বাংলা সাহিত্যের সারথি-খাতুনে জান্নাতের মনের অমিত ভাবনার গুঞ্জরণ গদ্য “আলোকিত অনুধ্যান”

330
বাংলা সাহিত্যের সারথি-খাতুনে জান্নাতের মনের অমিত ভাবনার গুঞ্জরণ গদ্য “আলোকিত অনুধ্যান”

আলোকিত অনুধ্যান
খাতুনে জান্নাত


মানুষের জন্ম প্রকৃতির নিয়মে অথবা বলা যায় নারী পুরুষের যৌন আকাঙ্ক্ষার নিবৃত্তি নিরসনের কারণে; যাদের জন্মে মাতাপিতার ইচ্ছে অনিচ্ছে দুটোই জড়ানো। জন্মনেয়ার পরও সে অন্যের ইচ্ছার কাছে নতজানু থাকে। মানুষটিকে ভাগ করে পূর্ব-মানুষের প্রকৃতি। তার নিজস্বতা আর থাকে না। সে জড়িত হতে থাকে জটিল, কুটিল ও দুরূহ পরিবেশ ও প্রতিবেশের খেলায়। কারো কারো উষ্ণতায় হাত বাড়ায়, বেদনায় জর্জরিত হয়। জন্ম মানুষের শত্রুকে শত্রু ও মিত্রকে মিত্র ভাবতে শিখে।প্রকৃতির গুঞ্জনে মুগ্ধ হয়, আবার ব্যাথিত হয় সরবতা ও মানুষের পারস্পরিক গর্জনে। হীনতা, দীনতা, উন্মাতালতা, পঙ্কিলতা, মেদ, প্রভেদ তার প্রকৃতি থেকে সরিয়ে মিশ্র এক আবহে তাকে হারিয়ে ফেলে। মিশে যেতে থাকে গড্ডালিকা প্রবাহের স্রোতে। নিজেকে চিনে নেয়ার আগেই তাকে চিনতে হয় বা মুখোমুখি হতে হয় বহুবিধ ক্রিয়াশীল বা প্রতিক্রিয়াশীল ভাবনা জটিলতা, ক্রুরতা, উন্মত্ততা বা উন্মাদনায়। যেখানে সে আর সে থাকে না, হয় যাবতীয় পরাশ্রয়ী অবয়ব। সে হারানো অবয়ব থেকে নিজেকে খুঁজে নেয়ার চেষ্টায় যে সফল হয়, সে হয় মানুষ। পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রিয়, বৈশ্বিক ভেদ থেকে বেরিয়ে পড়া ভেদহীন স্বয়ংসম্পূর্ণ মানুষ। এ কাজ কঠিন। সবচেয়ে কঠিন বাঁধনে বেঁধে রাখা বাণ হয় সহস্র ধর্মভিত্তিক বিভেদ। এক ধর্ম আরেক ধর্মের বিপরীতে অবস্থান নেয়। এক স্রষ্টা আরেক স্রষ্টার। ধর্ম অনুসারীরাও তাই। আমি বড় তুমি ছোট, আমি সত্য তুমি মিথ্যা। ধার্মিককে হতে হয় লোভী বা ভীত। তার নিজস্বতা কোথায়? নারীর ক্ষেত্রে তা আরও হানীকর। মানুষ হিসেবে নারীর মর্যাদা তলানীতে। মূলতঃ ধর্মের কারণে সবচেয়ে বেশি সংঘাতের মুখোমুখি হয় জাগতিক বিশ্ব। স্বাধীনতার বিপরীতে কাজ করে ধর্মভিত্তিক শিক্ষা। শিশুটি বড় হলে এ আবর্ত থেকে বের হতে হয়। এর ঊর্ধ্বে উঠে মানবিক ধারায় স্নাত হয়ে মনকে তৈরি করতে হয় মানবিক মূল্যবোধের শাশ্বত সংস্করণে। আর তাকে তা ভেঙে দিতে হয় কৌশলে, জ্ঞানের মুক্তো আহরণ করে নিজেকে দোদুল্যমানতার হাত থেকে বের করে আনতে হয়। হতে হয় প্রকৃতিপ্রাণ। আপন ঐশ্বর্যে ঐশ্বর্যবান।

এই যে, আপন ঐশ্বর্য তা কেমন? নদীর সচলতা, বৃক্ষের উদগমতা, পাহাড়ের দৃঢ়তা, পাখির উড্ডয়নতা, মীনের সন্তরণতা! মানুষ প্রকৃতির আবর্তন আর বিবর্তনের সুতো ধরে তৈরি করেছে এ চঞ্চল প্রবাহমান বিশ্ব। তার ঐকান্তিক ইচ্ছার ফসলে তিলে তিলে অর্জন করেছে বুদ্ধিভিত্তিক মাধুর্যতা। আবিষ্কারের উজ্জ্বল্য দিয়ে মুক্ত করেছে সে পৃথিবীকে যেখানে একদিন অসহায়, দমিত, দলিতমথিত ছিল। সেই মানুষ হয়ে ওঠে স্বয়ংসম্পূর্ণ, তেজোদীপ্ত মানুষ। আপন তেজে বলীয়ান, আপন মহিমায় ভাস্বর। সে ভাস্বরতা সৌন্দর্য অবলোকন করার সক্ষমতা। ভালোবাসার মতো শৈল্পিক ও কাব্যময় মন ও মনস্বিতা গঠনের মতো ঔদার্যতা। ঝিনুকের মতো বা কুঁড়ির মতো দেহের বা মনের পাঠ খুলে ভাষা বিনিময়। সৌন্দর্য উপভোগ করতে ও অক্ষরের সুতো জড়িয়ে জড়িয়ে তৈরি করে জীবনের মালা। চোখ খুললেই প্রাকৃতিক জীবন দু’হাত বাড়িয়ে নিবিড়তায় মুগ্ধ করে। ফুলের হিন্দোল, পাতার ঝঙ্কার, পাখির গান, নদীর ঢেউয়ের মর্মরতা আবেশে উৎফুল্ল হয়। বৃক্ষের মতোই মানুষ আলোমুখী। অথচ চলার পথ সংকীর্ণ। ক্ষুদ্র প্রাণ! সামান্য ঝড়, ঝঞ্জা, রোগ বালাই নিঃশেষ করে দিতে পারে মুহূর্তে। প্রকৃতির কাজ বা খেলা নিরন্তর। সৃষ্টি আর ধ্বংস, গঠন আর ভাঙন। মানুষ জয় করে, হাসে, কাঁদে। বেঁচে থাকে স্বল্প সময়। প্রকৃতির সব প্রাণীর মতোই টিকে থাকতে চায় সন্তানের মধ্যে। আর মনকে প্রবোধ দিতে তৈরি করে পরকাল, অনন্ত সুখ আর দুঃখের বালাখানা। এসব টিকে থাকার দৈন্য চিন্তা সরিয়ে যে মানুষ নিজস্ব আলো দিয়ে তৈরি করে নিজেকে। যৌন ও মৌন সংসর্গ সাথে নিয়ে রচিত করে শৈল্পিক আবাস। সৃষ্টির সুধায় ডুবে থেকে মনকে ক্ষুদ্র থেকে বৃহৎ পরিসরে ধাবিত করে। অনন্য সৌন্দর্য চারপাশে ছড়িয়ে দিতে দিতে নিজের আপনরূপ বা সত্তা ফিরে পায়। সেই জয় করে সময়। আর এরা অবশ্যই সৃষ্টিশীল মানুষ। সাহিত্য ও শিল্পের আবীরমাখা ছন্দোবদ্ধ মানুষ। স্বচ্ছ ও নম্রতার দ্যুতিমাখা অলঙ্কারিক মানুষ; যাদের সৃষ্টিকর্মে অন্য মানুষেরা খুঁজে পায় জীবন জয়ের রসদ।

কবিতা ও জীবন পঠনে সময়কে পার করে, সময়ের ঊর্ধ্বে হাঁটে, অতীতের গোপন গভীর তটে স্নিগ্ধ আলো মাখে। গল্পের মোহনায় ভাসতে ভাসতে জীবন খুঁজতে শিখে। কবিতা সুর, ছন্দ, তালে মিশ্রিত হয়ে যে সংগীত তা একটি বড় ভূমিকা রাখে মন ও মনন তৈরি করতে। তেমনি নাচের তালে তালে মুদ্রা ও দক্ষতার অভিনিবেশে প্রকৃতির উচ্ছলতা। ভাষ্কর্যের অপূর্ব গঠনে, চিত্রের ক্যানভাসে ভাসে অতীত, ভবিষ্যৎ ছোঁয়া ও না ছোঁয়ার মিথ ও মলয়। তেমনি বিজ্ঞানের অপরিমেয় দক্ষতা সকল কুসংস্কারের বেড়াজাল হটিয়ে পৃথিবীকে দিয়েছে পূর্ণতার স্বচ্ছ জিয়নকাঠি। এসব সাধনা ও ধ্যানের নিরন্তর প্রকাশে মানুষ তৈরি করে মহাজাগতিক সুষমা ও সৌন্দর্যের আধার। তা বিকিরণে জীবনের অর্থ সৃষ্টিশীলতা, জীবনের অর্থ সুন্দরের সাধনা। কেবল তখনই স্বল্পায়ুর এ জীবন অলঙ্কারমণ্ডিত ও সুশোভিত হয়। ক্ষুদ্রতা দূর করে বৃহত্তর জীবনের দিকে ছড়িয়ে পড়ে। ভবিষ্যতের হাতে জৈবিক জড়তা ভেদ করে মননশীল ক্রিয়া পরিক্রমা।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here