নির্জনে নিরালায়
গোপা ব্যানার্জি
প্ল্যাটফর্মের বাইরে বেড়িয়ে অতনু মজুমদার স্যুটকেশটা রেখে, একটা সিগারেট ধরিয়ে লম্বা টান দিয়ে মুখ ভর্তি ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে মুচকি হাসতে লাগলেন নিজের ভাগ্যের ওপরে।
অতনু বাবু সরকারি অফিসে ক্লার্কের চাকরি করতেন। দুইছেলে দুইমেয়ে ও স্ত্রী এই নিয়ে ছিল তাঁর সুখের সংসার।
তবে সেই সুখ বেশিদিন সহ্য হল না অতনুর।
অকালে পত্নি বিয়োগে তিনি দিশেহারা হয়ে পড়লেন।
সুযোগের সদ্ব্যবহার সবাই করে। অতনুর বিধবা দিদি নিজের আইবুড়ো মেয়ে ও বেকার ছেলে কে নিয়ে পাকাপাকিভাবে জায়গা করে নিলেন ভাই অতনুর বাড়িতে।
অতনুও নিশ্চিন্ত হলেন এই ভেবে ভালোই হলো এই চারটে মা মরা সন্তানরা পিসির স্নেহ মমতা ভালোবাসা পাবে এটা ভেবে।
অতনু স্বপ্নেও ভাবেননি যে তিনি খাল কেটে কুমির ঢুকিয়েছেন নিজের বাড়িতে। তাছাড়া ভাই বোনের সম্পর্ক যে স্বার্থের সম্পর্কে পরিনত হয় সেটাই বা মানুষ ভাববে কীকরে।
মানুষ যাই ভাবুক না কেন, সব সম্পর্কই এখন স্বার্থ নামক পাঁকের কাদা ডুবিয়ে দিচ্ছে মানবিকতাকে। দিদি আখের গোছাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন প্রথম দিন থেকেই।
অতনু নিশ্চিন্ত মনে সংসারের দায়িত্ব দিদিকে ছেড়ে নিজের অফিসের কাজে মনোযোগ করলেন। স্ত্রী মারা যাবার পর বেশ কিছুদিন টালমাটাল গেছে তার। অফিস সংসার সন্তান সব মিলিয়ে ভীষন সংকটজনক অবস্থায় দিন কাটছিল তাঁর। অফিসের সহকর্মীরা এমনকি বস পর্যন্ত খুব সাহায্য করেছেন তাঁকে এই অসময়ে, তাই এবার অনেকটা সময় দিচ্ছেন অফিসে। তাতে সবাই খুব খুশি। সংসারের খরচা বেড়ে যাওয়ায় অফিসের পরে কিছু ছেলে মেয়েকে পড়াতে শুরু করলেন , একটা টিউটেরিয়াল হোমে।
কালেরগতি সব ভুলিয়ে দেয়। অতনু বাবুর ছেলে মেয়েরা বড়ো হতে লাগলো, দিদির ইচ্ছে পূরণ করতে যথা সম্ভব খরচা করে ভাগ্নির এক ইঞ্জিনিয়ার পাত্রের সাথে বিয়ে দিলেন। ভাগ্নে দিন দিন বকাটে হয়ে যেতে লাগল কিন্তু দিদি নিজের ছেলের সমস্ত দোষ চেপে গিয়ে সব দোষ অতনুর ছেলেদের নামে ভাইএর কান ভরতে লাগলেন।
মধ্যে অনেক গুলো বছর পেরিয়ে গেল, অতনুর বড়োছেলে এখন সরকারি ব্যাংকে চাকরি করে অার ছোট ছেলে কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার। দুজনের বিয়ে দিয়েছেন অতনু। বড়ছেলে দিল্লি ও ছোটো ছেলে আমেদাবাদ থাকে নিজেদের পরিবার নিয়ে।
বড়ো মেয়ে ইস্কুল শিক্ষিকা,জামাই ব্যাংকে চাকুরী করে । ছোটো মেয়ে ও জামাই দুজনেই সরকারি চাকরি করে।
ভাগ্নে বিয়ে করে দিদিকে নিয়ে নতুন কেনা ফ্লাটে উঠে গেছে। আর অতনু?…………
বাবু কোথায় যাবেন? রিক্সাওলার ডাকে চমকে উঠে বর্তমানে ফেরেন অতনু।
হার্টের রোগে আক্রান্ত অতনু, ছেলে মেয়েরা কেউ বাবার বোঝা নিতে চায় না
সন্তানদের মনোভাব বুঝে ফেলেই ঘর ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন আর তাই কাউকে কিছু না জানিয়ে খবরের কাগজে
এই ঠিকানায় সব বন্দোবস্ত করে সব ফেলে চলে এসেছেন ‘নিরালা’ বৃদ্ধাশ্রমে।
রিক্সায় উঠে বসতে বসতে অতনু বল্লেন
”চল বাবা ,আমার শেষ ঠিকানা বৃদ্ধাশ্রমে আমাকে পৌঁছেদে”।
দিদির লেখা বরাবরই মনে দাগ কাটে।আজও ব্যতিক্রম নয়।