“জীবন নদীর বাঁকে ”জীবনের গল্পটি লিখেছেন বাংলা সাহিত্যের অন্যতম সারথি–নাসরিন আক্তার

466
“জীবন নদীর বাঁকে ”জীবনের গল্পটি লিখেছেন বাংলা সাহিত্যের অন্যতম সারথি–নাসরিন আক্তার

জীবন নদীর বাঁকে

                       নাসরিন আক্তার

দুপুর ১টা,মাথার উপর গনগনে রোদ রাজধানীর পান্থপথে বসুন্ধরা সিটি মলের সামনে ট্রাফিক সিগন্যালে আঁটকে আছি। প্রাইভেট কার, মাইক্রোবাস, সিএনজিচালিত অটোরিকশা ও মোটরবাইক সহ অসংখ্য যানবাহনের দীর্ঘ লম্বা লাইন । কোন ভি আই পি যাবেন বলে সার্ক ফোয়ারা মোড়ের সবগুলো পথই বন্ধ। সূর্যের প্রখর তাপে অনেকক্ষণ আটকে থাকা এক মোটরবাইকের আরোহী উসখুস করে বলেন, ‘এইরে সেরেছে, দুপুর ১টায় পল্টন মোড়ে থাকার কথা, এখনও বসুন্ধরার মোড়েই আটকে আছি।’

এ সময় এক বৃদ্ধা দুটো গোলাপ ফুলের তোড়া হাতে সবগুলো যানবাহনের টোঁকা দিচ্ছে । বয়স ৬০/৬৫ বছরের বেশি বৈ কম হবে না। মুখের চামড়ায় অসংখ্য ভাঁজে বয়সের মানচিত্র।রোদের তাপ থেকে রক্ষা পেতে ঘোমটা টেনেছেন মাথায়।

প্রথম দেখায় মনে হবে বৃদ্ধা নিজের বা আপন কারও জন্য গোলাপ ফুলের তোড়া দুটো কিনে বাসায় ফিরছেন। একটু ভালো করে লক্ষ্য করলে দেখা যায় তিনি ট্রাফিক সিগন্যালে আটকে থাকা বিভিন্ন যানবাহনে যাত্রীদের কাছে গোলাপ ফুলের তোড়া কেনার জন্য অনুরোধ করছেন। কিন্তু বেশিরভাগ মানুষই বিরক্ত হয়ে তাকে ফিরিয়ে দিচ্ছে।

বৃদ্ধা তখন আকুতি ভরা কন্ঠে বলতে থাকেন ‘-
আপনাদের কাছে ভিক্ষা বা সাহায্য চাইতে আসি নাই , দয়া করে ফুলের তোড়াটা কেনেন বাবারা। বুড়া-বুড়ি কয়ডা খাইয়া বাঁচি।

এরই মাঝে সিএনজিচালিত একটি অটোরিকশার ভেতর থেকে একজন বলে উঠে
– এদের জ্বালায় রাস্তায় বের হওয়া কঠিন হয়ে গেছে, সব ভিখারির দল!

কথাটা শুনার সাথে সাথে বৃদ্ধার চোখ ছলছল করে উঠে।স্পষ্টতই বুঝা যায় এই কাজটা করতে উনার কতটা লজ্জা লাগছে। উনি রাগে বলতে থাকেন, -কপালের ফেরে সব থাকতেও নাই
-নদী ভাঙনে জমি জমা ঘরবাড়ি সব হারাইছি। আমরাও তো সরকাররে ভোট দিছি।তয় আমাগোতো একটু গতি হইলো না। এ কথা বলতে বলতে ঐ স্থান ত্যাগ করেন তিনি।

আমি কৌতুহলি হয়ে উঠি। আমি গল্প খাদক, জীবনের গল্প আমাকে খুব টানে। জীবন নদীর মত বাঁক নেয়, আর বাঁকে বাঁকে নগর সভ্যতা গড়ার মত, জীবনেও চলে উত্থান- পতন। স্কুটার থেকে নেমে উনার পিছন পিছন হাঁটি । উনি বেশ খানিকটা দূরে যেয়ে একটা গাছের নিচে বসে আঁচলে চোখ,মুখ মুছেন। আমিও ধীরে ধীরে উনার সামনে যেয়ে দাঁড়াই। বলি মা একটা তোড়া আমাকে দিন। তোড়ার মূল্য পরিশোধ করে উনার পাশে বসি। উনি স্বজল চোখে আমাকে তাকিয়ে দেখেন। এটা ওটা বলে একটু ঘনিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টা করি।

কথার ছলে একসময় বলি মা আপনার ছেলে সংসার নেই? – প্রথমে চুপচাপ দূরে তাকিয়ে থাকেন যেনো দূরে কোথাও অতিতকে দেখা যাচ্ছে। উনি যেনো ভাবনায় ভরকরে অতীততে ঘুরে আসেন। একসময় কণ্ঠটা অনেক দূর থেকে ভেসে আসে,ছোট্ট একটি দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে বলেন —
– একসময় আমার সবই আছিলো মা। আমি গগিরস্থ ঘরে বউ আছিলাম । ওদের বাবা জেলা শহরে কেরানীর চাকরি করতো।আমাগোর দুইটা ছেলে আছিলো। এই পর্যন্ত বলে তিনি থামলেন।
– ছিলো মানে কী? এখন নেই? ওরা কোথায়?

দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলেন
– থাকবো না কেনো মা। আল্লাহর দুনিয়াতেই আছে। তয় আমগোর লগে নাই।

– ওরা কোথায় থাকে?
বাঁধভাঙা নদীর মত উনি বলতে শুরু করেন।
আমার পোলাগোর নাম বাবলু ও বাদল।
বাবলুর জন্মের দুই বছরের মাথায় বাদলের জন্ম। ওরা পিঠাপিঠি দুই ভাই। উনি চাকরি করেন, কিছু জমিজমাও আছিলো। সুখেই আছিলাম । চোখে স্বপ্ন পোলাগো পড়াশোনা করামু ওগো মানুষের মত মানুষ করমু। তয় মানুষ করতে পারি নাই।
বলে উনি ছোট একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন।
আমি চুপ করে অপেক্ষা করি বাকিটা শুনার জন্যে। উনি আবার শুরু করেন –
– বাবলু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থাইকা ইংরাজি লইয়া পড়াশোনা শেষ করে করে।বায়না ধরে বিদেশ যাইবো, জমি জমা বেইচ্যা ওরে ট্যাকা দেই ও বিদেশ চইলা যায় । প্রথম কয়েক বছর যোগাযোগ ছিলো –
এই পর্যন্ত বলে আবার একটু দম নিয়ে শুরু করেন —
—বাদল জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে
সমাজকল্যাণ নিয়া পড়াশোনা করতে ঢাকায় আসে, এক সরক দুর্ঘটনায় মারা যায়।
একটু থেমে বলেন সবই আমার কপাল মা। নইলে সোনার লাহান পোলাডা আমার মরবো ক্যান। ক্যানই বা নদীতে আমার জমিজমা বাড়ি ঘর কাইড়া নিবো?
বললাম আপনার বড় ছেলে?

ঘোলা চোখে আকাশের দিকে তাকায়।
– কোন খোজ খবর নাই রে মা। বাইচ্চা আছে কি মইরা গেছে তাও জানি না।
নদীতে বাড়ি ভাঙনের পর ঢাকায় আইছি আজ দুই – বছর হইলো । বুড়ায় রিক্সা চাইতো দুই বুড়াবুড়িই কোনরহমে পেট চলে। আজ তিন চাইর দিন বুড়ায় অসুখ হইয়া ঘরে পইরা আছে রিক্সা চাইতে পারে না, তাই আমারে রাস্তায় নামতো হইলো। বয়স হইছে কোন কামকাইজ করতে পারি না, আমারে কাম দিবো কে ? আমগো বস্তিরই পোলাপান ফুল বেঁচে।ওরা কইলো দাদি আমগোর লগে লও তুমিও ফুল বেচবা। তাই ওগোর লগে আইছি, তয় মাইনষের কথা সয্য হয়না রে বাজান! বলে আবার আঁচলে চোখ মুছেন।

সময়ের টানে আমাকেও উঠতে হয়। নিজের গন্তব্যে ফিরতে ফিরতে ভাবি সত্যিই ভাগ্য কখন কাকে কোন মোড়ে দাঁড় করায় তা আমরা কেউ বলতে পারি না।।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here