা হয়েছে। বাংলা সাহিত্য গ্রাম বাংলার নিঃসর্গচেতন পরিবেশ থেকে ধীরে ধীরে সরে এসেছে নগরকেন্দ্রীক সভ্যতার পরিবেশের দিকে। অপরাপর জীবন দর্শনে রবীন্দ্র কাব্যের অর্থ গৌরব থেকে এসব আধুনিক কবিতায় বিকশিত অর্থ পৃথক হওয়ার দরুন প্রকাশ ভঙ্গির স্বভাব বদল করেছে তার খোলস। বাংলা সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথের একচ্ছত্র প্রভাব যে বলয় নির্মাণ করেছে তার সিঁড়িতে পা রেখেই কাব্য সৃষ্টির সাফল্য বয়ে চলেছে মননশীল স্রোতসিনী নদীর মতো। যেখানে অবগাহন করেছেন বৈপ্লবিক পর্যায়ের শীর্ষ স্থানীয় কাব্য ইতিহাসের পঞ্চপান্ডব, জীবনানন্দ দাস, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, অমিয় চক্রবর্তী, বুদ্ধদেব বসু ও বিষ্ণ দে।
সাহিত্যের আঙ্গিক ঘিরে নিষ্ঠুর বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে শতাব্দির শিখরে সময় ও কালের চক্রে বলয়ের পর বলয় ছিন্ন করে কবিতার অন্তর্গত তাগিদ, সীমাবদ্ধতা বিদীর্ণ করে বিপুলায়তন বিচিত্র ও পরিবর্তনশীল অনুভূতিতে চরম সময়ের পরম প্রভাবের ব্যঞ্জন নিয়ে আধুনিক হয়ে উঠেছে। যেখানে আধুনিক কবিতার বৈশিষ্ট্য দাঁড়ায় পাশ্চাত্যের আধুনিকতার অন্ধ অনুকরণের পথ পরিক্রমার মায়াজালে। ফলে আমাদের সমাজ বিকাশে এর প্রভাব একেবারেই ভিন্ন ধারা প্রবাহিত করে দেয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কবিরাই কবিতা পড়ছে, সাধারণ মানুষের কাছে যেন পৌঁছাতেই পারছে না। দেশ কালের ঐতিহ্য এ বন্ধ্যাত্বের দায়ভার রীতিমত ভ্রান্তি বিলাসে পরিণত হয়েছে। আধুনিক কালের সোচ্চার কবি কণ্ঠ তাই বিদীর্ণ করতে চান দুঃসহ ঘৃণ্য ক্লেদাক্ত অসমতাকে। চল্লিশ দশকের বীরেন্দ্র চট্টপাধ্যায় চিৎকার করে বলেন ঃ মুখে যদি রক্ত ওঠে/সে কথা এখন বলা পাপ/এখন চারিদিকে শত্রু, মন্ত্রীদের চোখে ঘুম নেই/এ সময়ে রক্ত বমি করা পাপ, যন্ত্রণায় ধনুকের মতো/বেঁকে যাওয়া পাপ; নিজের বুকের রক্তে স্থির হয়ে শুয়ে থাকা পাপ।
কবিতা হয় যেন সাহিত্যের সূক্ষ্ম মসলিনের অঙ্গাভরণ পরে সৌন্দর্যের গণতন্ত্রে কালের কৌলীণ্য। চেতনার প্রাবল্যে বুকের পাটাতনে বিপ্লব জেগে ওঠে। তাই আবারও কবি বলে ওঠেন একই সুরে- কন্ঠে আগুন ছিল, তাই সে মিছিলে বুক মিলিয়েছিল/বুকে ছিল আগুন, তাই সে সূর্যকে ডাক দিয়েছিল/সূর্যে ছিল আগুন; তাই সে/আগুন নিয়ে খেলেছিল–।
জীবন, শিল্প ও প্রকৃতি এক আবেগমন্ডিত প্রতিভাসে বিমূর্ত। লেখক হিসেবে এমন মন্তব্যও হতে পারে যে, সাহিত্য ধর্মে গুরু মুর্শীদ হয়ে আছেন রবিঠাকুর, হাইনে, তুর্গেনেফ, মাইকেল। আজ এঁদের অস্বীকার করতে পারব না। র্যাবো, এলিয়েট সম্প্রদায় যতই শক্তিশালী হননা কেন। এখানে ভাবনা বলয়ের আভিজাত্য রূপকল্পের একান্ত ঘারাণায় নিবেদিত। রুশ দেশের মহাকবি পুশকিন, সে যুগে ভাষা ছন্দের রাজা ছিলেন ফ্রান্সের উপন্যাসিক গুস্তাফ ফ্লবের। তাঁর শিষ্য মপাসাঁ। এই সকল সাহিত্য মহাত্মা যা দিয়েছেন তার আয়ু অন্তহীন চিরঞ্জীব সর্বকাল নমস্য। এছাড়া মায়া আশ্রিত অতিন্দ্রীয় ভাবের দোলচল ও সাহিত্য অঙ্গনে বোদ্ধিক জনের মনন মাত্রায় বিকশিত হয়েছে। হাফিজ, আত্তার, এমনকি ওমর খৈয়ামের বহু কবিতার কোন অর্থই করা যায় না, যদি সেগুলোর রূপক দিয়ে না করা হয়। বাদবাকিগুলো আমাদের পদাবলীতেও তাই এবং বিস্তর সব পদ আছে যাতে মর্ত্য আর অমর্ত্য প্রেম এমনভাবে মিশে গেছে যে, দুটোকে আদৌ আলাদা করা যায় না। সমস্ত হৃদয়মণ এক অদ্ভুত অনির্বচনীয় নবরসে আপ্লুত হয়ে যায়।
স্বাতন্ত্রবাদে গভীর জীবন সংলগ্নতা কবিতার অন্তর্বয়ানে চিত্রিত। শিল্প নন্দনের বিশ্ব যেমন উপন্যাসে টলষ্টয়, গল্পে মপাসোঁ, চিত্রকলায় রাফায়েল, ভাস্কর্য্যে মাইকেল এঞ্জেলো, দর্শনে কান্ট, নৃত্যে পাভলোভা, ধর্মে লুথার, সঙ্গীতে বেটোফেন। এমনকি আমাদের সুরৎহালও যে অঙ্গে নান্দনীক চিত্রে নন্দলাল, সঙ্গীতে দিনেন্দ্রনাথ, শাস্ত্রে বিধূশেখর, শব্দতত্ত্বে হরিচরণ, শিক্ষকতায় জগদানন্দ ও রসে ক্ষিতি মোহন। এছাড়া স্থাপত্য রূপ মার্গে যেন তাজমহল।
রাবীন্দ্রীক ভাষায় সাহিত্যের লক্ষ্য সৌন্দর্য্য, কাল বিভাজনের ধারাক্রমে বহু কিছুর পরিবর্তন পরিবর্ধন হয়েছে। সৃজন চেতনার গভীরতাকে কেন্দ্র করে কালিদাস, ভারতচন্দ্র, বাল্মিকী, ব্যাসদেব বা ঈশ্বরগুপ্ত, চৈতন্যদেব এর যুগ ভাবনার তথ্য উপাত্তের নিরিখ নির্বাচন করার প্রশ্ন অন্তত: এখানে খুব একটা প্রাসঙ্গিক নয়। তবুও বাংলা ভাষার কুলিন ঐশ্বর্য্য অলঙ্করণে এঁরাই নমস্য। প্রবর্তনকালে বাজারীকরণের ঢেউ, আমরা এখন নিত্য জোয়ারের অনিত্য স্রোতে বজরায় ভাসমান ব্যাপারী আর কারবারী। সত্তর দশকের আমাদের স্বাধীনতা পরবর্তীকালে মুক্তি প্রত্যাশার সাথে জীবনের সমতা যখন প্রবলভাবে প্রত্যাখ্যাত হয়, তখন দিক বিদিক নৈরাশ্যের বিস্তার ঘটে নিরন্তর। স্বদেশের
তরুণ কবি কণ্ঠ উচ্চারণে দাউদ হায়দার লিখেন- জন্মই আমার আজন্ম পাপ/মাতৃজরায়ু থেকে নেমেই জেনেছি আমি/সন্ত্রাসের ঝাঁঝালো বিবর্ণ পত্রের মতো হঠাৎ ফুৎকারে উড়ে যাই/পালাই পালাই সুদুরে……।
অপরাপর রফিক আজাদ নিরন্নের মর্মান্তিক আর্তনাদকে কবিতার ভাষায় চিত্রায়ন করে সরাঘাতের মতো ছুঁড়ে দিলেন “ভাত দে হারামজাদা” এ যেন সেই অগ্রজ কবির “ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়” এ কথার সত্যতা পূণর্বার প্রমাণিত হলো, নিষ্ঠুর নিয়তির কাল পরিক্রমায়- যদি না মেটাতে পার আমার সামান্য এই দাবী/তোমার সমস্ত রাজ্যে দক্ষযজ্ঞ কান্ড ঘটে যাবে/ক্ষুধার্তের কাছে নেই ইষ্টানিষ্ট, আইন কানুন/সম্মুখে যা পাব খেয়ে যাব অবলীলাক্রমে/উড্ডীন পতাকাসহ খাদ্য মন্ত্রী ও মন্ত্রীর গাড়ী/আমার ক্ষুধার কাছে কিছুই খেলনা নয় আজ/ভাত দে হারামজাদা, তা না হলে মানচিত্র খাবো। এ চরম বাস্তবতার নিরিখে কবির উপলব্ধিতে সত্যের অকপট প্রকাশ আজ এই উত্তরাধুনিকতাকে ঐতিহ্যের নবরূপে বিকশিত করেছে। সত্তর দশকের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে রাষ্ট্র ও রাজনীতির অস্বাভাবিক উম্মাদনার অনিবার্য প্রভাব মারাত্মক বিস্তার লাভ করে কবিদের মন ও মননে। তাই কবি শামসুর রহমান লিখেন- উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ, চাঁদ সওদাগর, চম্পকনগর…. যেন এ নগরী আজ সম্পূর্ণ অচেনা পরদেশ/যেখানে বিলাপ ছাড়া অন্য কোন ধ্বনি নেই আর/যেখানে নাগিনী ছাড়া অন্য কোন প্রাণী নেই, আর/যেখানে বরণযোগ্য বীর নেই, কবির অভিষ্ট/কোন জয়গাঁথা নেই, কাক তাড়ুয়ার মূর্তি ছাড়া/অন্য কোন মূর্তি নেই, প্রকোষ্ঠে প্রকোষ্ঠে প্রেত ছাড়া/অন্য কোন বাসিন্দার আনাগোনা নেই….। অনন্য কবিতার মুক্তকন্ঠ উচ্চারণে নির্মলেন্দু গুণ, আছাদ চৌধুরী, আল-মাহ্মুদ, কবি ওমর আলীসহ অনেকেই মনন মাধুর্য্যে এখন পর্যন্ত কবি ওবায়েদ আকাশ, রাহ্মান ওয়াহিদ ও আরও আরও শক্তিমান কবি শব্দের স্থাপত্য বিনির্মাণে সচল।
তবে আধুনিক জীবনে কবিত্ব শক্তির পল্লবিত ঢেউ যেন আছড়ে পড়ছে উত্তরাধুনিকতার রোমান্টিক, ট্র্যাজিক, এ্যাডভেঞ্চারসহ নানামুখি বোধের চিরায়ত শিল্পরূপে অতিমাত্রিক সম্ভার সাজিয়ে। কবিত্বের অমিয় কাব্য বাণীই শৃংখলমুক্ত, শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার মায়াবি অঞ্জন। এ আলোচনার ব্যাপকতা অনেক বেশী হলেও প্রয়োজনের তাগিদ থেকে কিছু অংশের অবতারণা যেন না করলেই নয়। কখনো কখনো সামাজিক অঙ্গিকারাবদ্ধ কবিদের প্রতি যখন কবিতার চরিত্র হননের অভিযোগ উপস্থাপিত হয়, তখন খরা আক্রান্ত ভূ-খন্ডের মতো বিবর্ণ সময় পাড়ি দিতে হয়। প্রতি দশকের বিচ্ছেদ বৈচিত্রে উদ্ভাসিত হয় লোকায়ত জীবনের গভীর কাব্যরূপ। কবিও কবিতার কাব্যরস কালব্যপ্তির বৈচিত্রতা নিয়ে বয়ে চলে খরস্রোতা নদীর মতো। অন্তহীন বোধের প্লাবন অšে¦ষণ করে ফেরে নিঃসর্গের কাব্য চৈতন্য। সমাজ বদলের প্রেক্ষিত বদলে দেয় শিল্পের ভিন্ন মাত্রা। আর এই পরিবর্তনশীল অনুভূতির ব্যঞ্জনায় যে কোন মতান্তর সমালোচক ও পন্ডিতদের মধ্যে থেকে তৈরি হলেও শিল্পের একটি সুফল আঙ্গিক হিসাবে কবিতার একটি সার্বজনিন গ্রহণযোগ্যতা কিন্তু ঠিকই থাকে। তাই স্পষ্ট করেই বলা যায় যে, কবিতার আধুনিকতায় আমরা যে কোন প্রভাবের কথাই বলি না কেন তা যতটুকু সত্য নয় তার চেয়ে বড় সত্য হলো যে কোন পরিবর্তনেরই গোড়াপত্তন হয় কাল প্রবাহের মাত্রার অনুশীলনে। যার প্রকৃষ্ট উদাহরণ দেখা যায় রবীন্দ্র কাব্য ধারায়। রবীন্দ্রনাথ সারা জীবন নিজেকে অতিক্রম করে গিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথের প্রথম পর্যায়ের কাব্য থেকে দ্বিতীয় পর্যায়ের কাব্য অভিনব- যা অনিবার্য্য হয়ে বিকশিত হয়েছে কালপ্রবাহের একান্ত প্রয়োজনে। তাই সমকালীন জীবন ব্যবস্থাই কবিচিত্তের কালপরিণতিতেই কবিতার শিল্পরূপ গড়ে তোলে। আমাদের প্রত্যাশায় কবিতার আভাময় পেলব শরীর যেন সঞ্চারিত করে আলোকিত আগামীর দীপ্তময় স্বর্ণশব্দের আদর্শিত অমরত্ব।
সুতরাং আমাদের সমকালিন কবিতার ভাষা ও অনুভব কোন প্রত্যয়ে নির্ণিত এবং তার যাত্রাপথ কি স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধুর অমোঘ ভাষণের ধারাকে মনন কাব্যে আশ্রয় করে? আবহমান কালের সুর, ছন্দ ও মাত্রা মোহনার শব্দ সম্ভাষণ- এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম-!!! কোথাও ছন্দ ও মাত্রায় ছেদ পড়েনি অথচ মানুষ জেগে উঠেছিল, ফুঁসে উঠেছিল, দাবানলের মতো। আমাদের কাব্য ধারায় বাংলার স্বাধীনতা নির্ধারিত হয়েছিল ঐশী নিয়মের পরিক্রমায় তাই তো জয় বাংলা এসেছিল বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুলের কাব্য সংস্কৃতির পংক্তিমালায়, কবিগুরুর সোনার বাংলায়। বঙ্গবন্ধু তাঁর পূর্ণতা দিয়ে গেলেন জাতিসত্ত্বায়। পৃথিবীর বুক চিরে ইতিহাসের যে পদাঙ্ক তার অলঙ্করণ কাব্যের প্রতিপাদ্য হয়ে থাকে ভাস্কর্য্যরে মনন মমিতে। কাব্যের ছায়াপথ ধরিত্রির আঙিনায় বহু জন ও জনান্তিকে রেখে যায় যতি চিহ্নের এপিটাফ। এমনই ১৯৪০-এর ইংল্যান্ড শীতে নয়, ভয়ে কাঁপছে, ৯ই জুন, চার্চিল তার ঐতিহাসিক ভাষণে সারা দেশের ঝিমিয়ে পড়া মনোবলকে চাঙ্গা করে তুললেন, We shall defend our Island whatever the cost may be, we shall fight on the beaches, we shall fight on the landing grounds আমরা মাঠে লড়বো, লড়বো রাস্তায় রাস্তায় আমরা পাহাড়ে লড়বো, We shall never surrender যা আমি বিশ্বাস করি না তাও যদি ঘটে, এই দ্বীপ কিংবা দ্বীপের বড় একটা অংশ যদি অধিকৃত হয়, যদি অনাহারে থাকে পরাভূত মানুষ, তাহলে আমাদের সম্রাজ্য আছে, আমরা সসাগরা, সাগরপাড়ের সম্রাজ্যে আছে ব্রিটিশ রণতরী, আছে সশস্ত্র, সুশিক্ষিত সৈন্য বাহিনী, তারা আমাদের হয়ে সংগ্রাম চালিয়ে যাবে। Until in God’s good time, the new world. তার সমস্ত শক্তি নিয়ে এগিয়ে আসবে আমাদের উদ্ধারে, এই প্রাচীন ভূ-খন্ডে তারা আবার উড়িয়ে দেবে স্বাধীন পতাকা।
সুতরাং পৃথিবীর ইতিহাস স্বাক্ষী দেয়- হিটলার উইল ক্র্যাশ…!! পৃথিবীর মহানায়কদের কবিতা কি সেই স্বাক্ষর বহন করে না! যেখানে শব্দ সমষ্টির ঐন্দ্রজালিক জারণ প্রক্রিয়া আধুনিক আর উত্তোরাধুনিক জগতের সকল গোলার্ধে তন্ময় বিকাশে সত্য শিবও সুন্দরে জারিত। আমাদের রক্তক্ষরণ এখনো বন্ধ হয়ে যায়নি অথচ কবিতায় কোন কাব্য লক্ষ্মিই ভেষজ গুণের প্রলেপ দিতে পারছে না। তবু আমরা বৈদ্যের আশায় রচনা শৈলীতে বাঙালিত্বই ধারণ করে আছি। গুণটানা নৌকার মাঝি জানে বিপরীত বাতাসে শক্তির প্রাবল্য কত/ আর কবিতায় সুর ও শব্দের প্রাবল্য আনে যৌবন রতি রমনে জাগরণের আহ্বান। ফলত: কবিতাই অটুট বৈরাগ্যে মুক্তির উপায় খুঁজে দেয়। কবিতা যেন উৎপাদনশীল ভবনায় সৃজন মায়ার প্রেরণাদায়িনী নারী। মাতৃরূপে কিংবা ভক্তিরূপে যেন শক্তিরূপেন সংস্থিতা। একমাত্র কবিতাই তার কুলীন দায় মেটাতে, চাপা কান্নার আঁচড় ভেঙ্গে বৈষম্য নীতিকে বৃদ্ধাঙ্গুলী দেখায়। পাষাণ প্রকৃতিকে বুকের শিড়িতে সুরের মায়ায় প্রথম বেঁধেছে মূলত: কবিতা। তাই জীবাণুসঙ্গে কবিতাই অষ্টপ্রহরের অষ্টাদশী, কর্মযোগে সকল অঙ্গের আলিঙ্গনে সংগ্রামী ও বিপ্লবী মানুষের মুক্তিবোধে অনন্য।

হাসান আহমেদ চিশতী, লেখক ও প্রবন্ধকার। সেল : ০১৭৩৪-২৮৫৬২০।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here