অন্যতম লেখক-নাছরিন আক্তারের সমকালীন জীবনের গল্প“আলেয়ার বিভ্রাট”

538
অন্যতম লেখক- নাছরিন আক্তারের এক অদ্ভুত অনুভূতির গল্প“আলেয়ার বিভ্রাট”

“আলেয়ার বিভ্রাট “
নাছরিন আক্তার

ঢং ঢং করে দেয়াল ঘড়িটা দুটোর ঘণ্টা বাজায়। এই মধ্যরাতেও শহরের শরীর জুড়ে সোনালী রুপালী ইলিশের মতো চকচক করে আলো জ্বলে প্রায় জানালায় । রাত আর দিনের পার্থক্য কয়েকটা ঘন্টা মাত্র। সারা রাতই গাড়ির শো শো শব্দ, রিক্সার টুংটাং ছাড়াও ঘরে ঘরে রাতজাগা পাখিদের ফিসফাস শব্দ।

” রাত হলেই তোমাকে খুব কাছে পেতে ইচ্ছে করে “
মাঝরাতে এডাল্ট ফোন-আলাপে মেতে উঠেছে তরুণ-তরুণী। কিছুদিন যেতে না যেতেই এক সময় তা অভ্যাসে পরিণত হয় তাদের।

ইদানিং রাত্রির কাছে নেহাল রাত-বিরাতে ভিডিও কলে আসতে খুব বায়না ধরে। রাত্রিও ভালোবাসার আবদার রক্ষা করে তবে সে খেয়াল করে নেহালের উত্তেজনাপূর্ণ কথায় শরীর যেন কেঁপে উঠে হঠাৎ হঠাৎ ।

সময়ের আবর্তে সম্পর্কের প্রায় একবছর কেটে যায়। এদিকে রাত্রির শরীরের প্রতি নেহালের চাহিদা বাড়তেই থাকে। এই যেমন ন্যুড ছবির আবদার বা কখনো দেখা করার সময় রেস্টুরেন্টে গায়ে গা স্পর্শ করা। শুধু সরাসরি শারীরিক সম্পর্কটাই এখন বাকি আছে।

একদিন হঠাৎ নেহাল খুব জোড় করলো ফিজিক্যাল রিলেশন করতে। রাত্রি বারবার না করে আসছে। এতটা মনের জোড় ওর নেই। এমনিতে ভদ্র সুশীল পরিবারের মেয়ে হয়ে বাবা-মায়ের আড়ালে অনেক নিচু কাজ করে আসছে শুধুমাত্র ভালোবাসার কাছে বিবেক হারিয়ে।

কিছুদিন যেতে না যেতেই নেহালের আসল রূপ বের হলে তাদের ব্রেকাপ হয়ে গেলো। এরপর থেকে রাত্রিকে নেহাল হুমকি দিতে থাকে। ওর ন্যুডস ছবি সমাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছেড়ে দিবে বলে। তবে তার বিশ্বাস হয়নি যে ভালোবাসার মানুষটা এতটা খারাপ হতে পারে….

হঠাৎ একদিন রাত্রির ঘুম ভাঙ্গে মায়ের চড় খেয়ে।কারন সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে রাত্রির নগ্ন ছবি। প্রতিবেশী, আত্মীয়-স্বজন সবাই ছিঃ ছিঃ করছে। তার বড় ভাই বাসা থেকে বের হতে পারেনা এমনকি বন্ধু- বান্ধবী ও পরিচিতজনের টিপ্পনীর কারনে।

রাত্রি গৃহবন্দী, এতোদিনে তার ঘোর কেটেছে। ভালোবাসায় এতো অন্ধ ছিল যে! যাকে ভালোবাসে সময়ে অসময়ে নেহালের আহ্লাদী আবদারে বিরক্ত হলেও তার পরিনতি ভাবেনি। ভালোবাসা মানে তো দুটো মনের পবিত্র সম্পর্ক। ছিঃ! নেহাল এতটা খারাপ! সত্যিকারের ভালোবাসায় ফোন সেক্স, ন্যুডস নগ্নতা কিংবা ফিজিক্যাল কোনো চাহিদাই থাকে না। ভালোবাসার পূর্ব শর্তই হলো একে অন্যের প্রতি বিশ্বাস ও সম্মান রাখা। রাত্রি বুঝতে পারলো, সম্পর্কে আত্মসম্মান ও ব্যাক্তিত্ব বজায় রাখা কতটা জরুরি। অথচ ও কত বোকা, এতোদিন প্রেমিকা হিসেবে নয় বরং একজন দেহ ব্যবসায়ীর মত ট্রিট পেয়ে এসেছিলো নেহালের কাছে।শেষে তার প্রাপ্তির খাতাটা শূণ্য।

একসময় সব ঝামেলায় কাটিয়ে রাত্রি আবার পড়াশোনায় মন দেয়। বড় ভাই ফেরদৌস ওকে সাহস যোগায়, সাহায্য করে। মা- বাবা বিয়ে দিয়ে দিতে চেয়েছিলো কিন্তু ফেরদৌসের বক্তব্য এত ব্রাইট একটা মেয়ের জীবন এভাবে নষ্ট হতে পারেনা ভুল সিদ্ধান্তের কারনে। ব্রিলিয়ান্ট রাত্রি ঘুরে দাঁড়ায় মেডিকেলে চান্স পেয়ে চট্টগ্রাম মেডিকেলে চলে যায় ।

ছয় বছর পর রাত্রির বিয়ে হয়েছে বাবা-মায়ের পছন্দের ছেলে রায়হানের সাথে। সে আর কখনো পেছনে ঘুরে তাকায়নি।পড়াশোনাটা চালিয়ে গেছে।শত ঝড়ঝাপটা এসেছে, সয়ে গেছে। সইতে তো বাধ্য, যেহেতু সে জীবনের শুরুতে বড় ভুল করেছিল।

রায়হান রাত্রির পুরানো অতীত জেনেই বিয়েতে সম্মতি দিয়েছে। তার সাথে পরিচয়টা হাসপাতাল থেকেই। দুজনে এক সাথে ইন্টার্ণি করেছে।সেই থেকে রায়হানের রাত্রিকে পছন্দ।

বিয়ের পর রাত্রি রায়হানকে শুধু এইটুকুই বলেছিলো “আমার অতীত জেনেই তুমি আমাকে বিয়ে করেছো। কখনো অসম্মান করবে নাতো! “
রাত্রির হাতদুটো নিজের হাতে পুরে রাত্রির কানে ছন্দের লহর তুলে বলেছিলো
“ভালোবাসি, ভালোবাসি, ভালোবাসি। শুধু তোমাকেই ভালোবাসি। আমার রাত্রিকে ভালোবাসি। তার ভালোটাকে যেমন ভালোবাসি মন্দটাকেও তেমনই ভালোবাসি। “

আমার অতীত জেনেও এতটা ভালোবাসো?

রাত্রি, এই সময়ের সোসাল নেটওয়ার্কের যুগে এসব কোনো বিষয়ই না। ওসব অতীত আর মনে রেখোনা সোনা। আমি তোমাকে ভালোবাসি তোমার অতীত জানতে চাই না। অতীত আঁকড়ে কেউ বাঁচে না, ভবিষ্যতের সুখ স্বপ্ন নিয়ে বাঁচে, আমরা আগামী প্রজন্মের ধারক। আমরাই আগামী প্রজন্মকে অধুনিকতার সম্মুখে এগিয়ে নিয়ে যাবো।

রাত্রির বুক থেকে একটা ভাড়ি পাথর নেমে যায়। ও অপলক দৃষ্টিতে রায়হানের দিকে তাকিয়ে থাকে -মনে মনে বলে এখনো এত ভালো মানুষ পৃথিবীতে আছে বলেই পৃথিবী এত সুন্দর।

বিয়ের পর মধুচন্দ্রিমা , হানিমুন বেশ আনন্দ আহ্লাদে কেটে যায় ওদের। ওরা নিজের কোয়ার্টারে ফিরে আসে নিজের সংসার, নিজের কাজে ডুব দেয়।

কিছুদিন যেতেই রাত্রি রায়হানের মাঝে কিছু পরিবর্তন লক্ষ্য করে। সে প্রায় সময়ই বাইরে বাইরে কাটায় কিছু জিজ্ঞাস করলে বলে হাসপাতালে কাজ ছিলো। আবার যখন বিছানায় আসে কেমন হিংস্র হয়ে উঠে যেনো সব কামরে খাঁমছে ধ্বংস করে দিবে, আবার কখনো কখনো হঠাৎ বিছানা ছেড়ে উঠে যায় বা পাশ ফিরে শোয়। কিছু জিজ্ঞেস করলে বলে ক্লান্ত আছি কিংবা বলে ঘুম আসছে। ব্যাপার গুলো প্রথমে স্বাভাবিক মনে হলেও একসময় তা অসহ্য লাগে, সন্দেহ হয় রাত্রির। কি এমন হলো যে রায়হান বদলে যাচ্ছে!!

এক রাতে রাত্রি ইচ্ছে করেই খুব সাজগোছ করে। রায়হানের পছন্দ মতো রান্না করে। আজ অন্য রুপে রাত্রিকে দেখে রায়হানের খুব ভালো লাগে। খেতে বসে আরো অবাক সব ডিস ওর পছন্দের। খেয়ে উঠেই রায়হানের বায়না বিছানায় যাওয়ার।

রাত্রি জানে আজও বেশিদূর আগাবেনা সে। কিছুক্ষণ… চরম উত্তেজিতো করে একসময় বিছানা ছেড়ে উঠে যাবে। আজকাল রায়হানকে সাইকো রোগির মতো মনে হয় রাত্রির কাছে। তাই –
–আর নয় এ খেলা, এর একটা শেষ চায় রাত্রি । তাই রায়হানকে বলে –

–এখনি বিছানায় নয় এসো বারান্দায় একটু বসি। দেখো আকাশে কি সুন্দর চাঁদ! ধবধবে জোছনায় কেমন আলোকোজ্জ্বল রাত। আজ না ঘুমিয়ে চলো দুজন পাশাপাশি বসে গল্প করি।কিন্তু রায়হান নাছোরবান্দা ও বসবে না এখনি বিছানায় যাওয়া চাই –
এবার রাত্রি খুব শান্ত ভাবে বলে-
তোমার কি হয়েছে আমাকে বলবে?
রায়হান হা হা করে হেসে উঠে –
কই কি হবে! আজ তোমাকে রানীর মতো লাগছে। তোমাকে ছেড়ে আর এক মূহুর্ত থাকতে পারছিনা। ভালোবাসি।

রাত্রি মৃদু ভৎসনার সুরে বলে ভালোবাসো !! সব মিথ্যা। তাহলে এত কষ্ট দাও কেনো প্রতি রাতে
কেনো তুমি দিন দিন এভাবে দূরে সরে যাচ্ছো? আজ আমি সবটা জানতে চাই, আজ বলতেই হবে। আমি বাচ্চা মেয়েটি নই।তুমি সাইকো রোগীর মতো আচরণ করছো দিন দিন। “

রায়হান চুপচাপ বসে পরে বিছানায়।

— সত্যিই তো কি বলবে রাত্রিকে!এই একবিংশ শতাব্দীর আধুনিক যুগে এসেও ওর মনের এই সংকির্ণতা কি করে প্রকাশ করবে রাত্রির সামনে। ওর কি হয়েছে ও বিছানায় কেনো অন্য মানুষ হয়ে যায়। ও তো চায়নি এমন হোক। ও সবটা স্বাভাবিক ভাবেই নিতে চেয়েছিলো। আজকাল বিছানায় গেলেই রাত্রির দেহটাকে নিজের সম্পত্তি মনে হয়। সাথে সাথে এও মনে হয় ওর আগে অন্য কেউ এর দখলদার ছিলো। হোক সেটা ভার্চুয়াল। তখন ওর ভিতর একটা প্রতিশোধ পরায়ন মন জেগে ওঠে। কখনো হামলে খাঁমচে কখনো রাত্রিকে চরম উত্তেজিত করে ফেলে রেখে কষ্ট দিয়ে আনন্দ পায়। দিনে আবার এর জন্য অনুতপ্ত হয় তাই তো রাত্রির কাছ থেকে পালিয়ে বেড়ায়। অথচ রাত হতেই আবার সেই একই টান অনুভব করে।

রাত্রিও ছোট মেয়েটি নয় ও এডাল্ট ও নিজেও একজন ডাক্তার। ও বুঝে গেছে। রায়হান মুখে মুখে যতই আধুনিকতার গল্প করুক তবুও চিরাচরিত বাঙালি সংস্কার থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি। ও তার জন্য রায়হানকে একদমই দায়ী করে না যুগ যুগ ধরে, দাদা, বাবা চাচাদের দেখে দেখে যে শিক্ষা ব্রেনে ঢুকে গেছে আজ যতই আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হোক না কেনো সেখান থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি এখনো তথাকথিত পুরুষ সমাজ। হয়তো বা দু’একজন তার ব্যাতিক্রম। রাত্রি রায়হানকে সে ব্যাতিক্রমিদের একজন ভেবেছিলো। আসলে ও ভুল ছিলো। সময়ের সাথে সাথে সেই হিংস্রতা প্রকাশ পেয়েছে।

নিজেকে খুব ছোট লাগে, দিনের পর দিন এভাবে নিজেকে আর লাঞ্চিত করবে না সে। তার চেয়ে একা থাকা অনেক ভালো। রাত্রি আগে থেকেই ব্যাগ গুছিয়ে রেখেছিলো। চুপি চুপি ঠিক করে রেখেছিলো কোথায় যাবে, কোথায় থাকবে।
তাই ব্যাগ তুলে নিয়ে মাথা উচু করে বাসা থেকে বেরিয়ে যায়। যাওয়ার সময় রায়হানকে বলে যায় –
—–আমার মনে হয় তোমার একজন সাইকোলজিস্ট এর কাছে যাওয়া প্রয়োজন।
আমাকে খুঁজ না। যদি কোনদিন একজন সুস্থ মানুষ হতে পারো তবেই আমি ফিরবো।

পঁচিশ বছর পরের কথা এখন রাত্রির চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা। ভালো করে লক্ষ্য করলে সিঁথার দুপাশে সাদা চুলের রেখা চোখে পরে। রায়হানের শরীরেও বয়সের ছাপ স্পষ্ট । ওদের মেয়ে অরিত্রির বিয়ে। বর মেরিন ইঞ্জিনিয়ার। মেয়েও মায়ের মত ডাক্তার। আর একমাত্র ছেলে বুয়েটের স্টুডেন্ট ।আজ ওদের সংসারে কোথাও আঁধারের কালো ছোপ নেই।
সেদিন রাত্রি চলে যাওয়ার পর রায়হান নিজে নিজে অনুতপ্ত হয়। ওর বন্ধু অভিকে ফোন করে সবটা খুলে বলে। অভিই ওকে সাইকোলজিস্ট এর কাছে নিয়ে যায়। কিছুদিন সাইকো থেরাপি ও হালকা কিছু ঔষধ নেওয়ার পর ও ডিপ- ডিপ্রেশান থেকে বেরিয়ে আসে।দু পক্ষ্যের অভিবাবকরাই আবার ওদের দূরত্বের অবশান ঘটায়।

রাত্রি শিক্ষিত ও বদ্ধিমতী পোড়খাওয়া “মা “।ও ঠেকে শিখেছে। রাত্রি চায়নি ওর ছেলে মেয়েদের জীবনেও ওর জীবনের পুনরাবৃত্তি ঘটুক তাই ছেলে মেয়ে বয়ঃসন্ধি পার হওয়ার সাথে সাথে রাত্রি ও রায়হান একদিন এক সাথে বসে নিজের অতীতের উদাহরণ দাঁড় করিয়ে ছেলে মেয়েকে সাবধান করে দেয়। একই ভুল যেনো ওর ছেলে মেয়ে না করে।।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here