অন্যতম লেখক-নাসরীন জাহান রীনার অনুভূতির অণুগল্প“এ কোন কোরবানি”

467
নাসরীন জাহান রীনার অনুভূতির অণুগল্প “এ কোন কোরবানি ”

এ কোন কোরবানি!
নাসরীন জাহান রীনা

রহিমা বিবির বেয়াইন সরাসরি নিজে না বললেও লোক মারফতে জানিয়ে দিল, কোরবানিতে খাসি পাঠাতে হবে। এটা তাদের বড় ছেলে, প্রথম আত্মীয়তা এটা মাথায় রাখতে হবে। খাসীর সাথে পেঁয়াজ, রসুন, আদা,জিরা গোলমরিচ, গরম মসলা, তেজপাতা, রান্নার তেল, পোলাওর চাল ইত্যাদি ইত্যাদি। পরিমাণটা এখানে না হয় নাই উল্লেখ করলাম।
স্বামী কালুমিয়া পক্ষাঘাতগ্রস্ত শয্যাশায়ী। তাই রহিমা বিবকেই দেখতে হয় সংসারের সব কিছু। এককালে কালু মিয়ার নিজের অনেক জমি ছিল। নিজেরা পড়াশোনা কম জানলেও কালু মিয়া আর রহিমা বিবির এটা জানা ছিল যে, ছেলে-মেয়েদের দু’কলম পড়াতে হবে। শুরুটা ভালই ছিল। কালু মিয়ার জমি থেকে আয় আসতো। একটা চালের আড়তও ছিল। ছেলে মেয়েকে স্কুলে দেয়। বৃদ্ধ বাবা-মা’র সেবা এবং সাংসারিক কাজকর্ম নিয়ে রহিমা বিবির ব্যস্ত সময়টা আনন্দেই কাটত। কিন্তু একদিন হঠাৎ করেই কালুমিয়া অসুস্থ হয়ে পড়ে। আর উঠে দাঁড়াতে পারেনি। আস্তে আস্তে জমিগুলো চলে যায় অন্যের দখলে। ছেলে মেয়ে বড় হতে থাকে,খরচ বাড়তে থাকে। কিন্তু আয়ের উৎস একদিন প্রায় শূন্যের কোঠায় চলে যায়।

বহুকষ্টে ধারদেনা করে রহিমা বিবি মেয়ে জরিনা’কে বিয়ে দেয়। জরিনা দেখতে-শুনতে পরীর মত। তাই বড় ঘর থেকেই তার প্রস্তাব আসে। বরপক্ষ কিচ্ছু চায়না শুধু মেয়েটা কেই চায়। তাই মোটামুটি আয়োজনেই বিয়েটা হয়। কিন্তু বিয়ের পর থেকেই আজ এটা, কাল ওটা করে করে রহিমা বিবির মাথায় বাজ পড়ে। অসুস্থ স্বামীর চিকিৎসা খরচ, ছেলে মাসুদ’র পড়ার খরচ, মেয়ের শ্বশুর-বাড়ির উপহার-উপঢৌকন, ধার দেনা পরিশোধের তাড়া সবমিলিয়ে রহিমা বিবির পাগল হয়ে যাওয়ার উপক্রম।

রোজায় ইফতারি, ঈদের সেমাই-চিনি শুধু এক একটা শব্দ নয়-এক একটা পাহাড় সম বোঝা। এবার আসলো কোরবানির ঈদ, সাথে আম-কাঁঠালের সময়। জরিনার শ্বশুরপক্ষের এক আত্মীয় মারা যায়। দায়িত্বের খাতিরেই রহিমা বিবি সে বাড়িতে সমবেদনা জানাতে যায়। সেখানে জরিনার শ্বশুরপক্ষের মহিলারা রহিমা বিবির ইজ্জতে ভালো মতন গোবর লাগায়। তাদের কথা হলো, মেয়ে বিয়ে দিলে খয়রাত করে হলেও এসব করা লাগে। তাদের মধ্যে অনেকে বলে, “আমি এই পাঠাইছি, আমি ওই পাঠাইছি।” রহিমা বিবির সাধ্য বিবেচনা করা দরকার আছে কি?
রহিমা বিবির যে লজ্জা নাই, তা তাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়া হয়। কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি আসে। সে কাঁপতে থাকে। কোরবানের ঈদে খাসী আর অন্যান্য উপহার না দিতে পারলে সে মুখ দেখাবে কেমন করে? ধার করতে করতে গলা সমান হয়ে গেছে। পাড়ায়ও আর সচ্ছল লোক বাকী নেই,যার কাছ থেকে সে ধার পাবে।

আজ কোরবানির ঈদ। মাসুদ জানে তাদের কোরবানি হচ্ছে না। তবু ঈদের নামাজটা তো পড়তে হবে। ঈদের নামাজ শেষে বাড়ি আসে। ঘরে ঢুকতে ঢুকতে ‘মা,মা’ বলে ডাকে। কিন্তু রহিমাবিবি সাড়া দেয় না। শেষে ঘরে ঢুকে দেখে মা’র ঝুলন্ত কোরবানি!

              ------------  সমাপ্ত  ----------

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here