ভক্তের ভগবান
শ্রীরূপা চক্রবর্তী
…..একি বৌমা!! আজ রথযাত্রার দিনে ঠাকুর নিয়ে এসব কি ছেলেখেলা করেছো?!!
ফুল ফল ধূপ চন্দনের আবেশ জড়ানো শান্ত পরিবেশে রুমি একমনে বসে পূজোর ফল কাটছিলো। রাশভারী চেহারার শাশুরী মা কখন দরজার কাছে এসে দাঁড়িয়েছেন রুমি খেয়াল করেনি।
তিনতলার এই পুজোর ঘর, শ্বশুরবাড়িতে আসার পর থেকেই রুমির একান্ত নিজস্ব জায়গা। দু চারটে বিশেষ পূর্ণিমা তিথি আর এই রথযাত্রায় বড় পুজো ছাড়া বছরের বাকি দিনগুলো তিনতলা অব্দি খুব একটা কেউ আসেনা। পুজোর ঘর শুধুই রুমির। মনের সবটুকু দিয়ে প্রতিদিন দুবেলা বেশ কিছুটা সময়, সে ঘরেই তার যাবতীয় সুখ, আনন্দ। আর আছে সেই ঘর লাগোয়া ছাদ বাগান। সে বাগান তার নিজের হাতে তৈরী। রুমির যত্নে ভালোবাসায় ফুলগুলো যেন রঙীন স্বপ হয়ে গাছে ফুটে থাকে।
আজ সকাল থেকেই চলছে পুজোর আয়োজন। ভোগ রাঁধা হয় একতলায়। লুচি বেগুন ভাজা, পোলাও, ছানার ডালনা, পায়েস….এ বাড়ীতে রুমির এটা দ্বিতীয় রথযাত্রা উৎসব। তার ভারী ইচ্ছে হয়, অন্তত পায়েসটুকু সে নিজে হাতে রেঁধে জগন্নাথদেব কে দেয়। কিন্তু তা আর হয়না। ভোগ রান্নায় শাশুরীমাকে হাতে হাতে সাহায্য করার মধ্যেই তার সে ইচ্ছাপূরণের স্বাদ পেতে হয়।
তবে এ বছর নিজের মতো করে রুমি ঠাকুর সেবার পথ খুঁজে নিয়েছে। ছোটবেলায় ঠাকুমার কাছে জেনেছিল তুলসী পাতা নাকি গাঁথেনা, সূতোয় বেঁধে মালা করতে হয়। আগের দিন সন্ধ্যাবেলা সেও ঠিক একই ভাবে তুলসীর মালা বানিয়েছে , তার ছাদ-বাগানের ফুল আর পাতা বাহারের রঙীন পাতা গেঁথে তৈরী করেছে জগন্নাথ বলরাম সুভদ্রার মাথার মুকুট। ভোরবেলা উঠে সবার আগে সেই মালা আর মুকুটে তাঁদের সাজিয়ে, রুমির আনন্দে যেন আত্মতৃপ্তির প্রসাদ। পুজোর গোছানোর ফাঁকে বারেবারেই চোখ চলে যাচ্ছে সেই শ্রীমুখের দিকে। পুজোর যোগার হয়ে গেছে।
ফল কাটাটুকু বাকি ছিল, তাও প্রায় শেষ। পুরোহিত ঠাকুরকে নিয়ে শাশুরীমা কখন দরজার কাছে এসে দাঁড়িয়েছেন, খেয়াল করেনি। খেয়াল হয় তাঁর গলার আওয়াজে। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায় রুমি। ঠাকুর নিয়ে সে ঠিক কি “ছেলেখেলা” করে ফেলেছে , কিছুতেই বুঝে পায়না। হাতে ধরা ছোট বাক্সটা সামলে মোড়ায় বসতে বসতে শাশুরীমাই উত্তর দিলেন,
……..তুমি তো জানো বৌমা, আমার একমাত্র ছেলেটার চাকরিতে একটা প্রমোশন হয়েছে। আমি তাই ঠিক করেছি, জগন্নাথ বলরাম সুভদ্রাকে এবার এই তিনটে সোনার মুকুট পড়িয়ে পুজো দেবো। এমন কিছুই তো নয়। মূর্তিও ছোট, তার মুকুটও ছোট। তুমি মাথায় ওসব ফুল পাতা কি চড়িয়েছো, বড্ড অপরিচ্ছন্ন দেখাচ্ছে, ওসব খুলে ফেলো।
খুলে ফেলবো?!! মনটা ভেঙে যায় রুমির। বড় সাধ করে সে তার ছাদ-বাগানের বেলি কলকে রঙ্গন আর পাতাবাহার গেঁথে তিনটে মুকুট বানিয়েছিল।
“অপরিচ্ছন্ন দেখাচ্ছে?!!”। সেই তিন মূর্তির দিকে তাকিয়ে থাকে রুমি। তার চোখে যে ভারী সুন্দর।
…….নাহ্ , আজ ভগবানের রাজবেশে সেজে ওঠার দিন। কোথায় সোনার মুকুট! আর কোথায় আমার অপটু হাতের তৈরী এই ফুল পাতার কাজ!!
কলকে রঙ্গন বেলি পাতাবাহারের মুকুট খুলে ফেলতে ফেলতে নিজেকে প্রবোধ দেয় রুমি।
পুজো শুরু হবে। পুরোহিত ঠাকুর তার আগে সোনার মুকুট তিনটে যথাস্থানে পরিয়ে দিচ্ছেন। কিন্তু সময় যেন একটু বেশিই লাগছে।
……….মাসীমা, আপনার এই মুকুট ঠাকুরকে পরানো যাচ্ছেনা। মাপ মতো হয়নি। পরাতে গেলেই চোখ ঢেকে যাচ্ছে।
……….বলো কি!! অতগুলো টাকা খরচ করে সোনার মুকুট কিনে আনলাম, আজ রথযাত্রার দিন পরাবো বলে, পরানো যাচ্ছেনা??!!
………..আপনি টাকা খরচ করলেই কি হয়ে গেলো মাসীমা?!! তিনি কোনটা গ্রহন করবেন, কোনটা করবেননা, কেন করবেন, কেন করবেননা , সে তিনিই জানেন। পুজোর দেরি হয়ে যাচ্ছে। আমি বরঞ্চ বৌমনির বানানো ফুলের এই মুকুট পরিয়ে পুজো শুরু করে দিলাম।
রুমির মন আনন্দে হাততালি দিয়ে ওঠে। সেই হাততালির শব্দ শুনতে পায়, একমাত্র ভক্তের ভগবান, যার উদ্দেশ্যে ভালোবাসায় গাঁথা সেই ফুলের মুকুট তৈরী হয়েছিল। ভক্তের আনন্দ তরঙ্গে ভাসবেন বলে হয়তো বা ভগবানও ছিলেন উন্মুখ।
ধূপ ধুনোর গন্ধে, মন্ত্রে,শঙ্খে তখন পুজোর পূর্ণ পরিবেশ। এমন পরিবেশ ক্ষেত্র বিশেষে কিছু উপলব্ধি হওয়াতে সাহায্য করে। বয়ষ্ক মানুষটিরও অহংকার বোধ হয়তো কিছুটা আঘাত পেলো, হয়তো বা তিনিও উপলব্ধি করলেন, ভগবান ভক্তের দাস, ভক্তি ভালোবাসায় ঘাটতি সোনার গয়নার চাইতে, ভক্তি ভালোবাসার সারল্যে পূর্ণ অপটু হাতের “অপরিচ্ছন্ন” ফুলের গয়না, তার কাছে অনেক বেশী আদরের।