“পদ্মা ”ছোট গল্পটি লিখেছেন ওপার বাংলার সাহিত্যের অন্যতম সারথি- কাকলি ভট্টাচার্য্য মৈত্র

486
“পদ্মা ”ছোট গল্পটি লিখেছেন ওপার বাংলার সাহিত্যের অন্যতম সারথি- কাকলি ভট্টাচার্য্য মৈত্র

পদ্মা

       কাকলিভট্টাচার্য্যমৈত্র

উঠোনের এক পাশে কাঠের জ্বালের উনুনে ভাত ফুটছে…..
সে গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে সারা উঠোনময়। ভাঙাচোরা বেড়ার দেওয়াল ও টিনের ছাউনির ঘর, উঠোনে ছড়িয়ে পড়ে থাকা কিছু গেরস্থালির জিনিস…..
….. সবেতেই ফুটন্ত ভাতের গন্ধ…….
সকাল থেকেই, আকাশ থমকে আছে। তাড়াতাড়ি কাজ গুছিয়ে নিচ্ছে পদ্মা। মাঠে যে কখন যাবে…..
….. গরু দুটো আজ বড্ড বেশি হাম্বা হাম্বা করছে।
হয়তো মেঘ দেখে ওরা ভয় পেয়েছে…..
সেই কোন সকালে শম্ভু কাজে বেড়িয়েছে। বিকেল ফুরিয়ে যায়…. এখনও বাড়ি ফিরছে না। পদ্মা উনুনে শুকনো ডাল গুজে দিতে দিতে ভাবছে….
…..মা কেমন দেখতে ছিল……কে জানে……
পিসির কাছে শোনা, খুব লক্ষ্মীমন্ত ছিল…. গায়ের রং ফর্সা আর কপালে বড় একটা সিঁদুরের লাল টিপ। এই হলো মা।
পদ্মা কখনো মাকে দেখেনি, পদ্মাকে জন্ম দিয়েই পৃথিবী ছেড়েছে। এখন বাপ মেয়ের সংসার।

ভাতটা উপুড় দিয়েই…. পদ্মা মাঠে ছুটল গরু দুটোকে আনতে। ওরা পদ্মার খুব ভালো বন্ধু। পদ্মা
ওদের খুব যত্ন করে, স্নান করায়, জাবনা খাওয়ায়।
খুব ভালোবাসে।
…… হঠাৎ ঝড়…. তাড়াতাড়ি সব কিছু ঘরে তুলতে লাগলো পদ্মা।
…… কিন্তু….. বাবা আসছে না কেন !!! বড়ো দুশ্চিন্তা হচ্ছে, দুদিন ধ’রে বাবার গায়ে জ্বর। ডাক্তার দেখাতে পারে নি। ডাক্তারের টাকা…….
…….. ওষুধের দাম….…হয় নি ডাক্তার দেখানো।

বাবা আসছে না…..ঝড় উঠেছে….কালো অন্ধকার
….. পদ্মার খুব ভয় করছে, ভাবলো পাশের বাড়ির পিসির কাছে চলে যাবে…..
…… কিন্তু পরক্ষণেই মনে হ’লো….. যদি বাবা এসে যায়…… বৃষ্টি নেমে আসে!
…… না সে ঘরেই থাকুক…..ঘর ছেড়ে কারুর বাড়ি যাবে না।
ছিঃ…..সে কেবল নিজের কথাই ভাবছে……
অসুস্থ বাবা এই দুর্যোগের মধ্যে বাইরে দাঁড়িয়ে থাকবে! না সে কোথাও যাবে না।
…… জোরে, খুব জোরে বৃষ্টি নেমে এলো…..
…… এতো জোরে জোরে দরজা ধাক্কা দিচ্ছে কেন বাবা, আমাদের ঘরটাইতো ভেঙে যাবে।
…… খুলছি….. খুলছি…..
…… দরজা খোলা মাত্রই তিন মুর্তি হুড়মুড় করে ঘরে ঢুকে এলো……
পদ্মা ভয়ে কেঁপে উঠলো……
….. চিৎকার করে বলতে লাগল…..
আমাকে ছেড়ে দাও…..
….. তোমরা কে??? কি চাওও……
বাবা এখনও বাড়ি ফেরেনি……
যথাসাধ্য চেষ্টা করেও নিজেকে বাঁচাতে পারলো না পদ্মা…..
….. ওরা ওই চোদ্দো বছরের মেয়েটার শেষ লজ্জাটুকুও ভাগ ক’রে নিতে লাগলো নির্দয়ভাবে।
টিনের চালের বৃষ্টির শব্দের আওয়াজে ঢাকা প’ড়ে গেলো মেয়েটার তীব্র অসহায় আর্তনাদ।
….. প’ড়ে রইলো রক্তাক্ত শরীরে……
…… যখন জ্ঞান ফিরে এলো…. তখন গভীর রাত….
অসহায় বাবা মেয়ের রক্তাক্ত শরীরটাকে পরম স্নেহে জড়িয়ে ধ’রে বসে আছে উদাস নয়নে.
পদ্মা কেঁদে উঠলো….. বাবা এতো দেরি করলে কেন বাবা…… ওরা যে আমাকে নষ্ট ক’রে দিয়ে গেলো….. ওরা নষ্ট ক’রে দিলো……
বাইরে তখনও বৃষ্টি পড়ছে, ঝড় থেমে গেছে, গরু দুটো হাম্বা হাম্বা ক’রে ডেকে চলেছে……
শম্ভু মেয়েকে কোন রকমে ঘরের বাইরে বের ক’রে নিয়ে এলো…..
বৃষ্টির জলে পদ্মার শরীর ভিজতে লাগলো
…… পদ্মার অঝোর কান্নায়, বৃষ্টি যেনো থমকে দাঁড়াতে চায়…..
…… বাবাকে জড়িয়ে ধ’রে পদ্মা কাঁদতে কাঁদতে বলতে থাকে….. ওরা আমাকে নষ্ট ক’রে দিলো…..
….. অপবিত্র ক’রে দিলো বাবা…..

শম্ভু নিজের মনকে শক্ত ক’রে নিয়ে উঠে দাঁড়ালো,
মেয়েকে সামনে দাঁড় করিয়ে বললো……
…… আত্মা কখনো অপবিত্র হয় না……
তোর আত্মা অপবিত্র হয় নি মা……
আত্মাকে কখনো স্পর্শ করা যায় না……
আর আত্মার খোলস হ’লো শরীরটা……এ তো নশ্বর
এ তো একদিন নষ্টই হ’য়ে যাবে মা…….
শম্ভু আবার বলতে লাগলো….. আত্মা কখনো অপবিত্র হয় না মা….. আত্মা কখনো অপবিত্র হয় না…..
বৃষ্টির জলে শম্ভুর চোখের নোনা জল ধুয়ে যেতে লাগল…… শম্ভু অস্ফুটে বলে…
“….অবিনশ্বর সদাদীপ্তিমান আত্মামহাদ্যূতি
চিরউজ্জ্বল চিরভাস্বর আত্মামহামতি…….”

Content Protection by DMCA.com

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here