ভারত থেকে সভ্যতার অন্যতম লেখক-কাকলি ভট্টাচার্য্য মৈত্র’এর ভিন্নধর্মী ছোট গল্প“উত্তরণ ”

449
কাকলি ভট্টাচার্য্য মৈত্র 'এর ভিন্নধর্মী ছোট গল্প“উত্তরণ ”

উত্তরণ
কাকলি ভট্টাচার্য্য মৈত্র

দাদু আজ রানীর জিম্মায়। একমাত্র নাতনি। খুব আদরের।কালই এসেছে হোস্টেল থেকে। ইতিহাসের ছাত্রী…
দিদা মারা যাওয়ার পর থেকেই দাদুকে কেউ কাছ ছাড়া করে না। কেউ না কেউ দাদু মানে ভবানীপ্রসাদ লাহিড়ী কে একা থাকতে দেয় না। কারণ তিনি তার স্ত্রীর অভাব, খুবই বোধ করেন।
স্ত্রী বেঁচে থাকতে, খুঁটিনাটি সবকিছু নিয়েই ঝামেলা লেগেই থাকত… ভালোবাসাও ছিল ঝুড়ি ঝুড়ি।
এই যুদ্ধ… এই শান্তি, সব কিছুর অবসান ঘটিয়ে… রানু বালা চলে গেছেন… আজ দু মাস হল.. এইজন্যই ভবানীপ্রসাদ খুবই মনে মনে ভেঙে পড়েছেন।
ভবানীপ্রসাদ একটু লেখালেখি করতেন। খুব ভালোবাসেন, মানে বাসতেন… কবিতা লিখতে। এই কবিতা লেখা নিয়ে স্ত্রীর সাথে অনেক ঝামেলা হ’তো… ভবানীপ্রসাদ সবকিছু ভুলে যেতেন। বাজারে গিয়ে, কোন কিছু ঠিক করে বাজার করে আনতে পারতেন না।
ছেলে মেয়েদের জন্মদিন, নিজের বিবাহ বার্ষিকী, এলআইসি প্রিমিয়াম.. কিছুই তার মনে থাকত না। শুধু চাকরি। অফিস যাওয়া আর অফিস থেকে ফিরে, হাত মুখ ধুয়ে পড়ার টেবিলে বসে পড়তেন কবিতা লিখতে…
স্ত্রী যদি কিছু বলতে চাইতেন, তখন ভবানীপ্রসাদ বলতেন… দাঁড়াও, একটু পরে। ছন্দটা হারিয়ে যাবে… ওটা আগে লিখে নিই।
এই ছন্দ ধরে রাখতে রাখতে… আজ দু মাস হল, নিজের জীবনের ছন্দ তিনি হারিয়ে ফেলেছেন। আর ছন্দে ফিরতে পারছেন না। চুপ করে ছাদে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন, আকাশের তারার দিকে তাকিয়ে… ছন্দ খোঁজেন। তার ছন্দ হারিয়ে গেছে চিরতরে… চলে গেছে ওই আকাশের তারা হয়ে…. ভবানীপ্রসাদের দু’চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ে। মনে মনে ভাবে…
— রানু তুমি বেঁচে থাকতে, তোমায় যে এত গভীরভাবে ভালোবাসতাম নিজেই জানতাম না।আজ যেন মনে হচ্ছে… সেই প্রথম দিনের প্রেম।
ভেতরটা তোলপাড় করে ওঠে, চিৎকার করে ডাকতে চায়….
— রানু রানু আমার একটু কাছে এসে দাঁড়াও… একবার তোমায় ছুঁয়ে দেখি অনেক অবহেলা ছিল তোমার প্রতি আমার…. একবার শুধু শুধরে নিতে দাও….
আমার লেখা… আমার ছন্দ…
তুমিতো যোগান দিতে…. তোমার চলাফেরা….
কথা বলা… তোমার দায়িত্ব…. তোমার আনুগত্য…. তোমার বাধ্যতা…. এগুলোই তো আমাকে ছন্দ জুগিয়ে দিতো…. আজ তুমিও নেই, কবিতারাও নেই, নেই কবিতার ছন্দ। তোমার সাথে সাথে আমার কবিতাও চলে গেছে… ছন্দ হারিয়ে গেছে…
আমি একা রানু… একদম একা। একজন ছন্দহারা মানুষ….
সন্ধ্যেবেলায় ভরা পূর্ণিমার পূর্ণ চাঁদের দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলেন…

“….ও চাঁদ..
অমন করে দেখছো কি?
তুমি আলোয় মাখামাখি, আমি আঁধার ঘেরা ঘর
আমার ভালোবেলা তো পেরিয়ে গেছে…
……ধূধূ মরু, শুকনো বালির চর..
তোমার টানেও, টান পড়েছে বুঝি!!
ও চাঁদ,
আমার ঘরে ফেরার, আর ক’টা চাঁদ বাকী?……”
একমনে পড়াশোনা করতে করতে, হঠাৎ রানী দেখে….
দাদু তো ঘরে নেই!!
তার মানে দাদু ছাদে… দৌড়… ছাদে।
দাদু একা একা ছাদে গিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, মন খারাপ করে । ছাদে গিয়ে দেখল… দাদু দাঁড়িয়ে আছে আকাশের দিকে তাকিয়ে।
দাদু কে ধরে ধরে নিচে নামিয়ে নিয়ে এল রানী…
দাদুর চা খাওয়ার সময় এখন। দাদুকে চা করে দিয়ে, দাদুর পাশে বসে… দাদুর সাথে অনেক রকম গল্প করতে লাগলো রানী, আর হাতে তো সেই মোবাইল…
কি যে করে যাচ্ছে সারাদিন মেয়েটা মোবাইল নিয়ে!! দাদু জিজ্ঞেস করেন….
— কি পাস দিদিভাই? ওই মোবাইলের ভেতরে। কি আছে? ওর মধ্যে…
হেসে উত্তর দেয় রানী…..
— দাদুভাই তোমার রক্ত, আমার শরীরে বইছে যে.. লিখছি গো… লেখাটা ছাড়বো কেমন করে?
ও যে তোমার মতনই, আমাকে জড়িয়ে ধরে আদর করে গো…. আর আমি ওকে আদর করি….
আধুনিকা নাতনির কথা শুনে,ভবানীপ্রসাদ জানতে চাইলেন…
–তা …ও কিভাবে তোমাকে জড়িয়ে ধরে আদর করে, আর তুমিই বা কিভাবে ওকে আদর করো?
একটু শুনি…
এবার রানুর একটু সংকোচ বোধ হয়, দাদুকে শোনাতে হবে… কিন্তু সে তো সবই প্রেমের কবিতা লেখে…
— ও দাদুভাই, আমার তো…সবই…মানে সবই প্রেমের কবিতা… তুমি এসব শুনবে?
— কবিতা মানেই তো প্রেম। প্রেম ছাড়া কী কবিতা হয়?… শোনা, শোনা দিদিভাই…
রানু অনেক বেছে বেছে একটা কবিতা বের করলো… এবং পড়ে শোনাতে লাগলো…

তুমি ভেজাবে আমায়?

আজ আমি ভিজবো… তুমি ভেজাবে আমায়?
সিক্ত শরীর অনেক আবেশে, যখন খুব আপন
তখন দেখবো,
আমি রঙিন রঙিন স্বপন
তোমার বাহুডোরের মালায়, জড়িয়ে নানান খেলায়…. ছন্নছাড়া, বাউন্ডুলে
মাতবো আমি, নানান সুরে
বাজিগরের বাজি.. আমি ধরতেই রাজি
যদি, তোমার বুকের পাঁজর… আমায়
ছুঁতে দাও আজই
তোমার সবটা আমার চাই, যদি আমি পাই
নিঃস্ব ক’রে আজই, আমি দিতেই আছি রাজি
তোমার প্রেম যদি ভাসায় আমায়..
তোমার সাথে সূর্যদয় দেখবো রাত্রি জেগে
ভোরের কাছাকাছি যখন রাত্রি বিদায় মাগে
রাত্রি দেখবো, তোমার সাথেই.….
ওই তারারাও রবে সাথে..
তোমায় ছুঁয়ে থাকবো সেদিন, তোমার সোহাগ..
আমার সঙ্গী হবে..
আমি ভিজবো তোমার ভালোবাসায়
তুমি ভেজাবে আমাকে?….#
কোন কথা না বলে, ভবানীপ্রসাদ ইজি চেয়ারটায় গা এলিয়ে দিলেন। চোখ বন্ধ করে, অনেকক্ষণ চুপ করে পড়ে রইলেন..ভালো লাগেনি ভবানীপ্রসাদের। এমন কবিতা তার পছন্দ নয়…. আধুনিক যুগের… আধুনিকা নাতনি লেখা… এ লেখা নিয়ে কতদূর যাওয়া যেতে পারে?
হঠাৎ নাতনি কে জিজ্ঞেস করলেন….
— দিদিভাই, এসব লেখা কাদের পড়াস? তাঁরা কি
বলেন?
— সবাই তো খুব ভালো বলে দাদুভাই… আমার সব বন্ধুরা আমার লেখায় লাইক করে। কত্তো ভালো ভালো কমেন্টস করে জান?
— তোর মোবাইলে?
–হ্যাঁ..
— আর যাঁরা তোর বন্ধু নয়, তাঁরা?
— যারা আমার বন্ধু নয়, তারা আমার লেখা পড়বে কেন?
— সেকি কথা!! শুধু মাত্র বন্ধুদের জন্যেই লিখছিস?সবার জন্যে নয়!! নাঃ এই মানসিকতা তো ভালো নয়।
রানী এবার একটু তীব্র সুরে বলে…
–কার মানসিকতা দাদুভাই? আমার না যারা আমার লেখা পড়ে না তাদের? পড়ে না দাদুভাই.…
পড়ে না। বন্ধু না হ’লে… ভালো লিখলেও পড়ে না..

ওইযে গো… বর্ধমানে বাড়ি, সত্যব্রত লাহিড়ীকে তোমার মনে আছে?
— হ্যাঁ হ্যাঁ.. ছেলেটা খুব ভালো লেখে… আমি ওঁর লেখা, পড়েছি.. বেশ হাত আছে লেখায়.. — আর লেখে না… — কেন? –প্রথম কথা, উনার লেখায় প্রেমরস নেই, দ্বিতীয়ত, উনার তেমন একটা বন্ধু নেই… বেশ কিছুদিন মানসিক চাপ নিয়ে লিখেছেন… এখন,একদম লেখাই ছেড়ে দিয়েছেন.. — আহা, লেখাই ছেড়ে দিলো… — যাক্ গে,ছাড় না… ‌ ও দাদুভাই, তোমার একটা লেখা কবিতা বলো না… — এখন? — কেন … মনে নেই! — না…তা নয়…, আমার লেখায় তো প্রেমরস নেই দিদিভাই… — আমি শুনবো তো… তুমি অন্যকে শোনাচ্ছো নাকি? চোখ বন্ধ করে, ইজিচেয়ারে গা এলিয়ে দিয়ে শুয়ে থাকে ভবানীপ্রসাদ। নাতনীকে বলেন, এখন তুই তোর পড়াশোনা কর, আজ আর ভালো লাগছে না, দিদিভাই… অনেক্ষণ চুপ করে থাকার পর ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়লেন, ঘরে যাওয়ার আগে বৌমাকে জানিয়ে গেলেন, আজ আর কিছু খাবেন না… অনেক রাতে ঘুম ভেঙে যায় ভবানীপ্রসাদের। ভোরের আলো ফোটার অপেক্ষায় বিছানায় এপাশ ওপাশ করতে করতে আলোর মুখ দেখতে পেয়ে… ধীরে ধীরে ছাদে উঠে আসেন…. মনে পড়ে সেই সব দিনগুলোর কথা… কবিতা পাঠের আসর, সাহিত্য সভা…কই কোথাও তো এমন হয়নি..লেখায় অহেতুক প্রেমরস নেই বলে.. গ্রাহ্য হয় নি!! নাতনির মুখে একি কথা শুনলেন তিনি!! এ কোন্ অবক্ষয়ের যুগে দাঁড়িয়ে রয়েছেন তিনি… নিজের লেখা একটা কবিতা বারবার মনেপড়ছে… ভবানীপ্রসাদ জোরে জোরে নিজের লেখা কবিতা আবৃত্তি করতে থাকেন… #নৌকোডুবি আমায় কেন বসিয়ে রাখো? জীবন নদীর তীরে.. স্রোতের টানে ভাবনারা সব… যায় যে, কোথায় চলে! জোয়ার ভাটার টানাপোড়েন দীর্ঘ জীবন জুড়ে… ঘাটে বাঁধা নৌকো গুলো এপার ওপার করে। মাঝে মাঝে পাল তুলে দিই..মননৌকার ‘পরে মন ভেসে যায় নিরুদ্দেশের সেই সুজনের তরে হঠাৎ তুফান…দমকা হাওয়া… উথাল পাথাল ঢেউ পথ ভুলে যাই…সব অচেনা, সঙ্গে নেই তো কেউ মাঝ নদীতে বড্ড একা, এবার তো হাত ধরো পথ চিনিয়ে সুজন আমায় ঘরে নিয়ে চলো.. সেই যে সেদিন…. তোমায় ছেড়ে, পথে নেমে ছিলাম অনেক পাবো… সেই আশাতে, নৌকো ছেড়ে দিলাম আজকে দেখি শেষের বেলায়, হাত তো আমার খালি নৌকো বোঝাই আবর্জনা, যাচ্ছি নিয়ে বাড়ি… তাই কি এতো ঝড়-তুফান?… নৌকোডুবি হবে! ভাসিয়ে দিয়ে আবার বুঝি… আমায় তুলে নেবে! এমন করেই আমায়, তুমি শুদ্ধ করে নাও তোমার পূজোর অর্ঘ্য সাজাই এমন শক্তি দাও…# নাতনি এসে ভবানীপ্রসাদের পাশে চুপ করে দাঁড়ায়। আবৃত্তি শেষ করে… নাতনীকে কাছে টেনে নেয়.. দাদুভাইকে জড়িয়ে ধরে রানু বারবার বলতে থাকে… — দাদুভাই…ও… দাদুভাই আমি তোমার মতো করে লিখতে চাই… আমি তোমার মতো করেই লিখতে চাই… তখন দাদুভাইয়ের স্নেহের ধারায় রানী… ভোরের সূর্যকে সাক্ষী রেখে সমৃদ্ধ হতে থাকে…. রানীর উত্তরণ ঘটে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here