লাকী ফ্লোরেন্স কোড়াইয়া এর ভিন্নমাত্রার ধারাবাহিক রহস্যময় গল্পের ”তিনি একজন” ৩ খন্ড একত্রে পাঠকদের অনুরোধে পুনরায় প্রকাশিত হোল ।

1310
লাকী ফ্লোরেন্স কোড়াইয়া

     তিনি একজন

                 লাকী ফ্লোরেন্স কোড়াইয়া

এরপর আমি আর পিছন ফিরে তাকাইনি।নানান জনের নানান কথা।রাস্তাটা ভাল না।অশুভ শক্তির প্রভাব আছে।কারো কথা কানে তুলিনি। একে তো অপরিচিত জায়গা,তার উপর আবার সন্ধ্যার সময়। এই বুঝি সামনের জঙ্গলটা পার হওয়ার আগেই সূর্যকে গ্রাস করবে অন্ধকার। আমার সঙীরা সাহসী নয,কিন্তু হাঁটতে পটু!!! এই কাজটিতে আমি বড়ই দৃর্বল।হঠাৎ বাঁ দিকে চোখ পড়তেই খুশি হলাম।এই যে কালী মন্দির।তাহলে বাসস্ট্যান্ড আর দূরে নয় রে!সাথে সাথেই  সীতা বলে ওঠল,হ্যা, তা তো দেখলাম।আরো কত কিছুই তো দেখব!রাস্তায় লোকগুলি তো বলেই দিল।রুহি বাধা দিয়ে বলল,শুধু কি আমরাই যাচ্ছি নাকি? আরো কত লোকই তো যাচ্ছে এ রাস্তা দিয়ে।সীতা বলল,ওরা তো য্যাচ্ছে বাসে।আমাদের মত তীর্থ যাত্রী হয়ে নয়। আমি বাধা দিলাম না।মনে মনে ভাবলাম,ওদের কথায় নির্জন এই জঙ্গলের। পরিবেশ একটু মেতে থাকুক।আশেপাশে যদি তেনাদের(অশুভ শক্তি)আনাগোনা থাকে তবে তেনারা ও সাবধান হয় যাক ওদের মৃদু আলাপনে।আর সময়টা ও পার হয়ে যাবে।এতক্ষণে সাজেক মুখ খুলল,তীর্থযাত্রী তো বটে-ই।এই আমাকে দেখ।নিজের ব্যাগ তো বহন করছি-ই আবার আমাদের লেখিকার ব্যাগ ও আনন্দের সহিত বহন করছি।তবুও নীরবে পথ চলছি আর মনে মমনে বলছি, এই পথ যদি না শেষ হয়,তবে……সাজেককে থামিয়ে দিয়ে শান্ত স্বভাবের অসিত বলে উঠল,তা তো করবেই।

লেখিকা বললে তো তুই তোর লুকানো কলিজাটা ও দিয়ে দিতে পারবি,সে কথা কে না জানে?এই ভালো হবে না বলছি-সাজেক দাঁড়িয়ে গেল।অসিত কিছু একটা বলতে যাবার আগেই বাসস্ট্যান্ডের আলো চোখে পড়ল। আমরা এগিয়ে যেতেই কয়েকজন আমাদের দিকে জিজ্ঞাসার দৃষ্টিতে তাকালো। সাজেক পাঁচটি টিকিট কেটে আনল।বাস আসতে দেরি হওয়াতে সবাই চা খেতে চাইল।সাজেকের হাত থেকে ব্যাগ নিয়ে পানির বোতল আর এক প্যাকেট বিস্কুট বের করে ওদের দিলাম।আর এই খাবারের ব্যাগ রাখা নিয়েই বেচারা সাজেককে কত অপবাদই না সহ্য করতে হয়।কোন বিষয়ে লেখার জন্য ছুটির সময়টা বেছে নিই যেন ওরাও আমার সাথে যেতে পারে।আমার ও সময়টা বেশ ভালোই কাটে।এ সময়টাতে অতি আনন্দের সাথে সাজেক আমার খাবারের ব্যাগ রাখে।আজোও তাই হল।

আমি বাইরের খাবারে অভ্যস্ত না হওয়াতে ওদের থেকে দুরেই রইলাম।মিনিট দশেকের মধ্যেই বাস চলে এল।সবাই উঠে গেলাম বাসে যাত্রী সংখ্যা ১৫/২০ হবে।আমার পাশের সিট খালি।জানালা দিয়ে বাইরে তাকালাম।বাস চলতে শুরু করল।এর মধ্যে অনেকেই ঝিমুতে শুরু করল।আগেই জেনে নিয়েছিলাম আমাদের পৌঁছাতে প্রায় চারঘন্টা লাগবে।তার মানে আমাদের বাংলোতে পোঁছাতে রাত ১০:০০ টা বেজে যাবে।আগের বাসটি নষ্ট হয়ে যাওয়ায় আমরা অনেক পিছিয়ে গেলাম।যা হোক।যা হবার হয়ে গেছে।এখন সময়ের বিলাপ করে লাভ নেই।
ঘড়ি দেখলাম।সময় ৭:২৫ মিনিট। জানালা দিয়ে আকাশের দিকে তাকালাম।আকাশটা কেমন যেন অচেনা মনে হতে লাগল।অন্ধকারে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম আকাশে মেঘ জমেছে।দুইপাশে ঘন জঙ্গল। কখনো কখনো গাছের ফাঁক দিয়ে হালকা ভাবে রাতের আকাশের অলংকার আমাদের একমাত্র উপগ্রহ ঐ চাঁদখানা দেখা দেয়।মনে মনে বললাম ,জেগে থাকো চাঁদ।মেঘের আড়ালে নিজেকে হারাতে দিও ননা।এই অন্ধকারে আশার আলো দেখাও।এখনিই নিভে যেও না।বৃষ্টিকে থামাও। দারুণ আপনার চিন্তা ভাবনা-পাশ থেকে একটি অপরিচিত কণ্ঠ স্বর শুনে চমকে উঠলাম।এতিক্ষণে বাইরে তাকিয়ে থাকায় বুঝতে পারিনি আমার পাশে কেউ বসেছে।তাকিয়ে দেখলাম একজন ভদ্রলোক বসা।বয়স অনুমান করা কঠিন।সহাস্যমুখ আর অদ্ভুত দৃষ্টি।
প্রথম দর্শণে ভাল লাগার মত একজন তিনি।আর তিনি যে জ্ঞানী, দৃষ্টি যেন তার জলন্ত প্রমাণ। আমাকে ঘাবড়ে যেতে দেখে তিনি বলে উঠললেন,সরি এভাবে হটাৎ কথা বলার জন্য।তাঁর পরিচয় না জনতে চেয়েই জিজ্ঞেস করলাম,আমার চিন্তা-ভবনার কথা আপনি জানলেন কি ভাবে?তিনি হাসলেন।অদ্ভুত সুন্দর হাসি।তাঁকে চেনার বা মনে করার চেষ্টা করলাম-কখনো কোথাও দেখেছি কিনা!পারলাম না।আপনি চাঁদের সাথে কথা বলছিলেন।দারুণ!আমিও তাই করতাম এক সময়।কেমন যেন অনেকটা ঘোরের মধ্যে যেন কথা বললেন তিনি।অদ্ভুত ব্যাপার।

আমি ভয় পেয়ে গেলাম।আমার মনের কথা উনি জানলেন কি ভাবে?উনি কি মানুষ!নাকি রাস্তায় যা শুনেছি তিনি সেই রকমের কেউ!!উনাকে ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছে হল।আবার হাসলেন তিনি।বললেন,অবাক হবার কিছু নেই।আপনি যেটা মনে মনে ভাবছিলেন অজান্তেই সেটা মুখ দিয়ে বলছিলেন।কিন্তু আপনি খেয়াল করেননি।আমি যুক্তি খাটালাম,না না তা হবে কেন?এবার তিনি মহা জ্ঞানী শিক্ষকের মত বললেন,প্রকৃতির সাথে যখন মানুষ একাত্ম হয়ে যায়,তখন অনেক কিছুই সম্ভব হয়।তখন প্রকৃতি তার কাছে একটি জীবন্ত সত্তা হয়ে উঠে। সে এক ধ্যানের আর জ্ঞানের  সমন্বয়ে মানুষ।  বাস্তবতা থেকে নিজেকে অনেক দূরে সরে যায়।আপনার বেলাতে ও তাই হয়েছে।সুতরাং অস্বীকার করার কোন উপায় নাই আপনার।আমি মন্ত্র মুগধ হয়ে শুনছিলাম তাঁর মধুর বচন আর মেনেই নিলাম তিনিই সঠিক।ভাবছি এত সাবলীল ভাষায় কথা বলা এই সুদর্শণ পুরুষ মানুষটি কে?বাংলার শিক্ষক?নাকি দর্শণের নাকি মনোবিজ্ঞানের শিক্ষক?আমার ভাবনার ছেদ ঘটালেন তিনি।জানতে চাইলেন,লেখালেখি করেন? ছোট্ট করে উত্তর দিলাম,চেষ্টা করি।হাসলেন তিনি।আমি মুগধ হলাম তাঁর হাসিতে।মানুষের হাসি এত সুন্দর হয়? প্রশ্ন করলাম নিজেকে।জানতে চাইলাম,কি করে বুঝলেন?কিছু মনে করবেন না,কিছুক্ষণ আগে আপনি কাউকে মেসেজে লিখেছিলেন- এবারের লেখাটা দিয়ে তোদের চমকে দিব।সম্পুর্ন অন্যরকম একটি লেখা উপহার দিব পাঠকদের।কথা থামিয়ে দু:খ প্রকাশ করলেন মেসেজটা পড়ার জন্য।
উনি লেখাটা পড়েছেন এটা নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছি না।কিন্তু উনি পাশে বসেছেন অথচ আমি খেয়াল করিনি সেটাই আমার কাছে আশ্চর্য জনক মনে হল।ভাল লেখেন আপনি,ঠিক কিনা?

এবার আমি মৃদু হাসলাম।বললাম,সেটা পাঠকের উপর ছেড়ে দিয়েছি।আমি তো পাঠক নই,তাই তো জানতে চাইছি।তবে এবারে আপনার লেখাটা সত্যি দারুণ চমক দিবে।আমি আবার হাসার চেষ্টা করলাম।পারলাম না।তিনি সেটা লক্ষ্য করলেন।উপদেশের স্বরে বললেন,মনের উপর বা ব্রেনের চাপ প্রয়োগ করে কোন কিছু করা উচিৎ নয়।যেমন চিন্তা করে গল্প,কবিতা বা উপন্যাস লেখা যায় না।এক্ষেত্রে কলম চলে আপন গতিতে।আবার কাউকে উপহার দিতে গেলে ভেবে-চিন্তে দিতে হয়।অনেক চিন্তা করেও প্রয়োজনীয় কথা মনে করতে পারি না।
আবার কখনো অপ্রয়োজনীয় কত কথা মনে পড়ে,কত স্মৃতি মনে ভেসে ওঠে।পৃথিবীতে অনেক সত্য আছে যা না জানাই ভাল,আবার সব প্রশ্নের উত্তর পেতেই হবে এমন ভাবাটা ও ভুল। অদ্ভুত জীবন মানুষের।কথা শেষ হতেই জোরে ব্রেক কষলো বাস।।চালক সাজেককে লক্ষ্য করে কিছু বলল।সাজেক চালকের কাছের সিটেই বসেছিল। উঠে দাঁড়িয়ে আমাদেন ইশারায় ডাকল সাজেক।দাঁড়িয়ে পাশ ঘুরে জানালার পাশে রাখা হাত ব্যাগটা তুলে নিয়ে বাঁ পাশে তাকাতেই নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারলাম না। বিদ্যুতের শক খাওয়ার মত অবস্থা হল!

শূণ্য জায়গা।বাম পাশ থেকে ডান পাশে মাথা ঘুরাতেই কেউ অদৃশ্য হতে পারে -জীবনে প্রথমবার এমন ঘটনার সাক্ষী হলাম!মনটা কেমন যেন আধারে চাপা পড়ে রইল।এত সময় একসাথে এলাম অথচ উনার নাম ধাম বা পরিচয় কিছুই জানা হল না।বাস থেকে নেমেই এদিক-ওদিক তাকালাম।কিন্তু উনার দেখা পেলাম না।রাত হয়ে যাওয়ায় আমরা একটা ভ্যানে চেপে বসলাম।মেইন রাস্তা থেকে সরু এএকটা রাস্তা নেমে গেছে। দুই পাশে শালবন।শালবনের ভিতর দিয়ে পাঁচ মিনিটের মধ্যেই এসে থামলাম সুন্দর আলোকিত বাংলোর সামনে।গেটের উপর বড় বড় অক্ষরে শোভা পাচ্ছে বাংলোর নাম”নির্জন বিলাস”।

বাংলোর ম্যানেজার রোহান হাসি মুখে এগিয়ে এল।আমার অফিস কলিগ রোমানার চাচাতো ভাই রোহান।হাসি মুখে অভ্যর্থনা জানালেও মুখটা বড়ই ম্লান দেখালো রোহানের।জিজ্ঞেস করল, কেমন আছেন আপা?ভীষণ ভাল।উত্তর দিয়ে ওদের সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলাম। অসিত আর সাজেকের সাথে হাত মিলালো রোহান।আমরা রুম নিয়েছি তিনটা।সীতা আর রুহি, অসিত আর সাজেক।ব্যস হয়ে গেল। রোহান ওদের চাবি বুঝিয়ে দিয়ে রুম দেখিয়ে দিল।আমি চলে এলাম আমার রুমে।

ফ্রেস হয়ে ১০:৩০ মিনিটে সবাই হাজির হলাম ডাইনিং রুমে।খাবার দেখে সবার চোখ কপালে উঠে গেল।গরুর মাংসের কালো ভুনা,আলুর ভর্তা, বেগুন ভাজা আর মাখা ডাল।অসিত আর সাজেক হুমরি খেয়ে পড়ল।আমি বসতেই রোহান একটি বাটি এগিয়ে দিয়ে বলল,আপা,এটা আপনার জন্য।বাটির ঢাকনা খুলে আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞাসার দৃষ্টিতে রোহানের দিকে তাকাতেই রোহান বলল, রোমানা আপা বলেছেন, আপনি ভাত খান না,কিন্তু চালের রুটি খুবই পছন্দ করেন।সাথে সাথেই সাজেক বলল,তবে আমরাই বা বাদ যাই কেন?ওরা সবাই একটি করে রুটি নিয়ে নিল।আমরা সময় নিয়ে গল্প করে খেলাম।

খাওয়ার সময় সাজেক জানিয়ে দিল আগামীকাল সকালেই অসিতকে সাথে নিয়ে সে তার অফিসের প্রজেক্ট গুলো দেখতে যাবে।কেননা সাজেকের এখানে আসার বড় কারণ হল এই প্রজেক্টগুলো পরিদর্শন। খাওয়া শেষ করে আর সময় নিলাম না।চলে এলাম যার যার রুমে।রুমে এসেই জানালার পর্দা সরিয়ে দিলাম।দক্ষিণের দিকটা খোলা।তবে বাংলোর চারদিকে দারুণ শাল বাগান।শাল বাগানেরর ভিতর সুন্দর “নির্জন বিলাসে”আমাদের প্রথম রাত।পর্দা সরিয়ে দিতেই এক ঝাপটা বাতাস যেন বলে দিল,”নির্জন বিলাসে”স্বাগতম! হাসির রেখা খেলে গেল ঠোঁটের কোণে।

ভাবুক মন!ভেবে যাও।দৃষ্টি ছড়িয়ে দিলাম জানালার বাইরে।আকাশে হঠাৎই ধরা দিল রুপালি চাঁদ। আহা!কী অপূর্ব।আলো রেড়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে।চাঁদের আলোয় শাল বাগানটা অদ্ভুত সুন্দর লাগছে।মনে পড়ে গেল বাসের সেই অদ্ভুত বুদ্ধিমান লোকটির কথা।সরে এলাম জানালা থেকে।ব্যাগ থেকে কাগজ আর কলম বের করে বিছানার পাশে রাখা টেবিলটাতে সাজিয়ে রেখে বিছানায় হেলান দিয়ে বসলাম।কে সেই মানুষ?নামই বা কি?মনে মনে তাঁর একটি নাম দিলাম”কুয়াশা মানব”।

বিছানায় যাওয়াতে ক্লান্তি জড়িয়ে ধরলসমস্ত শরীরটাকে।আকাশটা কালো হতে লাগল চোখের পলকে।চাঁদের আলো নিভে যাচ্ছে।মঞ্চের ভারি পর্দার মত অন্ধকার যেন চাঁদকে ঢেকে দিচ্ছে।আমি চলে যাচ্ছি অন্য জগতে।কানের কাছে কেউ ফিসফিস শব্দে বলে উঠল,জেগে থাকো চাঁদ,এই অন্ধকারে হারিয়ে যেও না।চমকে উঠলাম আমি!এই কণ্ঠ আমার অনেক পরিচিত। তবে কি তিনি এসেছেন?অনুভব করলাম খুব কাছেই কেউ একজন আছেন।কেউ একজন আমাকে দেখছেন।চোখ খোলার চেষ্টা করলাম।কিন্তু পারলাম না।আধারে তলিয়ে যেতে লাগলাম!!!

পাখির কিচির মিচির শব্দে ঘুম ভেংগে গেল।চোখ মেলে প্রথমে চমকে উঠলাম।লাফ দিয়ে উঠে বসলাম।কোথায় আছি বোঝার চেষ্টা করলাম।মনে পড়ল গতরাতের কথা।ফুলের মিষ্টি সুবাস পেলাম।কি ফুল মনে করতে পারলাম না।দূরের শালবনের চিকন মসৃণ মেঠো পথটা অস্পষ্ট ভাবে ধরা দিল।ভোরের এই মিষ্টি হাওয়া আর নির্জন রাস্তায় হাঁটার লোভ সামলাতে না পেরে ফ্রেশ হয়ে শালটা গায়ে জড়িয়ে বেড়িয়ে পড়লাম।খানিকক্ষণ হাটাঁহাঁটি করলাম সাদা মসৃণ মেঠোপথ ধরে। সাতটা পঁচিশ বাজতে দেখে ফিরে এলাম বাংলোতে।দো’তালাতে উঠতে যাবো,এমন সময় পিছন থেকে রোহানের গলা শুনতে পেলাম।আপা,কফি চলবে?পিছন ফিরে রোহানকে গুড মর্নিং দিয়ে বললাম,কফি হলে মন্দ হয় না।আমরা কফি নিয়ে বসতেই ওরা সবাই নিচে নেমে এল।সুতরাং একসাথে সকালের নাস্তা সেরে নিলাম।সাজেক খুব দ্রুত নাস্তা শেষ করে অসিতকে নিয়ে বেড়িয়ে পড়ল।সীতা,রুহি আর আমি রোহানের সাথে বাজারের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম।

সন্ধ্যার সময় রোহান জানালো পাশেই কলেজের মাঠে পূজোর উৎসব হবে।আমরা সবাই গেলাম রোহানের সাথে।কলেজের মাঠে পা দিতেই মনে হতে লাগল জায়গাটা বেশ পরিচিত।আগে কখনো এসেছি কিনা মনে করার চেষ্টা করলাম।না মনে পড়ছে না।হঠাৎ একটা পরিচিত কণ্ঠ কানে এল।মনের বা ব্রেনের উপর চাপ প্রয়োগ করে কোন কাজ করা উচিত নয়।আর এর ফলও ভালো হয় না।কে বলল?সাথে সাথে ঘাড় ঘুরালাম।কেউ নেই তো!পরক্ষণেই বুজতে পারলাম সামনের মঞ্চ থেকে ভেসে এসেছে কথাটা।মঞ্চে নাটক হচ্ছে।একজন সাধু তাঁর এক শিষ্যকে উপদেশ দিচ্ছে।কিন্তু আমার মন সেদিকে দিতে পারলাম না।কথাটা তো গতকাল রাতে তিনি আমায় বলেছেন।তবে আজ……কি মনে হতেই হাত ঘড়িটার দিকে তাকালাম।সময় টা ও যেন ঠিক মিলে গেল।সন্ধ্যা ৭:২৫ মিনিট। বুঝতে পারলাম না কেন ৭:২৫ মিনিটে আটকে যাচ্ছি!তবে এটা কী অদ্ভুত কোন ঘটনা?কেউ লক্ষ্য করছে কিনা জানি না। বুঝতে পারছি না।আমি ঘামতে শুরু করলাম।নীলদাঁড়া বেয়ে ঘাম নিচের দিকে নেমে যাচ্ছে।পরিবেশটা অসহ্য মনে হচ্ছে।মুহুর্তেই যেন সব পালটে গেল।চারিদিক অন্ধকার হয়ে গেল।আসেপাশে কেউ নেই। সামনে আলোকিত মঞ্চ।মঞ্চে তিনি দাঁড়িয়ে আছেন।মাঠে আমি একা।তিনি বলে চলছেন,পৃথিবীতে অনেক সত্য আছে,যার উত্তর না জানাই ভাল।আবার সব প্রশ্নের উত্তর পেতে হবে, এমন ভাবাটা ও ভুল।অদ্ভুত জীবন মানুষের!আগের মতই অদ্ভুত আবেগী কণ্ঠে বললেন,আপনার এবারের লেখাটা সত্যি খুব ভালো হবে।কাঁপুনি দিয়ে জ্বর অনুভব করলাম।হয়তো জ্ঞান হারাচ্ছি।হঠাৎ কাঁধে প্রচন্ড ঝাঁকুনি অনুভব করলাম।চমকে ফিরে তাকালাম।যেন কতবছর পর ঘুম থেকে জেগে উঠলাম।কি রে ফ্লোরা,কোন জগতে আছিস্?এত মনোযোগ দিয়ে কী দেখছিস শূন্য মঞ্চে?কেমন একটা হাস্যকর কণ্ঠেই জিজ্ঞেস করল সীতা।কী জবাব দিব,ভেবে পেলাম না।বললাম-হুম,চল যাওয়া যাক।বাংলোতে ফিরে ওদেরকে জানিয়ে দিলাম আমি রাতে খাবো না।বলেই চলে এলাম উপরে আমার রুমে।প্রচন্ড ক্লান্তিতে যেন শরীর ভেংগে আসছিল।বিছানায় গাঁ এলিয়ে দিতেই একরাশ সাদা কালো ঘুম এসে ভাসিয়ে নিয়ে গেল ঘুমের অতল পুরীতে।

পরদিন যখন ঘুম ভাঙলো,আমি নিজেই অবাক!সকাল৯:০০ টা!ফ্রেশ হয়ে নিচে নামতেই রুহি বলে উঠল,যাক্ বাবা,বেঁচে ফিরলি তাহলে!মানে? ভ্রু বাঁকা করে জানতে চাইলাম।সীতা বলল,একশবার ডাকাডাকি করেছি।মোবাইল টা দেখ,কতবার কল করেছি!মনে পড়ল,গতকাল রাতে তো মোবাইল ব্যাগ থেকে বের ই করা হয়নি।সে যা হোক,নাস্তা করে সবাই একসাথে বেড়িয়ে পড়লাম।অনেক ঘুরাঘুরি করলাম।ছবি তুললাম।দুপুরে বাংলোতে ফিরতেই সাজেক ফোন করে জানালো ওদের ফিরতে দেরি হবে।অজ্ঞতা আমরা লাঞ্চ সেরে নিলাম।রুহি ও সীতা ও চলে এল আমার রুমে।হঠাৎ আমার মোবাইল টা বেজে উঠল।রোমানা জানালো গত সপ্তাহের প্রোগ্রামের রিপোর্ট টা মেইল করে দিতে।আমি রিপোর্ট টা পাঠিয়ে দিলাম।ইতিমধ্যে ওরা ঘুমিয়ে পরেছে।আমিও চোখ বন্ধ করলাম।সাজেকের ফোনে ঘুম ভাঙলো।আমরা নিচে নেমে এলাম।দেখলাম ওরা তিনজন কফি নিয়ে অপেক্ষা করছে।সবাই মিলে দারুণ মজা করে খেতে লাগলাম।কফি খেতে খেতে মনে হল আজ খবরের কাগজ পড়া হয়নি।রোহানের থেকে কাগজটা চেয়ে নিয়ে পাশের টেবিলে চলে এলাম।ওরা কি নিয়ে গল্পে মজেছে।চারদিকে বেশ অন্ধকার মনে হল।কয়টা বাজে দেখার জন্য ঘড়িতে চোখ রাখলাম।আবার ও আৎকে উঠলাম।৭:২৫মিনিট! মনটা স্বাভাবিক করার জন্য খবরের কাগজে চোখ দিলাম।ঘেঁটে পড়তে লাগলাম।হঠাৎ একটি হেডলাইনের উপর।হেডলাইনটিতে লেখা “প্রথম মৃত্যু বার্ষিকী”। পাশে একজনের ছবি।সুন্দর চেহারার একজন মানুষের ছবি।বয়স ৩৫-৪০ হবে।বুদ্ধিদীপ্ত চোখ,গভীর দৃষ্টি ঠোঁটের কোণে লেগে আছে এক চিলতে রহস্যময় হাসি,যেন এক্ষুণি কথা বলে উঠবেন।নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছি না!আমার দেখা সেই তিনি!যার সাথে মাত্র দুইদিন আগে আমার কথা হয়েছে।সেই “অদ্ভুত রহস্যময় মানব “।নি:শ্বাস বন্ধ করে পড়তে লাগলাম।বড় করে লেখা-আজ বি এল কলেজের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক আবীর আহমেদ এর প্রথম মৃত্যু বার্ষিকী।এক বছর আগে আজকের দিনে সন্ধ্যা ৭:২৫ মিনিটে এক বাস দুর্ঘটনায় তিনি মৃত্যুবরণ করেন।বি,এল কলেজ মানে গতকাল আমরা যে কলেজেে অনুষ্ঠান দেখতে গিয়েছিলাম।এটা কি করে সম্ভব? অস্পষ্ট গলায় বলে উঠলাম।ওরা ফিরে তাকালো।ঝাঁকুনি দিয়ে জ্বর অনুভব করলাম।ওরা এগিয়ে আসতেই বলতে লাগলাম,গত পড়শু দিন বাসে উনার সাথে কথা বললাম!গতকাল মঞ্চে ও উনাকে দেখলাম!সেই চোখ,সেই মুখ,সেই হাসি…..ওরা হয়তো কিছু বলাবলি করছিল।শুনতে পাচ্ছি অনেক দূর থেকে একটি কণ্ঠ, আপনি তো লেখক,জানি এবার আমাকে নিয়ে লিখবেন।আপনার এবারের লেখার উপকরণ আমি-আবীর আহমেদ।লিখুন।জীবনে অনেক ঘটনা ই ঘটে যার সাথে বাস্তবের কেন মিল থাকে না।আবার সব প্রশ্নের উত্তর ও পাওয়া যায় না।সত্যি বলছি,আপনার এবারের লেখাটা অন্যরকমই হবে।নির্মল এক রহস্যময় হাসির রেখা যেন ছড়িয়ে পড়ল ছবির চারপাশে।আমর মাথাটা দুলে উঠল।চোখ ঝাপসা হয়ে এল।অনুভব করলাম আমি যেন হাওয়ায় ভেসে যাচ্ছি।হয়তো ওরা আমাকে দু’তালায় নিয়ে যাচ্ছে।বাস্তব থেকে বিচ্ছিন্ন হলাম।স্পষ্টই দেখতে পেলাম কোন এক জোছ্না রাতে উনি আমার মুখোমুখি।উনার সেই অদ্ভুত দৃষ্টি যেন আমাকে গ্রাস করছে ধীরে ধীরে আর আমি মিশে যাচ্ছি সহস্র তারার মাঝে!!!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here