ভারতের অন্যতম লেখক-অন্তরা ঘোষ এর সমকালীন জীবনের গল্প“লাভারস পয়েন্ট ”

302
অন্তরা ঘোষ এর সমকালীন জীবনের গল্প“লাভারস পয়েন্ট ”

লাভারস পয়েন্ট
অন্তরা ঘোষ

দার্জিলিং শহর থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার দূরে ছবির মতো ছোট্ট সুন্দর গ্রাম তিনচুলে। কোথাও কুয়াশার চাদরে মোড়া পাহাড়, কোথাও আবার দিগন্ত বিস্তৃত সবুজের সমারোহ, আবার কোথাও পাহাড়ি রাস্তা এঁকে বেঁকে গেছে… দুপাশে পাইন .. কোথাও বা রডোডেনড্রনের মন মাতানো রূপ, আবার কোথাও রংবেরঙের ফুলের বাগান.. আমেরিলিজ ক্রিমসন, গেন্দা, ম্যাগনোলিয়া,
এন্থেরিয়াম, জারবেরা বিভিন্ন অর্কিড, বিভিন্ন ধরনের ক্যাকটাস ফুল… এত রংয়ের সমাহার একসাথে দেখে চোখ জুড়িয়ে যায়।আবার কোথাও যতদূর চোখ যায় অনেকটা জায়গা জুড়ে চায়ের বাগান। এমন নয়নাভিরাম সৌন্দর্য ঠিক যেন জলরঙে আঁকা ছবি।
রাস্তার উপরের দিকে ছোট ছোট টিনের চালের বেশ কিছু কটেজ চোখে পড়বে। এখানেই ড্রাইভার পবন থাপার বাড়ি। পবন বছর ছাব্বিশের একটি তরতাজা নেপালি যুবক। বলিষ্ঠ সুঠাম চেহারা.. কিন্তু চোখ দুটো ছোট ছোট হলেও খুবই কোমল। কেমন যেন স্বপ্নময়।
ভোরবেলাটা পবনের খুব প্রিয়। তুষারশুভ্র কাঞ্চনজঙ্ঘার সাথে ওর দারুন সখ্যতা। প্রতিদিন ভোরবেলায় উঠে গ্রামের পথে বেরিয়ে পড়ে পবন। কাঞ্চনজঙ্ঘার সাথে কিছুটা সময় কাটায়। প্রথম সূর্যের আলোয় সোনার পাতে মোড়া কাঞ্চনজঙ্ঘার মনোমোহিনী রূপের দিকে তাকিয়ে থাকে পবন।
বাবা-মা-ভাই-বোন আছে বাড়িতে। পবনের জীবনে আপাতত একটাই গার্লফ্রেন্ড। সেটা হল তার লাল টুকটুকে মারুতি সুইফট। গাড়িটা তার প্রাণ। পবন আদর করে নাম রেখেছে লালিমা। কলকাতা থেকে অনেক বাঙালি টুরিস্ট আসে দার্জিলিং ও তার আশেপাশে টুরিস্ট স্পটগুলো ঘুরতে। তাই প্রায় প্রতিদিনই পবনের গাড়ির বুকিং থাকে। বাংলাটাও এখন ভালোই বলতে পারে পবন। এতদিন ধরে বেশির ভাগ বাঙালি টুরিস্টদের গাড়িতে ঘুরিয়ে বাংলাটা রপ্ত করতে খুব একটা কষ্ট করতে হয়নি তাকে। বাংলা সিনেমা দেখতেও খুব ভালোবাসে পবন। বিখ্যাত বাঙালি অভিনেত্রী অরুনিমা সেন পবনের স্বপ্নের নায়িকা। দেখতে যেন একদম রাজকুমারী। সিনেমার পর্দায় যখন দেখে অরুনিমা সেনের কটাক্ষ চাওনি ,পাগল করা হাসি — পবনের মনে যেন ঝড় উঠে।
আজ পবন কার মুখ দেখে উঠেছিল কে জানে ! বন্ধু গণেশ পবনকে এসে খবর দেয় যে আজ লাভারস্ পয়েন্টে নায়িকা অরুণিমা সেন একটা বাংলা সিনেমার শুটিংয়ের জন্য আসছে।
তার প্রিয় নায়িকা আসছে তার শহরে ! পবনের যেন বিশ্বাসই হচ্ছে না। সকাল দশটায় নাকি আসার কথা। এখান থেকে খুব বেশী দূরে নয় লাভারস্ পয়েন্ট। বড়জোর দশ – বারো কিলোমিটার হবে। পবন তার গার্লফ্রেন্ড লালিমাকে সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে গেল লাভারস্ পয়েন্টের পথে।
লাভারস্ পয়েন্টে আজ ” বহ্নিশিখা” ছবির শুটিং হচ্ছে। ক্যামেরা ম্যান, মেকাপ ম্যান , ট্রলিম্যান, নায়িকা ও নায়কের মেকআপ ভ্যান, শুটিং স্পটের লোকজন সব মিলে লাভারস্ পয়েন্ট একদম জমজমাট। নায়িকা অরুনিমা সেনকে কাছ থেকে দেখার জন্য ইতিমধ্যেই বেশ ভিড় জমে গেছে ওখানে। মেকআপ ভ্যান থেকে অরুনিমা বাইরে এল। পবন মুগ্ধ হয়ে দেখছে তার স্বপ্নের রাজকুমারীকে। চোখের যেন পলক পড়ছে না। পর্দায় দেখা নায়িকার থেকেও সুন্দর লাগছে আজ অরুনিমাকে। প্রায় ৫ ফুট ৭ ইঞ্চি লম্বা হবে , মাখনের মত গায়ের রং, কাঁধ অবধি কাটা স্টেপ কাট চুল, ছোট্ট কপাল, টানা টানা চোখ, টিকালো নাক, পাতলা গোলাপের পাপড়ির মত ঠোঁট, চাঁপাকলির মত হাতের আঙ্গুলে নেলপালিশ, বেবি পিংক রংয়ের জর্জেটের শাড়ি আর স্লীভলেস ব্লাউজে সত্যি স্বপ্নসুন্দরী মনে হচ্ছে অরুনিমাকে। কিন্তু পবন লক্ষ্য করল অরুনিমার মুখে যেন জোর করে আনা হাসি.. কোথাও যেন একটা বিষন্নতা ঘিরে আছে অরুনিমাকে।

লাভারস্ পয়েন্ট খুব প্রিয় জায়গা অরুনিমার। তিন বছর আগে এখানে একবার শুটিং করতে এসেছিল অরুনিমা। ওই সিনেমার নায়ক ছিল রাহুল ।একদিকে দার্জিলিং এবং আর একদিকে কালিংপঙ। দুদিক থেকে গভীর পাহাড় নিচের দিকে একটা বিন্দুতে গিয়ে যেন মিলেছে। পাহাড়ের গায়ে মেঘেরা খেলে বেড়াচ্ছে। কুয়াশা ঢাকা পাহাড় গুলোকে যেন আরো রহস্যময় মনে হয়। নিচে একদিকে তিস্তা অন্যদিকে রঙ্গীত নদী বয়ে চলেছে কোন একটা পয়েন্টে যেন ওরা মিট করবে বলে।
অরুনিমার বয়ফ্রেন্ড রাহুল ওকে প্রথম এখানেই প্রপোজ করেছিল– আজও মনে আছে অরুনিমার। অরুনিমাকে চোখ বন্ধ করতে বলেছিল রাহুল।তারপর হাঁটু গেড়ে বসে হাতে একগুচ্ছ রডোডেনড্রন ফুল নিয়ে অরুনিমার হাতটা ধরে বলেছিল, তিস্তা আর রঙ্গীত নদীকে সাক্ষী রেখে এই লাভারস পয়েন্টে আজকে তোমাকে প্রপোজ করছি অরুনিমা, তুমি কি আমার সারা জীবনের সঙ্গী হবে?
রাহুলের ইনোসেন্ট মুখের অভিব্যক্তি আর এমন নৈসর্গিক পরিবেশে এমন ভাবে প্রেমের প্রপোজাল পেয়ে অভিভূত হয়েছিল অরুনিমা। হ্যাঁ করতে দেরি করেনি। একঘন্টা সময় চেয়েছিল অরুনিমা ভাবার জন্য। রাহুলকে বলেছিল আশেপাশে থাকতে.. পাহাড়ের মারফত জানিয়ে দেবে ওর মনের কথা। ঠিক এক ঘন্টা পর অরুনিমা মুখের কাছে হাত এনে চিৎকার করে বলেছিল রাহুল আই লাভ ইউ..পাহাড়ে পাহাড়ে প্রতিধ্বনিত হয়ে ঘুরছিল কথাটা রাহুল আই লাভ ইউ.. লাভ ইউ ….লাভ ইউ….
রাহুল আশেপাশে যেখানেই ছিল অরুনিমার জবাব পেয়ে গেছিল। দু চার মিনিটের মধ্যেই অরুনিমা পাহাড়ের গায়ে ইকো হওয়া রাহুলের গলার আওয়াজ পেয়েছিল’ আই লাভ ইউ টু …সুইট হার্ট”..
কি যে ভালো লেগেছিল অরুনিমার।
কদিন থেকেই মনটা খুব খারাপ অরুনিমার। রাহুল ওকে এই ভাবে বিট্রে করবে ভাবতে পারেনি। ইন্ডাস্ট্রির সকলেই জানত রাহুল অরুনিমার প্রেমের কথা। ওদের যে খুব শীগ্রই বিয়ে হবে এ ব্যাপারে সকলে নিশ্চিত ছিল। ওদের প্রেম নিয়ে ইন্ডাস্ট্রিতে যথেষ্ট চর্চা হত একসময়। পার্টি হোক ,শুটিং স্পট বা কোন অনুষ্ঠানে সব সময় ওদের একসাথে দেখা যেত। ওদের এই আইডিয়াল প্রেম দেখে হয়তো অনেকে মনে মনে হিংসাও করত। দুজনেই ঠিক করেছিল ক্যারিয়ারে আরেকটু এস্টাবলিশ্ড হয়ে তারপরে বিয়ে করবে। যদিও সামাজিকভাবে শুধু স্বামী-স্ত্রী হওয়া ওদের বাকি ছিল। শরীর-মন দুজন দুজনকে অনেক দিনই সমর্পণ করেছিল। দুজনই একই ফ্ল্যাটে থাকত মানে লিভ টুগেদার করতো। এরপরই এলো অরুনিমার জীবনে কালবৈশাখী ঝড়। কিছুদিন আগে ইন্ডাস্ট্রির নবাগত রেশমির সাথে রাহুল সিনেমা করে। তখনই রাহুল রেশমির সম্পর্ক নিয়ে কিছু গসিপ ইন্ডাস্ট্রিস আকাশে বাতাসে উড়ছিল। অরুনিমার কানেও সে খবর এসেছিল। কিন্তু অরুনিমার পুরোপুরি বিশ্বাস ছিল রাহুলের ভালবাসার উপর। তাই ওইসব গসিপে কখনো কান দেয়নি। তবে বেশ কিছুদিন থেকে রাহুলকে একটু অন্যমনস্ক দেখছিল অরুনিমা। মাঝে মাঝেই মাত্রাতিরিক্ত ড্রিঙ্ক করে বাড়ি ফিরছে। শার্টে লেডিস পারফিউমের গন্ধ ! তারপর একদিন অরুনিমার ইমেইল আইডিতে অরুনিমার কোন এক ফ্যান রাহুল রেশমির ঘনিষ্ঠ অবস্থার বেশ কিছু ফটো পাঠাল।
ফটোগুলো দেখে আর বিশ্বাস ধরে রাখতে পারলো না অরুনিমা। ভালোবাসার দেয়ালে ফাটল ধরল। দুদিন থেকে রাহুল ঘরে আসেনি। দুদিন পর রাহুল মদ্যপ অবস্থায় ঘরে ফিরলে অরুণিমা সরাসরি রাহুলকে জিজ্ঞেস করলো রেশমির সাথে ওর কি সম্পর্ক।
রাহুল বলল, “ব্যাপারটা যখন তুই জেনে গেছিস তাহলে শোন কিছুদিন থেকেই মনে হচ্ছে তোর আমার সম্পর্কটা ওয়ার্ক করবেনা। কোথাও যেন ছন্দপতন হচ্ছে। মাঝে মাঝে তোর মাস্টারনী অ্যাটিটিউড আমি ঠিক মেনে নিতে পারছিনা। রেশমি খুব উচ্ছল প্রাণবন্ত মেয়ে। ওর সাথে টাইম স্পেন্ড করতে, ওর কোম্পানি পেতে আমার ভালো লাগে। হয়তো ওকে আমি ভালোবেসেও ফেলেছি। দু-একদিনের মধ্যেই আমি তোর ফ্ল্যাট ছেড়ে চলে যাব “।
চারিদিকে ঘন অন্ধকার দেখলো অরুনিমা।তিন বছর একসাথে থাকার পর আজ রাহুলের মনে হলো ওর আর রাহুলের মধ্যে কেমিস্ট্রির অভাব আছে !
রাহুলের কাছে এগিয়ে এসে ওর জামাটা খিমচে ধরে চাপা গলায় অরুনিমা বলল, আমার তিন তিনটে বছর ফেরত দে রাহুল.. আমার শরীর আমার মন সবটা আমি তোকে চোখ বুজে দিয়েছিলাম.. সবাই জানে আমাদের বিয়ে হবে.. তুই আমাকে এই ভাবে ঠকালি!
কোন কথা বলল না রাহুল। অরুনিমার হাত ছাড়িয়ে ঘরের ভেতর দিকে চলে গেল। সেদিন তিনটে ঘুমের ওষুধ খেয়ে অরুনিমা শুলো। তবুও তো ঘুম আসছেনা। সকল পুরুষের রাতের ঘুম কেড়ে নেওয়া গ্ল্যামার ওয়ার্ল্ডের সুন্দরী নায়িকার নিজের চোখেই আজ ঘুম নেই। দু পেগ হুইস্কি আর তার সাথে সিগারেট চলতে থাকল। চোখে জল নেই অরুনিমার। অসহ্য যন্ত্রণা শুধু ভিতরে কুরে কুরে খাচ্ছে মনটাকে। শেষ রাতে ঘুমিয়ে পড়ল অরুনিমা। পরদিন সকাল দশটায় যখন ঘুম ভাঙলো দেখল রাহুল ওর সমস্ত জিনিসপত্র নিয়ে চলে গেছে। মাটিতে হাটু গেড়ে বসে বুকে বালিশ চেপে ধরে বাচ্চা মেয়ের মত ফুলে ফুলে কাঁদতে লাগল অরুনিমা। এক প্রেমে প্রত্যাখ্যাত নারীর যন্ত্রণার সাক্ষী রইল ঘরের দেওয়াল গুলো। কিন্তু সময় তো কারো জন্য থেমে থাকে না।
ভিতরে যতই কাটাছেঁড়া হোক অভিনেত্রীদের অভিনয়টা করে যেতেই হবে। ব্যাক্তিগত জীবনে যত ঝড় ঝাপটাই থাকুক না কেন !
অরুনিমা যখন শুনলো লাভারস্ পয়েন্টে নেক্সট শুটিং — অরুণিমা আসতে রাজি হয়ে গেল। লাভারস্ পয়েন্ট সবসময় তার জন্য একটা প্রিয় জায়গা। এখানেই তো ভালোবাসা খুঁজে পেয়েছিল এক সময়। তাই কি লাভারস পয়েন্ট আজও বারবার তার মনটাকে টানে!
আজ বারবার রিটেক করতে হচ্ছে অরুনিমাকে। কিছুতেই যেন পারফেক্ট ইমোশনটা অভিনয়ের সময় আসছে না। বারবার এন. জি .হয়ে যাচ্ছে। অরুনিমার মুড নেই দেখে ডিরেক্টর আজ তাড়াতাড়ি প্যাকআপ করতে বলল। পবন বুঝতে পারছে কোনো কারনে অরুনিমা ম্যাডাম বোধ হয় খুব আপসেট।

শুটিংয়ের পর সবার চোখের আড়ালে একটু হেঁটে গিয়ে রেলিং ধরে অরুনিমা নিচের দিকে লাভারস্ পয়েন্টের নৈসর্গিক দৃশ্য তনময় হয়ে দেখছিল।
পবন সাহস করে এগিয়ে গেল।
অরুনিমাকে বলল, নমস্তে ম্যাডাম… আমার নাম পবন। আমি আপনার খুব ফ্যান। আজকে আপনাকে একটু বেইচন কেন লাগছে ম্যাডাম..
অরুনিমা চমকে তাকিয়ে দেখল তার সামনে একটা সুদর্শন অল্প বয়সী নেপালি যুবক যার মুখে শিশুসুলভ এক অদ্ভুত সারল্য।
অন্য সময় পাবলিকের এই ধরনের প্রশ্নে অরুনিমা রেগে যেত। আজ পবনের মুখে কি দেখলো কে জানে — রাগ করতে পারল না। জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা পবন, এই জায়গাটার নাম লাভারস পয়েন্ট কেন বলতে পারবে ?
অরুনিমা ম্যাডাম তার সাথে কথা বলেছে তার সাত জনমের ভাগ্য। খুশি হয়ে পবন বলতে লাগলো, ঠিক জানিনা ম্যাডাম.. তবে এদিকে একটা গল্প প্রচলিত আছে.. দার্জিলিংয়ের গোল্ডেন ফ্রিঞ্চ পাখি দেখেছেন ম্যাডাম ?.. খুব সুন্দর দেখতে.. ঠোটটা লাল টুকটুকে.. কাঁচা সোনার মত গায়ের ,নরম পালকে সাদাকালো বর্ডার,গলার কাছে কালো দাগ.. চোখের কোনে কালো হলুদ ছোপ, লেজটা সাদাকালো.. যেন ভগবানজি রং তুলি দিয়ে ফ্রিঞ্চ পাখিকে খুব যত্ন করে নানান রঙ্গে সাজিয়ে পৃথিবীতে পাঠিয়েছে। দুটো গোল্ডেন ফ্রিঞ্চ এই লাভারস পয়েন্টে থাকতো.. কতদিন ওদের একসাথে দেখা গেছে একজন আরেকজনের ঠোঁটে ঠোঁট ঘষছে ,গায়ে মুখ ঘষছে। সব সময় ওদের জোড়ায় জোড়ায় দেখা যেত। একদিন প্রেমিকা ফ্রিঞ্চ বাসায় ছিল .. আর প্রেমিক ফ্রিঞ্চ লাভারস্ পয়েন্টের গভীর উপত্যকার আকাশে উড়ছিল খাবারের সন্ধানে। এমন সময় এক নিষ্ঠুর শিকারি বন্দুক দিয়ে টার্গেট করে পুরুষ ফ্রিঞ্চকে গুলি করে। কিন্তু স্থানীয় লোকজন এসে শোরগোল করায় শিকারিটা পালিয়ে যায়। অন্য দিকে প্রেমিকা ফ্রিঞ্চ পাখিটা একা একা বেশ কিছুদিন তার সাথীকে খুঁজে বেড়ায়। অবশেষে একদিন সেই মনমরা সাথীহারা ফ্রিঞ্চ পাখি তার নিজের ডানাকে গায়ে মুড়ে নিয়ে প্রেমকে হারিয়ে পাহাড় থেকে নিচে লাভারস পয়েন্টের গভীরে লাফিয়ে পড়ে সুইসাইড করে। দুই সুন্দরী পক্ষী যুগলের ভালোবাসার করুন পরিনতি হয় এখানে। তাই এই জায়গাটাকে অনেকে লাভারস পয়েন্ট বলে।
শুনতে শুনতে অরুনিমার গভীর কালো মায়াবী বড় বড় চোখ অশ্রুসজল হয়ে ওঠে। প্রেম হারানোর যন্ত্রণা আজ তার থেকে আর কেইবা ভালো বুঝবে!
পবন বিচলিত হয়ে বলে ওঠে, ম্যাডাম এতো সব গল্প কথা..
ইউনিটের লোকেদের এদিকে আসতে দেখে অরুনিমা এগিয়ে যায়।
পবন সাহস করে জিজ্ঞেস করে, “ম্যাডাম আজকে আপনারা কোথায় থাকবেন ? কালকেও তো শুটিং আছে শুনছিলাম.. “
অরুনিমা ঘুরে দাঁড়িয়ে কি যেন ভাবে। তারপর রিপ্লাই করে
— “তিনচুলে গ্রামের হোমস্টে’তে”।
ততক্ষণে ইউনিটের লোকেরা এসে গেছে।
পবনের মন আনন্দে নেচে ওঠে। তাদের গ্রামেই ম্যাডাম থাকবেন!

তখন সন্ধ্যা সাতটা হবে। গোটা তিনচুলে গ্রাম মনে হচ্ছে ভর সন্ধ্যেবেলাতেই ঘুমিয়ে পড়েছে যেন। চারিদিকে নিস্তব্ধতা, মাঝে মাঝে নানা রকম জীবজন্তুর ডাক শোনা যাচ্ছে। পবন আজকে সারাদিনের কথা ভাবতে ভাবতে কাঠের ধূনী জ্বালিয়ে হাত সেঁকছিল। বারবার মনে হচ্ছিল অরুনিমা ম্যাডামের কিছু যেন একটা হয়েছে। হঠাৎ লক্ষ্য করলো হোম’স্টে থেকে অলিভ রংয়ের টয়োটা গাড়ীটা গেট দিয়ে যেন বেরোচ্ছে।
“আরে এটাতো অরুনিমা ম্যাডামের গাড়ি.. এই গাড়িতেই অরুনিমা ম্যাডাম আজকে এসেছিল..
এই ভর সন্ধ্যেবেলা ম্যাডাম চললেন কোথায় !
নিজের মনেই বললো পবন।
না ব্যাপারটা তো দেখতেই হচ্ছে।
দৌড়ে গিয়ে নিজের লালিমাকে গ্যারেজ থেকে বের করে টয়োটা গাড়িটার পিছু নিল পবন।
উঁচু-নিচু পাহাড়ি রাস্তা.. ম্যাডাম কী নিজে ড্রাইভ করছে নাকি.. চিন্তিত পবন ফলো করতে লাগলো গাড়িটাকে। পবন দেখল গাড়িটা লাভারস্ পয়েন্টের রাস্তাতেই যাচ্ছে। তারমানে ম্যাডাম এখন একা একাই লাভারস্ পয়েন্ট যাচ্ছে ! বেশ কিছুটা সময় পর গাড়িটা লাভারস্ পয়েন্ট পৌঁছালো । তখন আকাশে জ্যোৎস্নার আলো দূরের পাহাড়গুলোতে চুঁয়ে চুঁয়ে পড়ছে। রহস্যে মোড়া পাহাড়গুলো যেন জ্যোৎস্নার আলোয় স্নান করছে। ঠিক যেন কোনো মায়াবী রূপকথার রাজ্য। পবন দেখলো সাদা গাউন পড়া অরুনিমা ম্যাডাম গাড়ি থেকে নেমে লাভারস্ পয়েন্টের দিকে ধীর পায়ে এগিয়ে যাচ্ছে।রূপকথার রাজকন্যার মত লাগছে। ম্যাডামজি কে কোনোদিকে যেন কোন খেয়ালই নেই অরুনিমার।যেন নিশির ডাকের আহবানে এগিয়ে চলেছে লাভারস্ পয়েন্টের দিকে !
কি ব্যাপার.. ম্যাডাম হঠাৎ রেলিঙের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে কেন !. পবনের সিক্সথ সেন্স যেন কিছু অশুভ ইঙ্গিত দিচ্ছে। চাঁদের আলো ম্যাডামের মুখে পড়েছে। যেন শান্ত এক বিষাদ প্রতিমা।

অরুনিমা এগিয়ে চলেছে গভীর খাদের দিকে। আজ পবনের কাছ থেকে ফ্রিঞ্চ পাখির গল্পটা শোনার পর থেকেই অরুনিমার মনে হচ্ছে তারও জীবনে বেঁচে থাকার কোনো অর্থ নেই। তার ভালোবাসাও তো হারিয়ে গেছে জীবন থেকে। পায়ে পায়ে এগিয়ে চলেছে অরুনিমা। একদম রেলিংয়ের ধারে এসে গেছে। না এই জীবন আর কিছুতেই রাখবে না অরুনিমা। রেলিং ধরে নিচের দিকে তাকাল অরুনিমা। মনে হল যেন সুন্দর ফ্রিঞ্চ পাখি ডানা ঝাপটে ওকে ডাকছে অতল গহ্বরের দিকে। ওই মায়াবী রাজ্যেই হারিয়ে যাবে আজকে অরুনিমা। রেলিং ধরে উঠে নিচের দিকে লাফাতে যাবে এমন সময় কে যেন ওকে জাপটে ধরে অপর দিকে টেনে নিল ! অরুনিমা দেখল সকালের সেই ছেলেটা ! অরুনিমা আজ বহুদিন পরে এরকম বলিষ্ঠ বাহুর বন্ধন আর চওড়া বুকে যেন মুহূর্তের জন্য আশ্রয় খুঁজে পেল।বিদেশি পারফিউমের থেকেও যেন অচেনা শরীরের জন্য গন্ধ কয়েক সেকেন্ডের জন্য অরুনিমার মন কে আবেশে ভরিয়ে দিল। মুহূর্তে সম্বিৎ ফিরতেই পবনের বাহুবন্ধনে থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে অরুনিমা চেঁচিয়ে উঠলো, “হাউ ডেয়ার ইউ টু টাচ মি.. তুমি এখানে কি করছ.. আমাকে ফলো করেছো কেন..” !
পবন বলে উঠল , ম্যাডাম আপনি সুইসাইড করতে যাচ্ছিলেন কেন..
অরুনিমা ঝাঁঝের সাথে উত্তর দিল, আমি যাই করি না কেন তাতে তুমি ইন্টারফেয়ার করার কে.. আমাকে কি শান্তিতে মরতেও দেবে না..
মানসিকভাবে বিধ্বস্ত অরুনিমা আর পারল না। ওখানেই মাটিতে হাটু গেড়ে বসে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করল।
পবন বুঝতে পারছে অরুনিমার মানসিক অবস্থা.. কাঁদতে দিল অরুনিমাকে বেশ কিছুক্ষণ..
মাথা নিচু করে চুপ করে অরুনিমার পাশে দাঁড়িয়ে রইলো পবন।
তারপর অরুনিমার পাশে বসে বলল,
“ম্যাডাম আমি জানিনা আপনার কি হয়েছে তবে আমার মনে হচ্ছে আপনি ভালবাসায় দাগা খেয়েছেন..
জীবনটা কত সুন্দর ম্যাডাম..
এত সুন্দর জীবন আপনি এমন একজন মানুষের জন্য শেষ করতে যাচ্ছিলেন যে আপনার ভালোবাসাকে মর্যাদা দেয়নি..
শুটিং ইউনিটের লোকেরা নিজেদের মধ্যে আপনার সম্পর্কে বলাবলি করছিল ম্যাডাম। ওদের কথা থেকেই আন্দাজ করেছি আপনার মন খারাপের কারণ।”

অরুনিমা কাঁদতে কাঁদতে বলল, “রাহুলকে যে আমি বড্ড ভালবাসতাম, ওই গোল্ডেন ফিঞ্চ পাখির মতই.. ওকে ছাড়া একা একা আমি কি করে জীবন কাটাব..
পবন অরুনিমার দিকে হাত বাড়িয়ে বলল, ম্যাডাম উঠে আসুন আপনাকে আমি আরও একটা জিনিস দেখাচ্ছি।অরুনিমা যেন এই মুহূর্তে কোন সেলিব্রেটি নয় কোন গ্ল্যামার ওয়ার্ল্ডের রূপসী নায়িকা নয়.. খুব সাধারন মিষ্টি একটা মেয়ে। বাধ্য মেয়ের মত হাতটা বাড়িয়ে দিল পবনের দিকে।
পবন অরুনিমার হিমশীতল কোমল
হাত ধরে টেনে তুলে রেলিঙের দিকে নিয়ে গেল।
তারপর বলল, নিচে তাকিয়ে দেখুন ম্যাডাম.. জ্যোৎস্নার আভায় অপরূপা হয়ে উঠেছে তিস্তা আর রঙ্গীত নদী.. তিস্তা নদী হলেও যথেষ্ট খরস্রোতা প্রবাহিনী.. তাই ধরে নিলাম তিস্তা সুঠাম প্রেমিক পুরুষ. আর রঙ্গীত দেখুন ক্ষীণকায় নদী.. ঠিক যেন লাজুক তন্বী তরুণী… পান্না সবুজ রঙের তিস্তার জলস্রোত নিজের খেয়ালে চলেছে… পাশ থেকে রঙ্গীত নদী রোজ এসে একটা পয়েন্টে তিস্তার সাথে মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। তিস্তার সঙ্গমস্থল এটা… রোজ ওদের মিলন হয় মিট পয়েন্টে গিয়ে..এখানে প্রেম পরিণতি পাচ্ছে… তাইতো এটাকে লাভারস্ পয়েন্ট বলে… সকালে যেটা বলেছিলাম সেটা তো গল্প কথা… লাভারস পয়েন্টে তো প্রেম শুরু হয়.. আপনি আবার নতুন করে জীবনটা শুরু করুন ম্যাডাম.. কত প্রতিভাময়ী অভিনেত্রী আপনি… নিজের জীবনে সত্তিকারের ভালোবাসার মানুষকে ঠিক একদিন খুঁজে পাবেন.. জীবন ঈশ্বরের দান.. এইভাবে তাকে হত্যা করার অধিকার আপনারও নেই ম্যাডাম। আপনার এখন সকলকে অনেক কিছু দেওয়ার আছে..
চোখের জল মুছে ফেলুন। সবথেকে বেশি নিজেকে ভালবাসুন ম্যাডাম। কাল থেকে নতুন করে জীবন শুরু করুন।

অরুনিমা একদৃষ্টিতে পবনের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। এত সুন্দর সুন্দর কথা ও জানলো কি করে !
কত সহজ সরল কত সুন্দর মন এই ছেলেটার। সত্যিই তো কেন সে ঝোঁকের মাথায় নিজের জীবনকে নষ্ট করতে যাচ্ছিল। খুব সাধারণের মধ্যেও কত অসাধারণ পবন।
এমনটি যদি কেউ কোনোদিন আসে তার জীবনে যে তাকে সত্যিকারের ভালোবাসবে.. যে তাকে বুঝবে পবনের মতো করে..
রাহুল কেন পবনের মত করে তাকে বুঝলো না.. একটা বড় দীর্ঘশ্বাস ফেলল অরুনিমা..

চোখের জল মুছলো অরুনিমা..
পবনের দিকে তাকিয়ে হাসল..
কি অপরূপা লাগছে অরুনিমাকে.. মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে পবন…
এগিয়ে এল অরুনিমা পবনের দিকে…
ধীরে ধীরে বলল, তোমার গলার মাফলারটা আমায় দেবে পবন ?
চমক ভাঙলো পবনের.. ভাবল স্বপ্ন দেখছে নাতো !
কৃতার্থতার সলজ্জ হাসিতে দীপ্ত হয়ে উঠল পবনের মুখ।
নিজের হাতে চিমটি কেটে দেখল..
তারপর বলল, আমার ভাগ্য ম্যাডামজি আপনি আমার মাফলারটা চেয়েছেন এই নিন..
অরুনিমা হাত পেতে নিল। তারপর পবনের খুব কাছে এসে চোখে চোখ রেখে বলল,
“তুমি খুব ভালো পবন ..
খুব ভালো থেকো.. তোমার চোখের ভাষা অনেক কথাই বলে দিয়েছে পবন…..
ভুবনমোহিনী হাসি হাসলো অরুনিমা।
সব দুঃখ ছাপিয়ে একটা সুখাবেশ স্নায়ুজালে জড়িয়ে রয়েছে এখন এই হাসিতে।

পবন অপ্রস্তুত হয়ে জিজ্ঞেস করল, কি কথা ম্যাডামজি..
অরুনিমা মৃদু হেসে বলল, সব কথা মুখে বলতে নেই পবন..
কিছু কথা নিঃশব্দই থাক না ….”
পবন অস্ফুট স্বরে বলল,
“ম্যাডাম জি…. “
ওকে থামিয়ে দিয়ে অরুনিমা মৃদু স্বরে বলল. “রঙ্গীত আর তিস্তা নদীর মত ভাগ্য সবার হয় না পবন ..”

অরুনিমা হাঁটা দিল নিজের গাড়ির দিকে..
পবন মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাকিয়ে রইল সেই দিকে। ধীরে ধীরে কুয়াশার চাদরে মোড়া রাস্তায় মিলিয়ে গেল অরুনিমা।

পবন নিজের গাড়ির দিকে ধীর পায়ে এগিয়ে গেল। গায়ের জ্যাকেটটা খুলে গাড়ির সিটের উপর রাখতে গিয়ে দেখলো জ্যাকেটের গায়ে একটা কানের ঝুমকো। ঝুমকো টা হাতে নিয়ে পবন নিজের মনেই বললো, আরে এটা তো ম্যাডামের কানের ঝুমকো, যখন ম্যাডামকে বাঁচাবার জন্য বুকে টেনে নিয়েছিলাম তখন বোধহয় ঝুমকোটা জ্যাকেটে আটকে গেছে।

ঝুমকোটা হাতে নিয়ে পরম যত্নে হাত বুলালো পবন। ম্যাডামের স্পর্শ যেন এখনো লেগে আছে ঝুমকোটায়। ম্যাডামের চিহ্ন এই ঝুমকোটা সে চিরকাল রেখে দেবে নিজের সাথে। হাতের মুঠোয় ঝুমকো টাকে রেখে মনে মনে বলল ,এই লাভারস্ পয়েন্টে আবার একবার আপনাকে আসতেই হবে ম্যাডাম..

ম্যাডামের গাড়ি চলে যাচ্ছে তার গ্রামের দিকে। আস্তে আস্তে গাড়ির আওয়াজ মিলিয়ে যাচ্ছে।

ঠান্ডা আয়নার মত পবনের চোখ দুটোতে শুধু ম্যাডামের প্রতিচ্ছবি চিকচিক করছে।
বিরহে নয় বৈরাগ্যেও নয় , নিতান্ত এক পার্থিব ভালোলাগার আবেশে পবনের মন আবিষ্ট হয়ে রইলো।
তিস্তা ও রঙ্গীত নদী.. আর দূরের পাহাড়গুলো সাক্ষী থাকল এক স্মরণীয় মুহূর্তের।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here