ওপার বাংলার সমাজ আদৃত লেখক-অজন্তা প্রবাহিতার স্বপ্নীলের স্বপ্নভঙ্গ এর ভিন্ন ধর্মী ছোট গল্প “কাকু”

1380
অজন্তা প্রবাহিতার স্বপ্নীলের স্বপ্নভঙ্গ এর ভিন্ন ধর্মী ছোট গল্প “কাকু”

কাকু

অজন্তা প্রবাহিতা


“এই কাকু! কা– কু !”
“তুই কার কাকু রে ? আমাদের সবার?”

আমার নাম ‘কাকু’ না। আমার নাম স্বপ্নীল ।আমার মা এই নাম রেখেছিলো।তোরা আমায় ‘কাকু’ বলে ডাকবি না।’স্বপ্নীল’ বলে ডাকবি।
নাক ফুলিয়ে, দাঁত খিঁচিয়ে, ঘুষি পাকিয়ে, ফোঁস ফোঁস করতে করতে কথা গুলো বলে দশ বছরের ছেলেটা।
সমবয়সী ছেলেরা সবাই ওকে ‘কাকু’ বলে ডেকে পেছনে লাগে।শ্যামলা বরণ, ময়লা ফুল প্যান্ট,রং চটে যাওয়া টি শার্ট,উস্কোখুষ্ক চুল,হাত পা নোংরা সারাদিন পাড়ার এ- গলি, ও গলি ঘুরে বেড়ায় এই স্বপ্নালু চোখের বাচ্চা ছেলে।
কেউ চিনতে পেরে আদর করে যদি কিছু খেতে দেয়,তাহলে ওর খাওয়া হয়,
নইলে বাড়িতে খাবার জুটবে কী না তার কোনো নিশ্চয়তা নেই।
এক সুন্দর অভিজাত বাড়ির উত্তরাধিকারী এই স্বপ্নীল ।
মাতৃপক্ষ ও পিতৃপক্ষ দুইই সম্ভ্রান্ত পরিবার। বাবা শিক্ষক। তবুও কেন যে এই শিশুটির এমন অবস্থা ,কেউ জানে না।
ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতেই গুটি গুটি পায়ে বেড়িয়ে পড়ে উদার আকাশের নীচে। পায়ের কাছে ঘুরঘুর করে ‘লালী’ (রাস্তার সারমেয় )। কখনো রাস্তার ওপর বসে লালীর গলা জড়িয়ে ধরে চেষ্টা করে নিজের কষ্ট গুলো বলার।
লালীও কখনো কুঁই কুঁই করে কখনো আবার নীরবে চোখে চোখ রেখে সব কথা বোঝার ও উত্তর দেবার চেষ্টা করে ।
-“জানিস লালী,প্রায় পাঁচ বছর আগে হঠাৎ একদিন দুজন পুলিশ এসে বাড়ি থেকে মাকে জোর করে ধরে নিয়ে যায়।
মা— মা—মা — কোথায় যাচ্ছো। মাকে জিজ্ঞেস করলাম।
হাজার চেষ্টা করেও ঠাকুমার হাত থেকে ছাড়া পেলাম না।একবার যদি মাকে আটকাতে পারতাম,আমি পুলিশ কাকুদের সাথে মা-কে যেতে দিতাম না।আমার মা চোর না ডাকাত? কি করেছে আমার মা? “
“ও বাবা !” বাবাকে ডাকাডাকি করলাম কত !
বাবাও উত্তর দেয় না। ভাবলেশ হীন মুখে উদাসীন নেত্রে বাবা বারান্দার এক কোনায় দাঁড়িয়ে ছিল।
মনে হচ্ছিল যেন, বাবা মনে মনে বেশ খুশী হয়েছিল মায়ের দুরবস্থা দেখে।মাকে বিপদ থেকে বাঁচানোর তাগিদ কারো ছিল না।
শুধু মনে পড়ে,ভরা নদীর স্রোতের মতো মায়ের চোখে জল গড়িয়ে পড়ছে,ঠোঁট দুটো সাদা,কথা বলবার চেষ্টা করছে কিন্তু একটা শব্দও ফুটছে না। মনে মনে আজও জিজ্ঞেস করি ,
“মা ! তুমি কী এমন করেছিলে যে সেদিন পুলিশ এসে তোমায় টানতে টানতে থানায় নিয়ে গেল।চোখের সামনে আমার ছোট্ট পৃথিবী তছনছ হয়ে গেলো।”
তুমি জেলে যাবার পর থেকে পিসী আর আমার সময়মতো খাবার জুটতো না। বাবা, ঠাকুমা হোটেল থেকে খাবার খেয়ে নিত।কোনোদিন ঠাকুমা মনে করে খাবার নিয়ে এলে খেতাম নইলে নয়।বাড়িতে রান্নাবাড়ীর কোনো বিশেষ জোগাড় ছিল না।
অনাহারের সাথে লড়াই করতে করতে পিসী একদিন হার মেনে নিয়ে চলে গেল না ফেরার দেশে।
আমি রয়ে গেলাম একা।
মা জেল থেকে ফিরে এলো না।
পাড়ার লোকেরা বলে,মা চলে গেছে নিরুদ্দেশে, কেউ বলে মা আর পৃথিবীতে নেই।কার কথা বিশ্বাস করি, জানিনা । সবাই বলে বড় হলে বুঝবো।কবে বড় হবো কে জানে!,
মা আদর করে ডাকতো “স্বপ্ন”। মায়ের মুখখানা বড্ড মনে পড়ে।যদিও এখন অনেকটাই আবছা।কিন্তু মায়ের নরম কোলটা এখনো অনুভব করি।
লালী জুলজুল চোখে ওর দিকে তাকিয়ে থাকে, বোঝে না কি করে বন্ধুর দুঃখ কমাবে।
কুইই ইই — ইইইই — আওয়াজ করে ওর গালে মুখে চেটে দেয়।
— তুই আমার বোন,না রে লালী।
তোরও কেউ নাই,আমারও কেউ নাই।
স্বপ্নর পিঠ ঘেঁষে দাঁড়ায় লালী। গালে গাল ঠেকাবার চেষ্টা করে,লেজ নড়ছে অনবরত,চারপাশে গোল গোল ঘুরে আবার পাশে গিয়ে বসে।
একহাতে ওকে নিজের আরো কাছে টেনে নিয়ে গায়ে হাত বুলাতে বুলাতে স্বপ্ন বলে,
-জানিস, আমি ছোটবেলায় সবকিছুকে ‘কাকু’ বলতাম,সেই থেকে পাড়ার ছেলে ছোকরা গুলো আমায় ‘কাকু’, বলে।আমার নামতো, স্বপ্ন। মানে ‘ড্রিম’।
ছোটবেলায় ছাদে মায়ের কোলে শুয়ে শুয়ে যখন তারা দেখতাম,মা বলতো,ওই তারা গুলো আমাদের সব স্বপ্ন পূরণ করে। মা-ও একদিন স্বপ্ন দেখেছিল একটা ছোট্ট তারা মায়ের কোলে আসবে, সেই তারাটাই আমি।
এখন আমি তারাগুলোকে বলি,আমার মা-কে ফিরিয়ে দাও।
দেখতে দেখতে কত সময় পেরিয়ে গেলো। মা আর ফিরে এলো না।
কিছুদিন আগে , বাবা নতুন মা নিয়ে এলো।
জানিস লালী,নতুন মাকে দেখে আমার খুব আনন্দ হয়েছিল।নতুন মায়ের নাম ‘নিশা’। নিশা মানে রাত্রি ।আমি জানি।
আর আমার মায়ের নাম ছিল ‘কৃষ্ণা’।
মা কী সুন্দর গান গেয়ে আমায় ঘুম পাড়াতো।
ভেবেছিলাম, নতুন মা-ও তাই করবে।আমায় স্কুলে পাঠাবে,পড়াশুনা করাবে, সময়মতো খেতে দেবে।
কিন্তু,কোই সেরকমতো কিছুই হলো না রে !
সন্ধেবেলা বাবা বাড়ী ফিরলে মা দরজা দেয়।আমি আর ঠাকুমা বাইরে বসে থাকি।মা কোথাও গেলে রান্নাঘরে তালা লাগিয়ে যায়। আমার একটা দিদিও আছে। নতুন মায়ের মেয়ে। ও দিদার বাড়ী থাকে। স্কুলে পড়ে।
ওই দিদি যখন বাড়িতে আসে, মা কত কী রান্না করে খাওয়ায়।
আমার থালায় শুধু আসে ডাল আর ভিনডি ভাজা।
খেতে ভালো লাগে না।তাও খাই।নাহলে মা চ্যালা কাঠ দিয়ে হাঁটুতে মারে।আমার খুব ব্যাথা হয়। হাঁটতে কষ্ট হয়। আমি কাঁদি না । কাউকে নালিশও করি না।
আমার মা শিখিয়েছিল,”সইতে হয়। যে সয়, সেই রয়।আমিও ব্যাথা সই। “
ঠাকুমা আমার হয়ে কিছু বললে ঠাকুমাকে ঘরে বন্ধ করে দেয়।
ঠাকুমা বুঝতে পারে,নিজের ভুলেই আজ তার এমন দশা।
আমি বড় হলে আর্মি অফিসার হবো,ইয়াহ বড় ‘গান’ থাকবে আমার হাতে ।আমার মা কে খুঁজে নিয়ে আসবো।
আর্মির ‘তাকাত’ পুলিশ থেকেও বেশী।
আমার সব স্বপ্ন পুরো হবে দেখিস লালী।
আকাশে মেঘ ডাকে গড়গড়,গুড়গুড় ।বোধহয় বৃষ্টি হবে।
লালী কুঁই কুঁই করে স্বপ্নের কোলে মুখ গোঁজে।
কে জানে স্বপ্নীলের স্বপ্ন কোনোদিনও পূর্ণ হবে কী না। নাকী কালচক্রে পরিস্থিতির কবলে পড়ে ও নিজেও আকাশের তারা হয়ে যাবে।
কেউ জানে না ওর ভবিষ্যত ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here