মোরা একই বৃন্তে দুটী কুসুম হিন্দু-মুসলমান
অজন্তা প্রবাহিতা
ছোট্ট অভি।
৬ বছর বয়স।
স্কুলের আবৃত্তি প্রতিযোগিতায় ভাগ নেবে।
বেশ অনেক দিন ধরে অভির মা সুবর্ণা খুব যত্ন সহকারে ওকে কবিতা মুখস্থ করিয়েছে !
তাও যে সে কবিতা নয় ,
বিদ্রোহী কবি নজরুল ইসলামের
“কান্ডারী হুঁশিয়ার” !
ওর জন্য বেশ শক্ত কবিতা!
কিন্তু মায়ের কঠিন চেষ্টায় অভি পুরো কবিতাটি আয়ত্ব করে ফেলে খুব অল্প সময়ের মধ্যে।
কম্পিটিশনের দিন সকালে ব্রাশ করা থেকে শুরু করে স্কুল বাসে ওঠা পর্যন্ত, সুবর্ণা অভিকে এক একটা শব্দ বারে বারে প্রাকটিস করিয়েছে !
– বাবু !
হিন্দু না ওরা মুসলিম? ওই জিজ্ঞাসে কোনজন?
কান্ডারী ! বল,ডুবিছে মানুষ, সন্তান মোর মার ….
এই জায়গার প্রতিটা শব্দে জোর দিয়ে বলিস সোনা।
টিভি তে দেখিস না,সবাই কেমন শব্দের জোরে টেবিল ভেঙে ফেলে,ঠিক সেই রকম।
মায়ের কথা মতো ছোট্ট অভিষেক স্কুলের মঞ্চে দাঁড়িয়ে নিজের গায়ের সব টুকু জোর দিয়ে এই লাইন গুলো বলে।
হাত তালিতে ফেটে পরে পুরো হল ঘর। রিয়া ম্যাম দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরে বলেন, ” তুমি আমার মুখ রাখলে। ক্লাস ওয়ানের এ সেকশন আজ তোমার জন্য বেস্ট ক্লাস অ্যাওয়ার্ড পেলো। প্রাউড অফ ইউ মাই চাইল্ড। ”
স্কুলবাস থেকে নাবতে না নাবতেই,মা আগে ডায়েরি চেক করে।
তারপর অভির গালে কপালে চুমুর বন্যা !
– ওলে আমার মানিক রে,
তুই ফার্স্ট হয়েছিস!
সাথে দিদা,মাসি,কাকু,ঠাম্মা সবাইকে ফোন!
– এতো কঠিন কবিতা বলে ফেললো আমাদের অভি !
অভির মাসি শর্মিলা বলে
– দিদি!
ওকে ব্রততীর ক্লাসে দে !
ট্যালেন্ট আছে!
শাইন করে যাবে !
রোববারে বাড়ীতে পার্টির ব্যবস্থা হলো!
এতো কঠিন কবিতা আবৃত্তি করে ফার্স্ট হবার জন্য।
কত গিফট !
কত আশীর্বাদ !
বড়ো হও দাদুভাই ! বড়ো হয়ে অনেক নাম করো। আরো অনেক কবিতা বলো।
ঘরেবাইরে সবাই খুশি।
বাবা অভিকে প্রিয় গেম সিডিটা গিফট করেছে !
রাতে শুতে যাবার আগে মায়ের গলা জড়িয়ে অভি জিজ্ঞেস করে,
– মা !
হিন্দু ,মুসলিম মানে কি হয়?
একই মায়ের সন্তান মানে, একই মায়ের বেবি ?
ভাইয়ের নাম হিন্দু আর মুসলিম কেনো ?
-ও আমার পাকু সোনা!
হিন্দু আর মুসলিম এই মাটির সন্তান !
তাই ওরা ভাই!
যেমন লভ-কুশ!
-আচ্ছা !
তারপর বহুজায়গায় অভি এই কবিতা বলে অনেক কাপ অনেক শিল্ড বাড়িতে নিয়ে এসেছে।
অভির সিগনেচার কবিতা হলো ‘কান্ডারি হুশিয়ার’।
দেখতে দেখতে কুড়ি বছর পার হয়ে গেলো।
অভি সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার তার সাথে খুব নাম করা বাচিক শিল্পী।
একদিন বিকেল বেলা অভি মায়ের সাথে কথা বলবার জন্য মায়ের পেছন পেছন ঘুরঘুর করছিলো।
-মা!
-হ্যাঁ বাবা!
-কিছু বলার ছিল !
-কি ??
অভির লজ্জা পাওয়া চেহারা দেখে মা আন্দাজ করতে পারে।
– কি ! কাউকে পছন্দ হয়েছে??
চোখ নাবিয়ে মাটির দিকে তাকিয়ে অভি বলে
-হ্যাঁ !
মায়ের প্রশ্নের তালিকা শুরু হয়ে যায়
– কে সে ? কেমন দেখতে ?
-তোমার মতো ,মা !
-বাব্বা ! কত বুধধি তোর। খুব শিখেছিস না মাকে পটাতে।
মাকে জড়িয়ে ধরে অভি বলে
-কি যে বোলো,মা !
ছেলের গায়ে হাত বুলিয়ে সুবর্ণা জিজ্ঞেস করে
-কি নাম তার ?
– শাহীন !
এক ঝটকায় অভিকে আদর করতে থাকা হাত সরে যায়।
অসম্ভব অসন্তোষ ভরা গলায় সুবর্ণা বলে
– মুসলিম??
– হ্যাঁ মা !
আর থাকতে না পেরে ঠাস করে এক চড় অভির গালে। চিৎকার করে সুবর্ণা বলে ওঠে
– হতভাগা এই দিন দেখার জন্য তোকে পেটে ধরেছিলাম?
আর কোনো মেয়ে পেলি না?
পৃথিবীতে অন্য কেউ নেই? ওই পোড়ারমুখী নিশ্চয়ই কোনো জাদুটোনা করেছে তোকে। বস্তিবাড়ির মেয়েরা এর থেকে আর বেশি কি করতে পারে। ভালো ছেলে দেখলেই লাল টপকে পরে ওদের।
মায়ের অদ্ভুত ব্যবহারে অবাক হয়ে যায় অভি।
– মা !
তুমি তো বলেছিলে,
হিন্দু,মুসলিম -লভ-কুশ ! ভাই -ভাই !
– হা ঈশ্বর!
তুই ছোট ছিলি তখন তাই বলেছিলাম।
সেই সময় অন্য কিছু বুঝতিস না তুই।
এখন সময় এক্কেবারে আলাদা।
আমি কোনো বেজাতের মেয়েকে বাড়িতে ঢুকাবো না। আমার ঘরে শালগ্রাম আছে।
চোখে জল নিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরে অভি কাতর ভাবে অনুনয় করে
– মা!
এতো নির্দয় হয়ো না। আমি ওকে স্কুল থেকে ভালোবাসি ! শাহীন ও আমাকে ভালোবাসে। আমরা সহপাঠী ছিলাম ,এখন সহকর্মী।
এতো দিনের পরিচয়। আমরা পরস্পরের কাছে খুব সহজ। কি অসুবিধে?
মায়ের রাগ তুঙ্গে।
পাড়াপ্রতিবেশী বা কাক পক্ষিও যাতে ছেলের প্রেমের কথা টের না পায়,তাই কিছুটা গলা নাবিয়ে,দাঁত চিবিয়ে বলে,
– ভুল হয়ে থাকে ,বাবু ! সময় থাকতে ভুল শুধরে নেওয়াটা বুধ্ধিমানের লক্ষণ । তোর বাবা যদি জানতে পারেন এই কথা, রক্ষে থাকবে না।
এই ব্যাপারে আমিও তোকে কোনো রকম সাহায্য করতে পারবো না । সরে আয়। এখনো সময় আছে। ওই মেয়েটিকে গিয়ে বল নিজের জাতের কাউকে খুঁজে নিতে ! ব্রাহ্মণ বাড়ীতে ওর ঢোকা বারণ !
তোকে ভালোবেসে ও ভুল করেছে ! ওর বাবা মাও মানবে না !
মায়ের আদেশের কাছে বড়ো বড়ো মহারথী হার মেনে যায়,
এ তো সেই ছোট্ট অভি।
যে কিনা ছয় বছর বয়সে মায়ের আদেশে গলার জোরে টেবিল ভেঙে এসেছিলো।
পরদিন, নিজেকে সামলে নিয়ে শাহীনের সাথে দেখা করে ভুল স্বীকার করে অভি ! মায়ের কথা অনুযায়ী সময় থাকতে থাকতে ওকেও ভুল শুধরে নিতে বলে !
অভির পরামর্শে চোখ ঝাপসা হয়ে আসে শাহীনের। এতো দিন ধরে যত্ন করে সাজিয়ে রাখা স্বপ্ন গুলো চুরমার হয়ে যায় চোখের সামনে।কক্ষের সামনে মনের ভেতর সাজিয়ে রাখা বাড়িটা তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়তে দেখে। অবশ হয়ে আসে হাত পা। সেই ছোট্ট থেকে দিনের পর দিন অভিকে ভালোবেসে আসা শাহীন কিছুতেই বুঝতে পারেনা,ভুল টা কোথায় ? অভিকে ভালোবাসা ? নাকি মুসলিম ঘরে জন্মানো? কে কোথায় জন্মাবে সেটা তো সে আগের থেকে কেউ জানতে পারে না।তাহলে ?
সম্বিৎ ফেরে অভির দৃঢ় কণ্ঠস্বরের ‘সরি’ শব্দের আঘাতে।
কেমন রোবটের মতো অভি বলে, “কষ্ট পেয়ো না শাহী। আমরা তো বন্ধু থাকলাম। ”
-“শুধু বন্ধু ?”বলে অভির হাত চেপে ধরে শাহীন।
অভির তখন ভীষণ তাড়া।সব সম্পর্ক এক ঝটকায় শেষ করতে হবে। দ্রুত গতিতে শাহীনের হাতের থেকে নিজের হাত সরিয়ে নিয়ে বাইকে স্টার্ট দেয়।
শাহীন আবার চেপে ধরে হ্যান্ডেলে রাখা ওর হাত। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে একটাই কথা বলে,” অভি, হিন্দু না মুসলিম ওই জিজ্ঞাসে কোন জন ?মোরা একই বৃন্তে দুটি কুসুম ………….। ”
শাহীনের কথা শেষ হবার আগেই ওর হাত সরিয়ে দিয়ে হেলমেট লক করে বাইক ঘুরিয়ে নেয় অভি।
বৃষ্টি ভরা চোখে শাহীন মূর্তির দাঁড়িয়ে থেকে অভির চলে যাওয়া দেখে। গলি থেকে বেরিয়ে মেন্ রাস্তার অন্যান্যদের সাথে মিশে যায় অভির বাইক। ঝাপসা হয়ে গেলো দৃষ্টি । অবশ হয়ে যায় শরীর।
কানে বেজে চলে অভির বলিষ্ঠ কণ্ঠে বলা সেই লাইন, মোরা একই বৃন্তে দুটী কুসুম হিন্দু-মুসলমান |মুসলিম তার নয়ন-মণি,
হিন্দু তাহার প্রাণ। মোরা একই বৃন্তে দুটী কুসুম হিন্দু-মুসলমান।
আজ আপনাদের পেপারে নিজের ছবি ও লেখা দেখতে পেয়ে আমি কতটা আপ্লুত তা বয়ান করার মতো ভাষা আমার নেই। এভাবেই আমাদের পাশে থাকবেন। মনের মাঝে তো কোনো কাঁটাতারের বেড়া নেই,সবাই মিলে এভাবেই থাকি না কেন তাহলে।
ভালো থাকবেন সবাই।
অজন্তাপ্রবাহিতা