ইমেজ
কমলিকা দত্ত
প্রতিমার কাজ করতে করতে প্রায় তিরিশটা বছর।
এই তল্লাটে সদার মতন মূর্তি গড়ার কারিগর খুঁজে পাওয়া ভার । এ কথা সবাই একবাক্যেই মানে। সদা, মানে সদানন্দ সিমুই। তার শৈল্পিক দক্ষতা এই অঞ্চলে সন্দেহাতীত।
দূর দূরান্তের লোকেরাও সদার নাম ও কাজের সঙ্গে পরিচিত।
তবে এ বছরও যে সদা প্রতিমা গড়বে সে কথা বোধ হয় অনেকেই ভাবতে পারেনি।বিশেষত যারা কদিন আগেই, সদার বিধ্বস্ত পরিবারের আর্তনাদ শুনেছে।
সদা আজকাল খুবই কম কথা বলে।প্রতি বছর তাকে মূর্তি গড়ার কাজে সাহায্য করে নিতাই এবং মাধব।প্রায় বারো বছর ধরে সদার কাছেই কাজ করছে ওরা।একমেটে থেকে দোমেটে প্রলেপ, অলংকরণ,রঙ, গয়না,সব কাজ সদার কাছেই শেখা।
মূর্তির কাজ করতে করতে মজার মজার গল্প করত সদা। প্রায়শই চলত বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের মহিষাসুর মর্দিনী,নাহলে ভক্তিগীতি। সদার হাতের টান অপূর্ব। আশেপাশের প্রায় সব পূজো মন্ডপেই সদার হাতে গড়া প্রতিমার অর্ডার পড়ত। এ বছরও তাই। কিন্তু এ বছর সে বেশি অর্ডার নেয়নি। বয়সও এগিয়েছে প্রায় সত্তরের কোঠায়। তবে বয়স নয়,সদার ক্রমশ ফুরিয়ে আসা প্রাণশক্তির পেছনে ছিল এক মর্মান্তিক অধ্যায়।
গত বছর তার নাতনী ইরাবতী পাশের পাড়ার কুমারী ঠাকুর সেজেছিলো। মেয়েটি যেন সাক্ষাৎ প্রতিমা।
মায়া ভরা মুখ, তার ওপর ঐ টুকু মেয়ের পিঠজুড়ে এক গোছা চুল। তেমনই রোদ ঝলমলে হাসি।
খুব ঘটা করে পূজোও হয়েছিল তার।
কিন্তু বিসর্জনের আগেই সে আর ঘরে ফেরেনি। কুমারী পূজার পর,মহানন্দে পাড়ার এক কাকিমা ও তার পিসির সঙ্গে ঠাকুর দেখতে গিয়েছিল দেবী।
পিসি আর কাকিমা অন্যদের সঙ্গে কথায় ব্যস্ত,এদিকে দেবীও মন্ডপের এদিকে সেদিকে ছোটাছুটি শুরু করছে। এ বছর সে কুমারী ঠাকুর, মনের মধ্যে একটা প্রফুল্লতা। কিন্তু তারপর…
সেদিন ছিলো নবমী।
তার ছিন্ন ভিন্ন শরীরের অঙ্গ প্রত্যঙগগুলোর প্রমাণ মিলল কোনো এক আস্তাকুঁড়ে। বিজয়ার দিন বিভীষিকা আর অব্যক্ত বেদনার কালো মেঘে ঢেকে গিয়েছিল সদার ঘরের আকাশ। ঢাকের আওয়াজ ছাপিয়ে উঠেছিল হাহাকার।
তারপর থানা পুলিশ অনেক কিছু , পাড়ার নেতাকে ধরাধরি–ইত্যাদি, ইত্যাদি । কিন্তু দোষীদের বিসর্জন হয়নি। তবে সদার পরিবার বুঝেছে, এখনও তাদের চারপাশের মানুষের মধ্যেই সেই অসুর মিশে আছে,কিন্তু সে মর্ত্যের বেশ ক্ষমতাধারী নরাসুর। তার সঙ্গে এঁটে ওঠা তাদের মত পরিবারের পক্ষে সম্ভব নয়। বৃদ্ধ সদা কিন্তু হাল ছাড়েনি।তারপর যখন তার বৌমা নয়নতারার ওপর বিভিন্ন প্রতিশোধাত্মক আচরণের প্রভাব আসতে থাকল,তখন…
তাছাড়া দেবী বাপ মরা মেয়ে । সদার এক ছেলে, দুই মেয়ে। ছেলেটি প্রায় বছর তিনেক আগে কোনো এক পথ দূর্ঘটনায় মারা যায়। তার মৃত পুত্র ও বিধবা বৌমার একমাত্র সন্তান ছিলো দেবী৷
সবাই ভেবেছিল সদা বোধহয় আর কাজ করতে পারবে না। ক্রমশ বিষন্নতায় তার শরীর ও মন অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়ছিল।
কিন্তু দিব্যি এ বছর অর্ডার নিয়েছে সে।
প্রায় আটটা ঠাকুরের অর্ডার।
সদার নিখুঁত মুন্সিয়ানা এত বছর ধরে সবাই দেখে এসেছে। ফলে তার ওপর অগাধ আস্হা।
কিন্তু এ বছর সদা একাই বেশির ভাগটা করেছে।
মাধব আর নিতাই সঙ্গে থাকলেও তাদেরকে খুব বেশি কাজের দায়িত্ব দেয়নি সদা।
প্রতিমা বানানোর ছাউনিটা চারিদিক থেকে ঢেকে দিয়েছে এবার। তেমন একটা লোকজনও আসেনি সদার আটচালায়। সবাই জানে, আজকাল সদা খুব চুপচাপ থাকে। কাজের সময় গানও আর চলে না এখন।
যারা বায়না করে গেছে তাদের সবার জন্যই ঠাকুর নিয়ে যাওয়ার নির্দিষ্ট দিন ধার্য করে দিয়েছে সদা।
মাঝে দু একবার কেউ খোঁজ খবর নিতে এলেও তেমনভাবে ছাউনিতে ঢুকতে দেয়নি সদা।
অন্বেষণ, লিটল স্টার, বা নবতরু যে ক্লাবের সদস্যরাই মাঝে মধ্যে এসেছে মূর্তির খোঁজ নিতে সদা একটা মূর্তিই সকলকে দেখিয়েছে।
কি অপরূপ নির্মাণ তার! সবাই মুগ্ধতা নিয়ে ফিরে গেছে।
চতুর্থীর দিন সদার তৈরী দেবী প্রতিমা পৌঁছে গেছে প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে।ঠাকুরের মুখ বাঁধা।
ষষ্ঠীর দিন বেলতলার পূজো সেরে,প্রতিমার চক্ষুদানের কাজ সুসম্পন্ন।
মন্ডপে মন্ডপে সাজ সজ্জা, পূজার আয়োজন,ঢাক বাজছে। উলু, শঙ্খ ধ্বনি সহ
ঠাকুরের মুখ উন্মোচিত হল–এক ঝলক দেখেই আঁতকে উঠল সবাই। এ কি?
ত্রিশূল হাতে দাঁড়িয়ে রয়েছে অসুর
পায়ের তলায় রক্তাক্ত দূর্গা নেতিয়ে পড়েছে
কার্তিক গণেশ কেউ নেই, মুন্ডুপাত হওয়া চারটি নারীর শরীর।
মৃত সিংহের মাথাটা পেছনের দিকে ঘোরানো।
সদার সঙ্গে রোজ বটতলায় আড্ডা দিত শম্ভু। সদার থেকে দু তিন বছরের বড়। বড় ঝিলে তার মাছ চাষের ব্যবসা।
এখন সে বটতলা উন্নয়ন সমিতির সভাপতি হয়েছে । এবছর সমিতির পূজোর অনেক দায়িত্ব তার।
বটতলার মন্ডপে এমন ঠাকুর দেখে , শম্ভু সর্দার দৌড়ে আসে সদার কাছে।
— সদা,সদা
সদা তখনও প্রতিমা গড়ছে —
একটি ছোট্ট মেয়ে,আটপৌরে শাড়ি, মাথায় ঘোমটা,হাতে একমুঠো শিউলি,
কি অপূর্ব তার চোখ নাক মুখ।
অবাক চোখে দাঁড়িয়ে রয়েছে শম্ভু।
সদা ঘাড় ঘুরিয়ে বলল–
— কিছু বলবে?
-ভাঙা ভাঙা উচ্চারণে শম্ভু জিজ্ঞেস করল
— তুই, এ কি রকম প্রতিমা গড়ে পাঠিয়েছিস সদা!
ওরা তো ভীষণ…
—এত বছরে এই তো প্রথম আসল মূর্তি গড়তে শিখেছি গো শম্ভু দা।
বায়না গুলো একসাথে রাখা আছে।
কিছু বলতে এলে পুরোটাই ফিরিয়ে দেব।।
— মানে? মানে তুই কি সব মন্ডপেই…
— হ্যাঁ গো সব মন্ডপে একই রকম গড়েছি।।
শম্ভু মুহুর্তের জন্য চুপ করে গেল।তারপর ধীরে ধীরে এগিয়ে এলো ছোট্ট কুমারী প্রতিমাটির কাছে।
–সদা, পূজা কমিটির লোকজন কে কি বলবে জানি না,তবে এ বছরই কেন? এর আগে কি তুই এমন মূর্তি গড়ার প্রয়োজন বোধ করিসনি?
এর আগেও তো কারো না কারোর নাতনির অকালে বিসর্জন হয়েছে।
নির্বাক, নিথর হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে সদা।
—কি রে–?
এই প্রশ্নের জন্য তৈরি ছিলো না সদা।
অপরাধবোধ নিয়ে অপলক চোখে দাঁড়িয়ে রইল সে। ছাউনির বাইরে কোলাহল ক্রমশ গাঢ় হয়ে উঠল…