শিক্ষা ব্যবস্থা এগিয়ে কিন্তু কাঠামোগতভাবে পিছিয়ে
সৈয়দা ইয়াসমীন
এটা নিশ্চিন্তে বলা যায় যে, উন্নতমানের একটা শিক্ষা-ব্যবস্থা আর তার সঠিক প্রয়োগের উপর একটা জাতির ভবিষ্যৎ-উন্নতি অনেকটাই নির্ভর করে। তাই তো আজীবন শুনে আসছি “শিক্ষা জাতির মেরুদন্ড”। সর্বশেষ জাতিয় শিক্ষানীতি ২০১০ এর মুখবন্ধে “শিক্ষা জাতির মেরুদন্ড” বিষয়ে সংক্ষেপে নিঁখুত বর্ণনা আছে কয়েকটি বাক্যে। অতি জনসংখ্যা অধ্যুসিত, নিম্ন-মধ্যবিত্ত আয়ের এই বাংলাদেশে সময় সাপেক্ষে বিভিন্ন পরিবর্তনের সাথে সাথে শিক্ষা ব্যবস্থায়ও এসেছে অনেক পরিবর্তন।
আমাদের দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়নে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তারা নিজেদের স্বার্থেই এদেশে শিক্ষা বিস্তারে নানান পদক্ষেপ নেয়। যার ফলস্রুতিতে ১৮১৩ সালের সনদের মাধ্যমে কিছু দায়িত্ব গ্রহন করে। ১৮১৭ সালে বাংলা ও ইংরেজির পাঠ্য-পুস্তক প্রনয়ণের উদ্যোগ নেয় তারা। তখন এই দেশের শিক্ষালয়ে কোন ছাপা বই ছিল না। স্লেট, ধুলো, চকখড়ি, ভুসোখালি ইত্যাদি ব্যবহৃত হত লেখার উপকরণ হিসেবে। তখন শিক্ষা-ব্যবস্থা একদিকে ছিল টোল, পাঠশালা, মন্দির-কেন্দ্রিক আর অন্যদিকে ছিল মাদ্রাসা আর মক্তব-কেন্দ্রিক।
তারপর থেকে ক্রমান্বয়ে উন্নতির পথে হাঁটছে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা।সময়চক্রে অনেক পরিবর্তন,পরিবর্ধন আমরা দেখতে পেয়েছি এই শিক্ষা ব্যবস্থায়।আর এ ক্ষেত্রে আমাদের দেশের অনেক জ্ঞানী,গুনীরা সময়ানুক্রমে নানান ভূমিকা রেখে গেছেন।
ক্রমহ্রাসমান বাজেট বরাদ্ধ পেয়েও এখন প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তির হার সন্তোষজনক (৯৯.৬%), ১ জানুয়ারী বই উৎসব, গড় শিক্ষার উর্ধ্বমুখী হার (৭২%),ঝরে পড়া হ্রাস (২১%), প্রযুক্তির সম্প্রসারিত ব্যবহার, বৃত্তি-উপবৃত্তির সীমানা বাড়ানো এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে।
২০১৬ সালের তথ্য মতে, সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যাই যথাক্রমে ৪০ ও ৮০ টি, তাছাড়া নারী শিক্ষা তুলনামূলকভাবে বেশি অগ্রসরমান, পাঠ্য-পুস্তকে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস সংযোজন, মাদ্রাসা শিক্ষাকে আধুনিকীকরণ, পরীক্ষায় নকলরোধে বহুবিধ উদ্যোগ, শেখ রাসেল ডিজিটাল ল্যাব
নামে ৭ হাজার ৭০০ ডিজিটাল ল্যাব তৈরি, হাজার হাজার বেসরকারি রেজিস্টার্ড প্রাথমিক বিদ্যালয়, সমগ্র দেশে উপজেলা পর্যায়ে একটি করে মাধ্যমিক বিদ্যালয় এবং কলেজ জাতিয়করণ এসব পদক্ষেপ সত্যিই প্রশংসার দাবি রাখে। চোখ বুজে মুখস্ত শিক্ষা এখন প্রায় বিলুপ্তির পথে। বহিঃবিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে আমাদের শিক্ষা-ব্যবস্থা।
কিন্তু হতাশার বিষয় হচ্ছে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে যে হারে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি আমরা দেখতে পাই,সেই হারে উচ্চশিক্ষায় দেখতে পাইনা।আজকাল পথে- ঘাটে সহস্র কোচিং সেন্টার গড়ে উঠেছে,শিক্ষার্থীরা বুঝে না বুঝে তাদের উপর নির্ভর হয়ে পড়ছে।এই নির্ভরযোগ্যতা কতটুকু ফলপ্রসু তা ও ভাবার বিষয়।কিছু প্রতিষ্ঠানে ভর্তির নামে বানিজ্য চলছে বলেও গনমাধ্যমে দেখা যাচ্ছে।
কিন্তু হতাশার বিষয় হচ্ছে, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে যে হারে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি আমরা দেখতে পাই, সে হারে উচ্চশিক্ষায় দেখতে পাই না। তাছাড়া বর্তমানে পথে-ঘাটে হাজারো কোচিং সেন্টার গড়ে উঠছে এবং শিক্ষার্থীরা বুঝে, না বুঝে তাদের উপর নির্ভর হয়ে পড়ছে। এই নির্ভরযোগ্যতা কতটুকু ফলপ্রসু তা ও ভাবার বিষয়। কিছু প্রতিষ্ঠানে ভর্তির নামে বানিজ্য চলছে বলেও গণমাধ্যমে দেখা যাচ্ছে।
যে বিষয়টা নিয়ে না বললেই নয়,আমাদের দেশের অভিভাবকদের মধ্যেও যেন একটা প্রতিযোগীতামূলক মনোভাব কাজ করছে যা আগে কখনও ছিল না।অনেক বছর পর গত বছর যখন দেশে গেলাম,আমি খুবই হতবাক ছিলাম যখন দেখলাম, কিছু বেসরকারী স্কুলে মায়েরা তাদের সন্তানদেরকে ক্লাসে প্রথম করানোর জন্য সন্তানের জায়গায় নিজেরাই যেনো পরীক্ষার্থী হয়ে যান।পরীক্ষা চলাকালীন সময়ে জানালায় অনবরত উঁকিঝুঁকি, এমনকি সুযোগ বুঝে নিজের হাত দিয়ে লিখেও দেয়া।ফলাফলের সময় সন্তান প্রথম না হলে শিক্ষকদের সাথে ঝগড়া করা। হাজার হাজার টাকার বিনিময়ে স্কুলের শিক্ষককে দিয়ে বাসায় প্রাইভেট পড়িয়ে লেখাপড়ায় পিছিয়ে থাকা সন্তানকে স্কুলে প্রথম করে নেয়া। আর এসব শিক্ষকরাও যেন হাতে আকাশ নাগাল পান। পাবেনই না কেনো, স্কুল থেকে যে সম্মানী পান, তা তো মনে হয় আসা যাওয়ার রিক্সা ভাড়াতেই চলে যায়। তাই পড়ালেখায় প্রথম হওয়া শিক্ষার্থীকে দ্বিতীয় করে টাকা খাওয়া শিক্ষার্থীকে প্রথম করে দিতে কুন্ঠিত হন না।
স্কুল প্রতিষ্টাতা ও প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্বে নিয়োজিত একজনকে দেখলাম, টেবিলের উপর পা উঠিয়ে বক্তব্য দিচ্ছেন সহকারী শিক্ষিকা আর অভিভাবকদের উদ্দেশ্যে। অভিভাবকদের সাথে রয়েছে আবার ক্ষুদে শিক্ষার্থীরাও। কি খারাপ ভাষায় তুই,তুমি বলে উনি বকাবকি করছিলেন সহকারী শিক্ষিকাদেরকে।তখন বাচ্চারা মাকে ধরে ভয়ে জড়সড়। আমি এসব অসংগতি নিতে পারিনা,বরাবরই একটু স্পষ্টবাদী।
বললাম,ক্ষমা করবেন; এই ছোট ছোট বাচ্চারা এখানে আসছে কিছু শিখার জন্য কিন্তু আপনার কাছে কি শিখছে বলুন তো? স্কুল কি করেছেন শুধু বানিজ্য করার জন্য? উনি খুব রেগে গিয়ে উত্তর দিলেন, আপনি বাইরে থাকেন,আপনি কি বুঝবেন? এমন না করলে স্কুল চালানো সম্ভব না, ওরা সব ক’টা বেয়াদব, অপদার্থ।
যাক্ আমার প্রশ্ন হচ্ছে এই মায়েরা কি বুঝেন না, তাদের সন্তানদেরকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন? সন্তানকে স্কুলে প্রথম করে বাহবা পেয়ে লাভ কি ভাই? ছোটবেলার শিক্ষাই তো হচ্ছে একটা মানুষের সারা জীবনের ভিত্তি।একবার ভেবে দেখুন তো, তাদেরকে কি শিক্ষা দিচ্ছেন আপনারা? এই ছোট্টবেলায়ই কি শিখিয়ে দিচ্ছেন না, কিভাবে অন্যকে ঠঁকিয়ে নিজে বড় হওয়া যায়!পড়ালেখা না করেও কিভাবে শ্রেষ্ট শিক্ষার্থীর মুকুট মাথায় নেয়া যায়!আপনার সন্তানের ভবিষ্যতের চেয়ে কি আপনার কাছে সুনাম অর্জনটা বড়? প্রতি বছর প্রথম হওয়া বাচ্চাটা যখন এস.এস.সি তে গিয়ে খুব বাজে ফলাফল আনবে তখন মায়ের মুখটা বড় হবে নাকি ছোট?
এ বিষয়ে দৈনিক কালের কন্ঠে জনাব মোফাজ্জল করিমের একটা লেখা পড়েছিলাম। তা হুবহু তুলে ধরলাম,
“বেশ ক’বছর আগে এক ব্যাংকের ভাইভা বোর্ডে একজন চাকরিপ্রার্থী ‘হোয়ার ওয়ার ইউ বর্ন্?’ প্রশ্নের উত্তরে বলেছিল, ‘আই বর্ন্ ইন সবুজবাগ ঢাকা’। যখন জানতে চাইলাম, এটা শুদ্ধ ইংরেজি হলো কি না, তখন একটু লজ্জা পেয়ে সে বলল, নো স্যার। আমি বললাম, তা হলে শুদ্ধ বাক্যটি কী হবে? সেই ১৯৯৬ সালে ১২ হাজার টাকা বেতনের চাকরির জন্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সদ্য পাশ করা যুবকের সলাজ জবাব : আই গেইভ বার্থ ইন সবুজবাগ ঢাকা। … সাবাশ! কী অলৌকিক কৃতিত্ব!”
সবার কাছে আমার বিনীত অনুরোধ,আসুন শুধু নামকরা স্কুলের পেছনে আর সন্তানকে প্রথম করার নেশায় না ডুবে আমাদের সন্তানদের মানুষ করার ব্রত নিয়ে স্কুলে পাঠাই।আগেকার দিনের বড় বড় জ্ঞানী আর মনীষিরা তো সরকারী স্কুলেই পড়াশুনা করে বড় হয়েছেন। তাই শুধু নামের পেছনে না দৌড়ে, উপযুক্ত শিক্ষা নিতে সন্তানকে স্কুলে পাঠাই; হোক সেটা সরকারী কিংবা বেসরকারী, মান থাকা চাই। মেধা-দক্ষতা-গুন-জ্ঞানে আলোকিত করি আমাদের প্রানপ্রিয় সন্তানদেরকে। আর বিশ্বের দরবারে মাথা উঁচু করে বাঁচতে দেই আমাদের আগামী প্রজন্মকে।