কবি,লেখক ও প্রবন্ধকার—নাসরিন আক্তার এর এক অনন্য সুন্দর সৃষ্টি প্রবন্ধ “মুক্তিযুদ্ধ-উত্তর বাংলা কথাসাহিত্যের অন্যতম পথিকৃৎ সেলিনা হোসেন”

697
“মুক্তিযুদ্ধ-উত্তর বাংলা কথাসাহিত্যের অন্যতম পথিকৃৎ সেলিনা হোসেন ”
কবি,লেখক ও প্রবন্ধকার —নাসরিন আক্তার

” মুক্তিযুদ্ধ-উত্তর বাংলা কথাসাহিত্যের অন্যতম পথিকৃৎ সেলিনা হোসেন”

                                                                                        ————-নাসরিন আক্তার।

সাহিত্য যেখান থেকেই জন্মলাভ করুক না কেন, তার অবয়বে থাকে তার জন্মস্থান, যুগ এবং পারিপার্শ্বিকতার ছোঁয়া।বাংলার প্রাকৃতিক শোভা যেন তার কোমল সূর্যের আভার মতো ঘিরে রেখেছে এই দেশের সাহিত্যকে।ঠিক তেমন ভাবে বাংলার সাহিত্যে মুক্তিযুদ্ধ ও সবুজ মাঠে সোনালি ফসলের মতোই উজ্জ্বল হয়ে আছে।বাংলাদেশ তথা বাংলাসাহিত্যের শক্তিশালী কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেনের কলমও ছুঁয়ে রয়েছে এই সব কিছুকেই।

সাহিত্য বহতা নদীর মতো অস্থিতিশীল। নদীর মতো সাহিত্যেরও রয়েছে অসংখ্য শাখা-প্রশাখা।সাহিত্যের অবয়ব জুড়ে আছে প্রকৃতি, রাজনীতি, সমাজ, ধর্ম এবং বাংলা সাহিত্যের একটা অংশ জুড়ে আছে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ। যদিও মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক সাহিত্যের যাত্রা সত্তরের দশক থেকে, তবু আমাদের সাহিত্যে এর গতি স্বতন্ত্র।কথাসাহিত্যে সেলিনা হোসেন আমাদের আলোচ্য বিষয়। মুক্তিযুদ্ধের প্রসঙ্গ, ভাষা-আন্দোলনের প্রসঙ্গ উত্থাপিত হলেই সেলিনা হোসেন সেখানে আবশ্যিক অনুষঙ্গের মাধ্যমে শত রঙে রঙিন হয়ে সাহিত্যের ক্যানভাসে স্বমহিমায় উদ্ভাসিত হন।তাঁর নিজের আত্মোপলব্ধিমূলক লেখা থেকেই বোঝা যায় তিনি একাত্তরকে-মুক্তিযুদ্ধকে এক অন্য উচ্চতায় নিয়ে নিজের জীবনের একটি অধ্যায় করে নিয়েছেন। তাঁর সর্বাধিক মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাস রয়েছে।

সেলিনা হোসেন আপাদমস্তক একজন কথাসাহিত্যিক। উপন্যাসে তিনি ব্যবহার করেছেন ঐতিহাসিক উপাদান। এসব ঐতিহাসিক উপাদান নিয়ে তিনি সমকালীন বাস্তবতার নিরিখে সাহিত্য নির্মাণ করেছেন। তাঁর উপন্যাসে রাজনৈতিক সময়, আন্দোলন, নারীর শাশ্বত দৃষ্টি, সনাতন আদর্শ বজায় থাকে মেধার উজ্জ্বলতায়। কোনো অবস্থাতেই তিনি নিজস্ব ঐতিহ্যকে, নিজস্ব উত্তরাধিকারকে, মুক্তিকামী বাঙালির সংগ্রামকে ছোট করে দেখেননি। তাঁর রচনায় মুক্তিকামী মানুষ উত্তরাধিকার খুঁজে পেয়েছে নির্ভাবনায়, উচ্চতায়।
তাঁর উপন্যাসে জীবন ও সমাজ বাস্তবতার চমৎকার যোগসূত্র খোঁজে পাওয়া যায় । ‘জীবন যেখানে যেমন’ সেলিনা হোসেন এই আদর্শে বিশ্বাসী। তাঁর লেখনীতে শিল্পমানের চেয়ে জীবনের রূঢ় বাস্তবতা চমৎকারভাবে প্রাণ সঞ্চার করে। ইতিহাস এবং বাস্তব জীবনের পরতে পরতে যে মায়াবী জীবন, সংগ্রাম, উষ্ণতা, প্রেম, বিরহ, , ক্লেদ, ধ্বংস, ক্ষয়, মৃত্যু, সৃষ্টি, স্বপ্ন – এগুলোকে তাঁর উপন্যাসে উপজীব্য করেছেন চরম পারঙ্গমতায়, যা সত্যি অনন্য। এই মৌলিকত্বই বাংলা সাহিত্যে তাঁকে অনন্য করেছে, অন্য এক উচ্চতার আসনে অধিষ্ঠিত করেছে।

ভাষা-আন্দোলনকে কেন্দ্র করে তাঁর দুটি উপন্যাস – যাপিত জীবন (১৯৮১) এবং নিরন্তর ঘণ্টাধ্বনি(১৯৮৭)।
যাপিত জীবন এ-উপন্যাস উনিশশো সাতচল্লিশ থেকে বায়ান্নর একুশ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সময়কে ধারণ করেছে। সেলিনা হোসেন সময়ের ইতিহাসকে চরিত্রের মধ্যে প্রবিষ্ট করান নির্ভাবনায়, সাবলীল ভাবে। সেখানে ‘সময়’ই চরিত্র। সোহরাব হোসেন, মারুফ ও তার স্ত্রী সুমনা, জাফর, আঞ্জুম প্রতিটি চরিত্র পারিবারিক জীবনের দৈনন্দিনতার ভেতরে নিজস্ব মূল্যবোধ ও রুচির চর্চা করতে গিয়ে ইতিহাসকে নিজেদের জীবনে জড়িয়ে ফেলেছেন ওতপ্রোতভাবে। সেখানে রাষ্ট্রের সংগ্রামের সঙ্গে নিজেদের ব্যক্তিগত জীবনের সম্পৃক্ততা রয়েছে। চরিত্রগুলো সমস্ত ঘটনার সাক্ষী হয়ে চলন্ত জীবনপঞ্জিতে নড়াচড়া করে, সমস্ত ঘটনার কেন্দ্রিক চরিত্র হয়ে যায়। উপন্যাসের সূচনায় যে ভয় ভীতির চিত্র উদ্ভাসিত হয় তা থেকে বেরিয়ে আসবার মধ্য দিয়ে উপন্যাসের পরিসমাপ্তি।

নিরন্তর ঘণ্টাধ্বনি – উপন্যাসটিতে ঢাকার আন্দোলনের পটভূমিতে ভাষা-আন্দোলনে প্রগতিশীল মধ্যবিত্তের যে-ভূমিকা তা দেখানো হয়েছে। এ-উপন্যাস দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কিছু আগে থেকে শুরু করে ১৯৫৩ সালে জেলখানায় বসে মুনীর চৌধুরীর কবর নাটক লেখা পর্যন্ত বিস্তৃত। নিরন্তর ঘণ্টাধ্বনির কেন্দ্রীয় চরিত্র মুনিম বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছাত্রনেতা। আসাদ, সালাম, রাহাত, বেণু, নীলা, রেণু এঁরা উপন্যাসের মূল কাহিনির সঙ্গে কেন্দ্রীয় ভূমিকায় সহায়ক চরিত্র হিসেবে কাজ করেছে। মাত্র তিনদিনের ঘটনাপ্রবাহে আমরা দেখতে পাই একুশের চেতনা কীভাবে তিমিরবিনাশী আয়োজনে প্রগতিশীল ছাত্রদের আগামীর পথে এগিয়ে নিয়ে যায়। তিনদিনের কাহিনিতে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শোষক গোষ্ঠীর নিপীড়ন, দমননীতি, পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শোষকগোষ্ঠীর নিপীড়ন ও দমননীতির পাশাপাশি মুক্তিকামী বাঙালির অপ্রতিরোধ্য সাহসিকতা যেমন ফুটে উঠেছে,তেমনি বাঙালির চেতনাকামী ঐতিহ্য কীভাবে উত্তরাধিকার খুঁজে পেয়েছে, তা বিধৃত হয়েছে।

বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক তাঁর চারটি উপন্যাস –
হাঙর নদী গ্রেনেড,
গায়ত্রী সন্ধ্যা,
ত্রয়ী ও
কাকতাড়ুয়া।
চারটি উপন্যাসের মধ্যে কাকতাড়ুয়া কিশোর উপন্যাস। মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাসের মাধ্যমে সাধারণ জনগণের জাগরণটাকেই তিনি ধরতে চেয়েছেন, দেখিয়েছেন।
হাঙর নদী গ্রেনেড তাঁর প্রত্যক্ষ মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাস। এ-উপন্যাস লিখতে তিনি সমকালিক স্থানে বার বার গিয়েছেন। তথ্য-উপাত্ত গ্রহণ করেছেন। এ-উপন্যাসে প্রধান শক্তি বুড়ির মাতৃত্ব। দেশপ্রেমের কাছে পরাজিত হয় সে-মাতৃত্ব। মাতৃত্বকে অতিক্রম করে বোবা সন্তান রইসের হাতে যুদ্ধে ব্যবহৃত এলএমজি তুলে দিয়েছে। মুহূর্তে মুক্তিযোদ্ধাদের বাঁচানোর জন্য নিজের সন্তানকে নিশ্চিত মৃত্যুর সামনে ঠেলে দিয়েছে। হলদী গাঁয়ে বুড়ির পরিবারসহ সাধারণ অধিবাসীর যে-স্বাধীন দেশের স্বপ্ন বাস্তবায়ন করার জন্য ত্যাগ, তা অতি নিখুঁত চিত্রে তুলে এনেছেন। এখানে বুড়ি শুধু তাঁর সন্তানের মা নন, বরং সকল বীর মুক্তিযোদ্ধার মা, শহীদ জননী।

গায়ত্রী সন্ধ্যা উপন্যাসের কাহিনি সাতচল্লিশের দেশভাগ থেকে শুরু হয়ে পঁচাত্তরের স্বাধীন বাংলাদেশের সিভিল শাসকের পতন পর্যন্ত বিস্তৃত। তেইশ বছরের পাকিস্তানি শাসকের নিগড় থেকে মুক্তির প্রক্রিয়া, স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম, তার রাজনৈতিক নেতা, নেতৃত্বের ইতিহাসবিদ্ধ হওয়া উপন্যাসের অমত্মঃপ্রবাহের চরিত্র উপন্যাসে বিধৃত হয়েছে। স্বাধীন দেশের দুরূহ পূর্ণগঠন দুর্ভিক্ষ, অব্যবস্থাপনার সুযোগে অপশক্তির হাতে দেশনায়ক বঙ্গবন্ধুর মৃত্যু; সব মিলিয়ে সিভিল শাসনের অপমৃত্যুর মধ্য দিয়ে উপন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here