প্ল্যানচেট
কাকলি ভট্টাচার্য্য মৈত্র
দুশ্চিন্তার অবসান ঘটিয়ে, এতদিন পরে…… বনবিহারী সামন্ত তার মেয়ে, সুনন্দার একটা সম্বন্ধ জোগাড় করতে পেরেছেন। পাত্র সরকারি চাকরি করে,আয় নিশ্চিত। ছোট পরিবার, মেয়েটা সুখেই থাকবে। এমনই এক সুখের স্বপ্নে বিভোর হয়ে আছে….বনবিহারীর পরিবার…
বাড়িতে ধীরে ধীরে বিয়ের বাজার থেকে শুরু করে অনুষ্ঠানের তোড়জোড় শুরু হতে চলেছে… কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার… মেয়েটার মনে, কোনো আনন্দ নেই। গুটিয়ে থাকে। কেমন যেন ভয় ভয় ভাব । বিয়েটা যেন সুনন্দার কাছে একটা অভিশাপ।
দিন দিন মেয়ের শরীর শুকিয়ে যাচ্ছে… চোখে মুখে আতঙ্কের ছাপ….. সবসময়, নিজেকে সবার থেকে লুকিয়ে রাখে। আর এক মাস বাকি বিয়ের। বিয়েটা যেন সুনন্দার কাছে একটা ভয়ঙ্কর সমস্যা।
সুনন্দার বৌদিরা জিজ্ঞেস করছে…
— কিরে এমন করিস কেন? কি হয়েছে তোর?
এভাবে গুটিয়ে থাকিস… তুই তো এমন মেয়ে নয়… চনমনে উচ্ছল মেয়ে তুই। কি হয়েছে তোর? বিয়ে তো সবারই হয়। এত মন খারাপ কিসের?
খানিকক্ষণ চুপ করে বসে থেকে সুনন্দা বলে….
–যদি ওই বাড়ি গিয়ে, সুখী না হই!
ওরা যদি আমায় ভালো না বাসে… তখন কি হবে? তারচেয়ে তোমরা বিয়ে ভেঙে দাও। আমি বিয়ে করব না। আমাকে তোমরা ছেড়ে দাও না গো…
আমাকে হাত পা বেঁধে জলে ফেলো না…
এই রকম বিভিন্ন বিভ্রান্তিকর কথা বলে। কেউ বুঝতে পারে না। এই কথা, সুনন্দার বাবা- মায়ের কানে পৌঁছালো… দাদাদের কানে পৌঁছল….
তারা তো ভাবনায় অস্থির হয়ে উঠলো…. এ আবার কেমন কথা… সব মেয়েরই বিয়ে হয়। বিয়ের পরে কেমন হবে সেটা অবশ্য একটা কথা….
কিন্তু….
ভয়ে কেউ বিয়ে করবে না… একি কথা!!
……..এরকম তো কেউ বলে না….
ছোট্ট মফস্বল শহর, কথা পাঁচকান হতে সময় লাগে না… ধীরে ধীরে বাতাসে ভেসে অনেকের কানে গেল।
কেউ কেউ বলতে লাগলেন…ভুতে ধরেছে। এদিকে সুনন্দা সবসময় ভয়ে জড়সড় হয়ে বসে থাকে, খাওয়া দাওয়া বন্ধ প্রায়। সুনন্দার বাবা মা খুবই চিন্তায় পড়েছেন, মেয়েকে নিয়ে…
এমন সময়ে, সুনন্দার মামা, কোথা থেকে খবর নিয়ে এলেন একজন তান্ত্রিকের। বিশ্বাস, তিনি সমস্যার সমাধান করবেন।
সুনন্দার বাবা ও মামা সেই তান্ত্রিক, মলয় শাস্ত্রীর সাথে যোগাযোগ করলেন এবং সবকিছু খুলে বললেন। তিনিও আশ্বাস দিলেন।
তন্ত্র সাধনা গুরুমুখী বিদ্যা হলেও…এই বিদ্যারও একটা কোর্স আছে। পূর্ণ তান্ত্রিক হলো… সবথেকে উচ্চপর্যায়ের তান্ত্রিক। এঁরা বিয়ে করতে পারেন না।
মলয় শাস্ত্রী তার গুরুর আদেশে, একজন দরিদ্র পিতার কন্যাকে বিয়ে করতে বাধ্য হয়েছিলেন।
কাজেই, মলয় শাস্ত্রীর আর… পূর্ণ তান্ত্রিক হওয়া হলো না। মনে মনে মলয় শাস্ত্রী খুব দুঃখ পেয়েছিলেন। যদিও সেই ক্ষত স্থানে মলম লাগাতে পেরেছিলেন, তাঁর সদ্য কৈশোর পেরোনো নতুন বউ।
যাইহোক, তন্ত্র সাধনা সবাই সম্পূর্ণ করতে পারেন না। কিন্তু কাজ তো করতেই হয়। তাই, যাঁরা জানেন
তাঁরা, অন্যদের সাহায্য করেন। এইভাবে মলয় শাস্ত্রীও কাজ করেন এবং বেশ ভালো ভাবেই সফল হন।
এবার, সেই মলয় শাস্ত্রীর সাথে তারা এক কালীমন্দিরে উপস্থিত হলেন।
মলয় শাস্ত্রী অনেকক্ষণ চুপ করে থাকার পরে… জানালেন…
–আপনাদের মেয়ে কি কখনো… কোনো ছেলের সাথে…….
–হ্যাঁ হ্যাঁ… খুব খারাপ ছেলে… অনেক কষ্টে মেয়েকে সরিয়ে এনেছিলাম…
–সে.. সেতো… বেঁচে নেই।……কি? তাইতো?..….
–শুনেছি মারা গেছে… জলে ডুবে…
— আত্মহত্যা করেছিল, ছেলেটি। খুব অভিমানে। যাইহোক, সে কিন্তু সুনন্দার কাছে কাছেই থাকে… সুনন্দাকে দেখা দেয় এবং ওকে ভয় দেখায়।
ওই ছেলেটি সুনন্দাকে হারাতে চায় না। তাই ভয় দেখিয়ে নিজের কাছে রাখতে চায়।
–তাহলে কি..…
–সব ঠিক হ’য়ে যাবে…অতো ভাববেন না…
আপনারা মনে জোর রাখুন… আমি দেখছি, আমাকে ভরসা করতে পারেন… আমারও একটা ক্ষমতা আছে… ভরসা রাখুন। আর ওই ছেলেটিকে চিনতো, এমন আরও দু-তিন জনকে সঙ্গে আনবেন কাজের দিন, জোর বাড়বে। তিন রাতের কাজ।আশা করছি.. নির্দিষ্ট দিনেই মেয়ের বিয়ে দিতে পারবেন।
সমস্ত বাধা-বিপদ কাটিয়ে… সফলতা পাওয়ার জন্য, একটি কবচ তৈরি করা হবে। তারজন্য,
প্রথম দিন, রাতে কালীপুজো করে… শুভারম্ভ…
দ্বিতীয় দিন, মধ্যরাতে শুরু হলো…কালীর বীজ মন্ত্র জপ…
দশ লক্ষ আঠাশ বার জপ করতে হবে…… এইভাবে তৈরি করা হবে একটি কবচ। যা সুনন্দাকে
বিপদ থেকে রক্ষা করবে….
এই কাজ একা একরাতে সম্ভব নয় বলে, মলয় শাস্ত্রী, একজন অত্যন্ত নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ সমীর চক্রবর্তীকে সঙ্গে নিলেন।
ঠিক যেখানে মলয় শাস্ত্রী শেষ করছেন… একদম সেইখান থেকে সমীর চক্রবর্তী শুরু করছেন…জপ করা। আবার সমীর চক্রবর্তী যেখানে শেষ করছেন মলয় শাস্ত্রী ঠিক সেইখান থেকে শুরু
করছেন… এইভাবে জপ পর্ব সমাপ্ত ক’রে…তৈরি হলো কবচ…….
কবচ পরিয়ে দেওয়া হলো… সুনন্দার হাতে…..
বাবা মায়ের আশা… এইবার হয়তো ভয় কাটবে মেয়েটার…
তৃতীয় রাতে, প্ল্যানচেট….
প্ল্যানচেট শুরু হওয়ার আগে, এসে উপস্থিত হলেন দুই নাগা সন্ন্যাসী… একজন পুরুষ অন্যজন স্ত্রী।
জটাধারী দিগম্বর মূর্তি। সন্ন্যাসীর একহাতে মস্ত ত্রিশূল তার সাথে বাঁধা রয়েছে ডমরু, অন্যহাতে সিঙ্গা। আর সন্ন্যাসিনী সন্ন্যাসীকে অনুসরণ করছেন।
রাত্রি একটার সময়, প্ল্যানচেটে বসা হলো। থমথমে শান্ত পরিবেশ…. হালকা নীল রঙের আলো… মৃদু সংগীতের সুর… একটা অন্য মাত্রা এনে দিয়েছে।
এটা অনুষ্ঠিত হচ্ছে…মলয় শাস্ত্রীর বাড়িতে।
আগেই, সবাইকে বলে দেওয়া হয়েছিল…
প্রত্যেকে যেন, শুদ্ধ বস্ত্রে আসেন এবং শুদ্ধ মনে থাকতে হবে। অন্য কোনো উত্তেজক চিন্তা করা চলবে না। মনে কোন দ্বিধা বা ভয় রাখা চলবে না। যিনি ভয় পাবেন, তিনি যেন এখানে না আসেন… মন শক্ত করে… ভয়হীন হয়ে…. একাগ্রভাবে সেই বিশেষ আত্মাকে আবাহন করতে হবে। যার আত্মাকে ডেকে আনা হচ্ছে, তার চিন্তা….
বাকি কাজ উনারা করবেন…
নির্দিষ্ট সময়ের আগেই, সবাই উপস্থিত হয়ে গেলেন।
একটা শ্বেত পাথরের টেবিলকে ঘিরে বসলেন প্রত্যেকে। একমনে সেই ছেলেটির চিন্তায় মগ্ন সবাই… কেবলমাত্র ব্রাহ্মণ সমীর চক্রবর্তী, গায়েত্রী মন্ত্র জপ ক’রে যাচ্ছেন…
আর মিডিয়াম, নাগা সন্ন্যাসিনী। তিনি চুপ করে বসে আছেন…
প্ল্যানচেটের একটা বিশেষ নকশা থাকে। অত্যন্ত জটিল সেই বিশেষ নকশা।
আঁকা হলো…. শ্বেত পাথরের টেবিলের উপর। একটা রুপোর কয়েন, ওই নকশার উপরে রাখা হলো এবং রুপোর কয়েন টা কে একটা সোনার কাঠি দিয়ে আলতো করে ছুঁয়ে রইলেন মলয় শাস্ত্রী… এবং অন্যান্য সকলে ওই ছেলেটিকে মনে মনে আহ্বান করতে লাগলেন…
হঠাৎ,নাগা সন্ন্যাসীর অদ্ভুত শব্দে…সবাই বুঝতে পারলো… কেউ এসেছে…
দেওয়ালে একটি মানুষের আবছা অবয়ব…একটু স্পষ্ট হতে না হতেই আবার মিলিয়ে যাচ্ছে…
নাগা সন্ন্যাসী, অদ্ভুত গম্ভীর গলায় বললেন…
— আ….য়…আ….য়…
সন্ন্যাসিনী থরথর করে কেঁপে উঠে… পাথরের মূর্তির মতো বসে রইলো…। যেন সে, তার নিজের সত্ত্বায় আর নেই…। মুখ দিয়ে অদ্ভুত কিছু আওয়াজ বেরিয়ে এলো… বোঝা গেলো মিডিয়ামের মাধ্যমে কেউ এসেছে…
কিন্তু কে?… সেটা তো সবার আগে নিশ্চিত হতে হবে। অনেক সময়ই দেখা যায়, যাকে ডাকা হচ্ছে… মনঃসংযোগের অভাবে…অন্য আত্মার প্রবেশ ঘটে।আর, অত্যন্ত বিভ্রান্তি ঘটায়…
সন্ন্যাসী, গম্ভীর গলায় জিজ্ঞেস করলেন…
–কে তুই? নাম বল…
মিডিয়ার মুখ থেকে বেরিয়ে এলো উত্তর…
–কৌশিক…. আমি কৌশিক…
— প্রমাণ দে..
— ওই যে, সুনন্দার বাবা… উনাকে বলুন… উনি আমাকে চেনেন তো..
নাগা সন্ন্যাসী, তার ডান হাত তুলে সবাইকে দেখালেন…
— দেখুন তো…এই আত্মাটি আপনাদের চেনা কৌশিক কিনা…
অদ্ভুত রহস্যময় ব্যাপার… সন্ন্যাসীর হাতের তালুতে ফুটে উঠেছে কৌশিকের ছবি। ভয়ে- ভক্তিতে-অদ্ভুত অভিজ্ঞতায় সকলে আবিষ্ট হয়ে আছে..
সন্ন্যাসীর ধমকে, সকলে চেতনা ফিরে পেলেন…
— বলুন….এইই কিনা…
— হ্যাঁ… হ্যাঁ… এইই কৌশিক। বললেন সুনন্দার বাবা…
এবার সন্ন্যাসী শুরু করলেন, তাঁর প্রশ্ন পর্ব…
— মেয়েটাকে ভয় দেখাচ্ছিস কেন?
— ও আমাকে ভালবাসে…বিয়ে করতে চেয়েছিলাম আমরা। সুনন্দা আমার। ও আমারই থাকবে….
— তুই মৃত… মৃতের সঙ্গে জীবিত মানুষের কোনো সম্পর্ক থাকতে পারে না… ওকে ছেড়ে দে…
— না, কিছুতেই না… সুনন্দা আমার… আমি ওকে ছাড়বো না…
সন্ন্যাসীর সঙ্গে মৃত আত্মার অনেক তর্ক হওয়ার পরেও যখন কৌশিকের আত্মা ছেড়ে যেতে রাজি হলো না… তখন সন্ন্যাসী মন্ত্রবাণে বিদ্ধ করতে লাগলেন…
সে এক অদ্ভুত পরিস্থিতি, শরীরী অশরীরীর লড়াই। সেখানে যাঁরা উপস্থিত ছিলেন, সেই ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা তাদের….
খানিক বাদে… সন্ন্যাসী জানালেন….
— আর ভয় নেই… আপনাদের মেয়ে বিপদ মুক্ত…
একেএকে সবাই ঘর থেকে বেরিয়ে এলো বাইরে.. নিস্তেজ হয়ে পড়ে রইলো সন্ন্যাসিনী.. তাঁর স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসতে কিছুক্ষণ সময় লাগবে।
মিডিয়ামদের এরকমই অবস্থা হয়।
ভোরের লাল আকাশে….হালকা সূর্য রশ্মি দেখা দিয়েছে… পাখিদের মধুর কলকাকলিতে আকাশ বাতাস মুখরিত… নতুন দিনের বন্দনা গানে, নতুন করে… নতুন দিনকে, আবাহন জানাচ্ছে প্রকৃতি…. টুপটাপ ঝরে পরছে শিশির…. গাছের পাতা থেকে…ফুলেরা সদ্য পাঁপড়ি মেলে তাকিয়েছে নরম সূর্যের দিকে… পরিপূর্ণ আনন্দে ভরে রয়েছে পৃথিবী…….
চুপচাপ বাড়ি ফিরছেন ….সুনন্দার বাবা, মামা এবং অন্যান্যরা।
সুনন্দার বাবা বলছেন….
— পৃথিবীতে কত কিছু অলৌকিক ঘটনা ঘটে, তার কোন কিছুর সাথেই আমরা যুক্ত নই, অথচ আমাদের সাথে ঘটে চলেছে…..
মৃত্যু, যাকে আমরা মনে করি শেষ…
সৎকার এবং শ্রাদ্ধ শান্তির ভেতর দিয়ে….. কিন্তু সেখানেই শেষ নয়……
মৃত্যুর পরেও, আর একটা জগৎ রয়েছে, সেই জগতের বাসিন্দাদেরও ভালবাসার অধিকার আছে…. মন আছে….. কিন্তু আমরা তাদের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করতে পারিনা……
তাদের ভয় পাই, অনাদর করি, অবহেলা করি…. তাদেরও ইচ্ছে অনিচ্ছে আছে, তারাও ভালোবাসে, তারাও ভালোবাসার কাছে থাকতে চায়….