লেখক-আবির হাসান সায়েম ’র নির্বাক অন্তরের গল্প“লোহিত জোছনা”

232
লেখক- আবির হাসান সায়েম ’র নির্বাক অন্তরের গল্প“লোহিত জোছনা”

লোহিত জোছনা
আবির হাসান সায়েম

তোমার দেহে লতিয়ে ওঠা ঘন সবুজ শাড়ি।
কপালে ওই টকটকে লাল টিপ।
আমি কি আর তোমাকে ছেড়ে
কোথাও যেতে পারি?
তুমি আমার পতাকা, আমার কৃষির বদ্বীপ।
~ সৈয়দ শামসুল হক

শীতকালে গরম কাপড় জড়িয়ে ফাঁকা রাস্তায় একা হাঁটতে আলাদা রকমের একটা মজা আছে। অনেকটুকু পথ হাঁটলেও ক্লান্ত লাগে না একদমই। তবে গরমকালে ব্যাপারটা পুরো উল্টো। একটু হাঁটলেই ঘামে গা ভিজে যায়। এসব ভাবতে ভাবতে রাস্তা পার হয় সুমন। অনেকক্ষণ ধরে মাথার উপর প্রখর সূর্য নিয়ে হাঁটছে সে। সূর্যের তেঁজ আজ একটু বেশিই বেশি। এর গরমের মধ্যে কেও বিয়ে করে, ভেবে বিরক্ত লাগে সুমনের। এই মুহুর্তে গরম বড় কথা নয়, বড় কথা হলো কি উপহার কেনা যায়। সুমন বাস স্ট্যান্ডের শেডের নীচে দাঁড়ায়। ভাবে, কিছুই আসে না মাথায়। অদ্ভুত সব জিনিস উপহার দিতে ইচ্ছে করে। ফিডার দিলে কেমন হয়? আজ নয়তো কাল বাচ্চা হবে সেসময় কাজে দিবে। না বিয়েতে এসব দেয়া যায় না। আচ্ছা, বিয়েতে কেও গল্প বা কবিতার বই উপহার হিসেবে দেয় না কেনো? দিলে মন্দ হতো না তখন উপহার নিয়ে এতো চিন্তা করার লাগতো না। পকেটে তেমন টাকাও নেই। পকেট থেকে উল্টাপাল্টা ভাঁজ করা টাকাগুলো বের করে সুমন। গুণে দেখে তিনশ আছে। এর মধ্যে একটা বিশ টাকার নোট মাঝের দিক দিয়ে ছিঁড়ে গেছে। বেশিই ছেঁড়া, চালানো যাবে কি না কে জানে। এসব ভাবতে ভাবতে একটা গিফট শপে ঢুকে পরে সুমন। বিশাল গিফট শপ। শো-পিস দেখা যেতে পারে। নাহ, সাধ্যের মধ্যেরগুলো একদম গো-বেচারা টাইপ লাগে। সুমন পুরো দোকান ঘুড়ে দেখতে লাগলো। দোকানের শেষের দিকে একটা দেয়াল ঘড়ি চোখে পরলো তার। জাহাজের মতো দেখতে ঘড়িটা পছন্দ হলো তার। দাম দেখার জন্য ঘড়ির সামনে গেলো সুমন। দাম দেয়া নেই। যেখানে দাম দেয়া থাকে সেখানের কাগজ উঠে উঠে গেছে। বুঝা যাচ্ছে না কত লেখা আছে। দোকানদারকে ডাক দিয়ে বলে সুমন,
“ ঘড়িটার দাম কত ভাই?”
” সাড়ে তিনশো টাকা।”
” তিনশো রাখা যায় ভাই?”
” কম নাই। “
মন খানিকটা খারাপ হয় সুমনের। মাত্র পঞ্চাশ টাকার জন্য কেনা গেলো না ঘড়িটা। মেখে এক হ্রাস বিষন্নতা নিয়ে দোকান থেকে বের হয় সুমন। দোকানের সামনের ফুতপাত দিয়ে হাঁটতে লাগলো। আশেপাশে আর কোনো দোকান দেখা যাচ্ছে না। বিয়েতে যাওয়া দরকার তবে উপহার ছাড়া গেলে ভালো দেখাবে কি? এসব ভাবতে ভাবতে হাঁটে সুমন। হঠাৎ, পিছন থেকে একজন চিৎতকার করতে করতে দৌঁড়ে দেয়,
“এই যে ভাই শুনেন. দাঁড়ান ভাই। “
সুমন পিছনে তাকায়। থ্রি কোয়াটার প্যান্ট, লাল গেঞ্জি পরা কম বয়সী একটা ছেলে। সুমন দাঁড়ায়, জিজ্ঞেস করে,
“আমাকে ডাকছো।”
ছেলেটা ” হ্যাঁ ” সূচক মাথা নাড়ে। কথা বলতে পারে না। দৌঁড়ে হাঁপিয়ে গেছে। বড় বড় শ্বাস নেয়। তারপর বলে,
“খালু আপনারে ডাকে।”
সুমন অবাক হয়। ফিরে প্রশ্ন করে,
” কোন খালু? আমাকে ডাকছে কেনো?”
” ওইযে একটু আগে দোকানে ঢুকসিলেন না? হেইডার মালিক। “
” ওহ আচ্ছা। আমাকে ডেকেছেন কেনো?”
” জানি না। আপানারে নিয়া যাইতে বলসে। “
” আচ্ছা চলো” বলে দোকানের দিকে হাঁটা শুরু করলো সুমন। হাঁটতে হাঁটতে ছেলেটিকে প্রশ্ন করলো,
” তোমার নাম কি?”
” রাতুল।”
” তুমি কি ওই দোকানে কাজ করো? “
” হ। “
” স্কুলে যাও না?”
” নাহ, দোকানে মানুষ নাই আমি আর খালু ছাড়া। খালু একলা পারে না, সারাদিন আমারই দেখতে হয়। তয় খালু কইসে আগামী বছর লোক রাখবো। আমারে স্কুলে ভর্তি করায় দিবো। “
” বাহ। “
আর কোনো কথা বললো না দু’জনে। সুমন দোকানে ঢুকলো। ঢুকতেই দেখা গেলো, দোকানের লোকটা ঘড়ি বক্সে ঢুকাতে ব্যস্ত। সুমন লোকটার সামনে গিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
” আমাকে ডেকেছেন ভাই?”
লোকটা সুমনের দিকে না তাকিয়ে বললো,
” হ্যাঁ, আঁড়াইশো টাকা দেন।”
সুমন অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
” আঁড়াইশো টাকা দিবো কেনো?”
” ঘড়িটা না পছন্দ হইসেন,নিবেন না?”
” আপনি না বললেন সাড়ে তিনশ টাকা আমি বললাম তিনশো। তাও দিলেন না। এখন আঁড়াইশো চাচ্ছেন। ঠিক বুঝতে পারছি না। “
লোকটা মুখ তুলে সুমনের দিকে তাকালো। কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকার পর বললো,
” অনেক কাস্টমার আসে দোকানে। অনেকে কিনে অনেকে কিনে না। অনেকের পছন্দ হয় না, অনেকে টাকার জন্য কিনে না। এসব দেইখা অভ্যস্ত। কিন্তু আপনারে বিদায় করে দেয়ার পর হঠাৎ খারাপ লাগলো। মনে হইলো যে দামে কিনসি সেই দামেই দিয়ে দেই। তাই আপনারে ডাকায় আনলাম। “
সুমন চুপ করে রইলো। লোকটা আবার বললো,
” টাকা দেন তাড়াতাড়ি। প্যাকেট করা শেষ।”
সুমন পকেট থেকে বের করে টাকা দিলো। সুমনের ইচ্ছে করলো, লোকটাকে জড়িয়ে ধরতে। সংশয়, লজ্জা এসে বাঁধা দিলো । শুধু একটা ” ধন্যবাদ” দিয়ে প্যাকেটটা নিয়ে বেরিয়ে পরলো সুমন। পকেটে পঞ্চাশ টাকা আছে। চাইলে রিক্সা দিয়ে যাওয়া যায়। যে চিন্তা সে কাজ, একটা রিক্সা ডাক দিয়ে উঠে পরলো সুমন। কিছুক্ষণ যাওয়ার পর রিক্সাওয়ালা বললো,
” ভাই ডাকনা উঠায় নেন। যে গরম পরসে ভাই। “
সুমন কিছু বললো না। হুড উঠিয়ে নিলো। গরমটা আজ আসলেই বেশি। কিছুক্ষণ পর রিক্সাওয়ালা আবার বললো,
” আজাব, বুঝলেন ভাই আল্লাহর আজাব। মানুষ এতো খারাপ হইয়্যা গেসে, আল্লাহ আর কতদিন সহ্য করবো। দূর্নীতি দিয়া দেশটা ভইরা গেসে। “
সুমন কিছু বললো না। বেশিরভাগ সময় রিক্সাওয়ালারা কিছু শুনতে চায় না, তাদের বলার কাজ বলে যায়।

” আজকে মনে হয় বৃষ্টি পরবো ভাই। যে গরম পরসে।”
সুমন বললো,
” হতে পারে। “
রিক্সা গিয়ে থামলো, “এপোজি” কমিউনিটি সেন্টারের সামনে। গেটের সামনে অনেকে ঘুড়াঘুড়ি করছে। কেও পাঞ্জাবী, কেও কোর্ট পরে। সুমনও ভেবেছিলো পাঞ্জাবী পরে আসবে কিন্তু যে লন্ড্রিতে আয়রন করতে দিয়েছিলো সে লন্ড্রি গত দুইদিন ধরে বন্ধ, ফোনও বন্ধ।
রিক্সা থেকে নামলো সুমন। গেটে ঢুকতেই কয়েকজন অল্প বয়সী ছেলে মেয়ে গোলাপ জল ও গোলাপের পাপড়ি ছিটিয়ে দিলো। ব্যাপারটা ভালো , মন চাঙ্গা করে দেয়ার ভালো কৌশল। গেটের শেষ প্রান্তে হলে ঢুকার মুখে দাড়িয়ে হাসিমুখে কোলাকুলি, হ্যান্ডসেক করে সবাইকে অভ্যর্থনা জানাচ্ছেন রোমেল এজাজ সাহেব। সুমনকে দেখে খুশিতে জ্বলজ্বল করতে থাকা চোখ হঠাৎ নিষ্প্রাণ হয়ে গেলো। আঁধার নেমে এলো মুখে। হাসির ভান করেও ঠিক হাসতে পারছেন না। সুমন রোমেল এজাজ সাহেবকে সালাম দিলো,
” আসসালামুআলাইকুম আংকেল।
রোমেল এজাজ সাহেব আমতা আমতা করে উত্তর দিলেন,
” ওয়ালাইকুমআসসালাম। তুমি আমার সাথে একটু এদিকে আসো তো। “
এই কথা বলেই এজাজ সাহেব সুমনের হাত ধরে কোণার দিকে চলে গেলেন। সেদিকে মানুষ নেই।
” দেখো বাবা, আমার একটাই মেয়ে। আজ ওর বিয়ে। তোমাদের সম্পর্ক ছিলো তা ঠিক আছে কিন্তু আজ ওর বিয়ে। সংগত কারণেই তোমাদের বিয়েটা আমি দিতে পারি নি। তুমি জানো বাবা। যার সাথে ওর বিয়ে হচ্ছে, সে ছেলে ভালো। ওরা সুখেই থাকবে। বিয়েতে ব্যাঘাত ঘটে এমন কিছু করো না বাবা। তোমার কাছে অনুরোধ। প্লিজ আমার এই অনুরোধটা রাখো। “
হড়বড় করে কথাগুলো বললেন রোমেল এজাজ সাহেব। কপালে অসংখ্যা বিন্দু ঘাম। সুমন ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি নিয়ে বলল,
” দেখুন আপনি উত্তেজিত হবেন না। আমি ওমন কিছু করতে আসি নি করবোও না। আমি নীলা ‘র সাথে একটু দেখা করবো, একটা কথা বলবো তারপর চলে যাবো। দুই মিনিট সময় লাগবে। “
” কি কথা বলবে?”
” সেটা আপনাকে এখন বলা যাবে না। কথাটা সবার প্রথমে নীলাকে জানাবো। টেনশান নিবেন না কোনোরকমের ঝামেলা হবে না। আমি কথা দিচ্ছি। আমি কথা দিলে কথা রাখি, তা আপনি ভালো করেই জানেন। নিন গিফটটা ধরুন, আমি নীলার সাথে দেখা করেই চলে যাবো। দুটো মিনিট মাত্র।”
ঘড়ির বাক্সটি এজাজ সাহেবের হাতে দিয়ে সুমন চলে গেলো হলের ভিতর। সেখানে স্টেজে দুটো চেয়ারে বসে আছে নীলা ও তার হবু বর। ছেলেটার নাম কি যেনো। সুমন অনেক চেষ্টা করেও মনে করতে পারে না। সুমনে স্টেজে উঠে। সুমনকে দেখে বসা থেকে উঠে পরে নীলা, চেয়ারের সাথে শাড়ি আটকে মাথা থেকে কাপড় পরে যায়। দুইজন তরুণী ব্যস্ত হয়ে পরে মাথার কাপড় ঠিক করতে। নীলা কাঁপা গলায় বলে,
” তুমি এখানে?”
” হ্যাঁ, তোমার সাথে কিছু কথা ছিলো।”
” বলো শুনছি। “
সুমন কিছু বলবার আগেই হাসিমাখা কন্ঠে নীলার পাশে বসে থাকা লোকটি বলে উঠল,
” ইনি কে নীলা? পরিচয় করিয়ে দিবে না? “
নীলা বলল,
” ওর নাম সুমন। “
লোকটা খানিক্ষণ চুপ করে থেকে বলল,
” আপনিই কি সেই…?”
সুমন বলল,
” আমিই সেই। “
লোকটি শঙ্কিত ভঙ্গিতে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
” আমি হাবিব।”
সুমন হাত মিলালো। নীলার মাথার কাপড় ঠিক করে দিয়ে দুইজন নেমে গেলো স্টেজ থেকে। সুমন নীলার দিকে ফিরে বলল,
” আমি চাকরি পেয়েছি বুঝলে নীলা। যে পত্রিকায় ফিচার লিখতাম সেখানে এডিটরের চাকরি।আগামী মাসে জয়েন করবো। বেতন মোটামুটি আমার ভালোই চলে যাবে। মেস ছেঁড়ে দিবো আগামী মাসে, এক রুমের বাসা নিবো। “
নীলা বলল,
” এই কথা বলতে এসেছো?”
” হ্যাঁ।আসলে, গত পাঁচ বছরে বড় কোনো ঘটনা ঘটলেই তোমাকে প্রথমে জানিয়েছি। এতো তাড়াতাড়ি কি অভ্যেস ছাঁড়ে বলো? আর এই হয়তোবা শেষবার তোমাকে বলতে পারছি। “
নীলার চোখ ছলছল করছে। কিছু বলছে না সে। সুমন বলল,
” এটাই বলতে এসেছিলাম নীলা। যাই এখন। “
সুমন চলে যেতে নেয়, নীলা সুমনের হাত ধরে। ছলছল চোখ, কাঁপাকাঁপা গলায় বলে,
” কিন্তু….।”
কথা শেষ করতে দেয় না সুমন।নিজে বলে উঠে,
” কিন্তু কিছু না। তুমি যে ট্রেনের আশায় আছো সেটি গন্তব্য ছেঁড়ে বহুদূর চলে গিয়েছে। সব কিছু জীবনে মন মতো হয় না, কিছু জিনিস মেনে নিতে হয়। এটাই জীবন। আর যা হয় ভালোর জন্যই হয়। যাই নীলা। “
নীলার হাত ছাঁড়িয়ে নেয় সুমন। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকা বরের কাঁধে হাত রেখে বলে,
” অনেক শুভ কামনা তোমাদের জন্য। আসি। “
স্টেজ থেকে নেমে পরে সুমন। হাঁটতে থাকে গেটের দিকে। ইচ্ছে করে পিছু ফিরে দেখতে আরেকটাবার। কিন্তু না। মনকে এতো পশ্রয় দেয়া যাবে না। একটু সুযোগ পেলেই মন দুঃসাহসিক কাজ করে বসে।
কমিউনিটি সেন্টারের বাইরে বের হয় সুমন। রোদ ঢাকা পরেছে। ধূসর মেঘ ছেয়ে দিয়েছে আকাশ। ঠান্ডা বাতাস বইছে সাথে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি। ফুটপাথ দিয়ে হাঁটতে থাকে সুমন। মাথায় বৃষ্টির ঠান্ডা পানি। হাঁটতে মন্দ লাগছে না। এই বিষাদগ্রস্থ শহরের কিছু ঘটনা অসম্ভবরকমের সুন্দর। যেমন শীতের সকাল, শ্রাবণের বৃষ্টি। সুমনের হাসি পায়। সে হাসে। গাল গঁড়িয়ে গরম পানি পরছে, টের পায় সে। হাত দিয়ে দেখে। সে কাঁদছে। কি আশ্চর্য সে কাঁদছে। সুমনের হাসির মাত্রা আরও বাড়ে। হাসির সাথে আকাশে উড়ে যায় বিষাদ, হাহাকার কষ্ট। মেঘেরাও কাঁদে সুমনের সাথে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here