ভারত থেকে কলমযোদ্ধা-শ্রীরূপা চক্রবর্তী এর ভিন্নমাত্রার গল্প “এক অন্য প্রেমের গল্প”

569
শ্রীরূপা চক্রবর্তী এর ভিন্নমাত্রার গল্প “এক অন্য প্রেমের গল্প”

এক অন্য প্রেমের গল্প

শ্রীরূপা চক্রবর্তী

কেতকীর মনটা ভালো নেই। আবারও সেই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি। সেই ঘটা করে সেজেগুজে পাত্রপক্ষের সামনে বসা, পরিস্থিতি যতই বিরক্তিকর হোক, মায়ের কড়া নির্দেশে বিরক্তি প্রকাশ না করা। অর্থাৎ যতখানি লক্ষীমন্ত মেয়ে হয়ে বসে থাকা যায়,সে ধৈর্যের পরীক্ষা দেওয়া। এবং বেশ কিছুদিনের বিরতিতে, ফোনের ওপার থেকে শোনা সে পরীক্ষার ফল—“একটু অসুবিধা হচ্ছে। আমরা এখানে কাজ করতে পারবনা।”

অসুবিধাটা ঠিক কি, কেতকী এতদিনে খুব স্পষ্টতই তা বুঝে গেছে। অতি সাধারণ চেহারার কালো মেয়েকে মনে ধরেনা কারোরই। তার ওপর নেই অর্থের জোর। না তার বাবার, না তার নিজের। তাই প্রত্যেকবার পাত্রপক্ষের সামনে “সিটিং” শেষে জোটে প্রত্যাক্ষানবার্তা। বাড়ীতে সে বহুবার বিয়ের ব্যাপারে অসম্মতি জানিয়েছে। কিন্তু সে নিজেও জানে, আর্থিক ভাবে নিজের পায়ে দাঁড়াতে না পারলে, সে কথার ওজন নেই। তাই প্রতিবার পাত্রপক্ষের প্রত্যাক্ষানের পর, তার জেদ যায় বেড়ে, বাড়ে অধ্যাবশায়, বাড়ে পরিশ্রম, চাকরি তাকে পেতেই হবে। রঙ বিচারী সমাজের সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গির প্রতি নিজের অজান্তে এভাবেই হয়তো সে প্রতিশোধ নিতে চায়।
সারাদিনের শেষে একটু হালকা হতে মোবাইলটা হাতে নেয় কেতকী। হোয়াটস্অ্যপ খুলতেই দেখে এক অচেনা নম্বর থেকে ছবি সহ একটা মেসেজ—–

ভূমি আঁকড়ে লাল ফুলের চাদর গায়ে মস্ত এক পলাশ গাছ। ফাঁক ফোকড় দিয়ে উঁকি দিচ্ছে বসন্ত-নীল আকাশ। নীচে লেখা—” কেমন আছো কেতকী ? বসন্ত সুখের দূত, গাছ ভর্তি পলাশ তোমায় পাঠালাম। যেদিন আমার কাছে আসবে, এ ফুলের গয়না দিয়ে নিজেকে রাঙিয়ে আমার কাছে এসো। “

হঠাৎই যেন থেমে যায় কেতকীর হৃৎস্পন্দন। পৃথিবিটা যেন তার গতি থামিয়ে স্তব্ধ হয়ে যায়। কে, কেন, কিভাবে নানা প্রশ্ন মুহুর্তে এসে জড়ো হয়। সাতাশটা বসন্ত সে পার করে এসেছে। এমন সুন্দর ভাবে তার কাছে আজ অব্দি কেউ কিছু চায়নি। আর এ যেন শুধু চাওয়া নয়, কিছুটা দাবিও বটে।
একেই কি বন্ধুরা প্রপোজাল বলতো ? নিজেকেই শুধোয় কেতকী।

তার শ্রীহীন চেহারার দিকে, একবারের বেশী দুবার তাকানোর ইচ্ছেটাই আজ অব্দি কারোর হয়নি। তার নিজেরও কি সে ইচ্ছা হয়েছে ?!! তাহলে আজ কে ? —এ প্রশ্নের খোঁজে সে ডুব দেয় স্কুল জীবন থেকে দেখে আসা চেনা মুখের সমুদ্রে। স্কুল , কলেজ, বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন জায়গায় অংশগ্রহণ করা আবৃত্তির আসর— নাহ্!! কোনো মুখই ক্ষীনতম সম্ভাবনার আলো তাকে এনে দিতে পারেনা।True caller identity App এও পরিচয় আড়ালের সুযোগ আছে। তাই সে পথে খোঁজ বৃথা।

পরের দিন রোজনামচার ব্যস্ততার ফাঁকে ফাঁকে, আগের রাতে বসন্ত ফুলের আভায় মাখা বার্তা, উঁকি দিতে থাকে। সে কে??——এ প্রশ্নের উত্তরে বারেবারেই মনে ভেসে ওঠে এক অদৃশ্য মুখের পুরুষ ছবি।
দিনের শেষে ফোনটা হাতে নেয়। সেই অচেনা নম্বর থেকে আবার মেসেজ—-
“আমি তোমার কাছ থেকে সাড়া পাওয়ার অপেক্ষায় আছি কেতকী। “

ফাগুন হাওয়ায় কেতকীর যেন সব লন্ডভন্ড হয়ে যায়। অনুভব করে এক অজানা আনন্দ উত্তেজনা…..
—–এও কি সম্ভব ?!! নাকি এ নিছকই কারোর নিষ্ঠুর রসিকতা?!! উত্তর পায়না।
আজকাল তার দিন শুরু হয় রাতের জন্য অপেক্ষা দিয়ে। রাতেই যে আসে, সেই অজানা ঠিকানা থেকে বিনি সূতোর কথারমালা, যে কথারমালা তার হৃদয়ে এঁকে দিচ্ছে এক সুখী গৃহকোণের আল্পনা।
আজকাল আর পাত্রপক্ষের প্রত্যাক্ষানে কেতকীর মনে মন খারাপের মেঘ জমে না। নিজের অজান্তেই সে বিশ্বাস করতে শুরু করেছে, তার জন্য একজন অধীর ভাবে অপেক্ষা করে আছে। কেতকী শুধু তারই।
ওপাশের মানুষটিকে “অনলাইন” দেখে, প্রথমবার কেতকী লিখে পাঠায় ছোট্ট তিনটে শব্দ,
———নিজের পরিচয় দিন।
উত্তর আসতে একটু সময় লাগে।
———তোমার মনে থাকার কথা নয় কেতকী, তোমার সাথে আমার প্রথম দেখা, এক বছর আগে তোমাদেরই বাড়ীতে। কাঠগড়ায় বসে তুমি ‘পাত্রী’, আর আমি ‘পাত্রপক্ষ’।
মনে আছে কেতকী? সেদিন চলে আসার আগে, আমি তোমায় বলেছিলাম, ” আপনার কিছু জানার নেই?”
উত্তরে তুমি বলেছিলে,
“যে কোনো সম্পর্কের মূলে থাকে বন্ধুত্ব, আর বন্ধুত্বের মূলে থাকে ভালোবাসা। সে ভালোবাসার অর্থ, ভালোবাসার মানুষটাকে নিজের মনের মতো করে পাল্টে ফেলা নয়। ভালোবাসা মানে, ভালো মন্দ মিলিয়ে মানুষটা ঠিক যেমন, তাকে ঠিক তেমন করেই গ্রহণ করা। বিয়ের বিজ্ঞাপনী বাজারে সবাই সবার শ্রেয়টুকু সামনে আনে শুধু। কিন্তু প্রতিটা মানুষ তো ভালো মন্দ মিশিয়ে, সেই সবটুকু নিয়েই তো তাকে গ্রহণ করা উচিত। তাই আপনি আপনার মন্দদিক গুলো বলুন।

উত্তরে আমি কি বলেছিলাম, সেকথা থাক। কিন্তু তোমার ঐ সামান্য কটা কথা উঠে এসেছিলো, তোমার অসামান্য এক গভীরতা থেকে। বড্ড ভালো লেগেছিল। জীবনকে চিনিয়েছিল নতুন এক দর্শনে। ফিরে ফিরেই মনে হয়েছিল ডুবুরী হয়ে ডুব দি তোমার মন-সমুদ্রে। না জানি আরও কত অমূল্য রতন তাতে লুকোনো আছে!!

তবুও নিজেকে নিজে একটা বছর সময় দিলাম। আর এই এক বছরে উপলব্দ্ধি করলাম,মানুষের চেহারার রূপ বড়ই ভঙ্গুর, বড়ই ক্ষনস্থায়ী। আর তার প্রতি যে আকর্ষন, তা নিছকই মোহ। এক মনের গভীরতা, আরেক মন কে যে দোলা দেয়, সে দোলা এনে দেয় জীবন বোধ, বদলে দেয় জীবন দর্শন।
বাড়ীতে বলে রেখেছিলাম, মত অথবা অমত, তোমাদের যেন কিছুই জানানো না হয়। তোমার খোঁজ রাখতাম, যদিও বিশ্বাস ছিল, যদি আমারই হও, আমার হয়েই থাকবে । অন্যত্র বিয়ে হবে না।
তোমার অপেক্ষায় আছি কেতকী।

মেসেজ পড়া শেষে কেতকীর গাল বেয়ে শুধুই নোনা জলের ধারা। আবছা, তবে মানুষটাকে তার মনে পড়ছে। তার সামান্য দুটো কথার এত গুরুত্ব কারোর কাছে!! এ যেন সুখের রেকাবি হাতে, জীবন তাকে নতুন ভাবে বরণ করে নিল। কেতকী লিখে পাঠায়,

——–মিলনের সব রঙটুকু নিয়ে, অপেক্ষার অবসান না হয় হোক, আগামী দোল পূর্ণিমার জ্যোৎস্না-প্লাবিত রূপোলী সন্ধ্যায়। আপনার কথা রেখে সেদিন পলাশ রঙা শাড়ী পরেই যাব।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here