স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে কলমযোদ্ধা-নিশাত ফাতেমা এর প্রবন্ধ “মুক্তিযুদ্ধে নারীর অবদান”

500
স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে কলমযোদ্ধা-নিশাত ফাতেমা এর প্রবন্ধ “মুক্তিযুদ্ধে নারীর অবদান”

মুক্তিযুদ্ধে নারীর অবদান

                                        নিশাত ফাতেমা

——-
তারামন বিবি, কাঁকন বিবি এমনই বীর নারীদের মতো আরও অনেকে সশস্ত্র যুদ্ধে অংশ নিয়েছেন। কিন্তু স্বাধীনতা পরবর্তী তাদের পরিচয় সেভাবে সামনে আসেনি।
আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ছিল গেরিলা অপারেশনের উপর বহুলাংশে নির্ভরশীল। যুদ্ধের খবর আদান প্রদান, অস্ত্র পৌঁছে দেওয়া, যোদ্ধাদের লুকিয়ে রাখা, বাড়িতে আশ্রয় দান, খাবার রান্না করে দেওয়া, পাকিস্তানিদের গতিবিধির খবর জোগাড় করা এসবই ছিল মুক্তিযুদ্ধের অতি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এই অতি গুরুত্বপূর্ণ অংশটির সিংহভাগ করেছিলেন নারীরা। তারা এই ভূমিকা পালন করেছিলেন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে।চরম নির্যাতনের শিকার হওয়ার আশঙ্কা নিয়েই।

মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দেওয়া, খাবার সরবরাহ করা, অস্ত্র ও গোপন সংবাদ পৌঁছে দেওয়া এই প্রতিটি ভূমিকার জন্য অসংখ্য বাঙালি নারীকে পাকিবাহিনী হত্যা করেছে, ক্যাম্পে নিয়ে ধর্ষণ ও চরম নির্যাতন করেছে। কিন্তু নারীর এই বীরত্বের জন্য স্বাধীন দেশে তাঁকে তেমন কোনো স্বীকৃতিই দেওয়া হয়নি।

বিদেশে বিশেষ করে ইউরোপ ও আমেরিকায় মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বিশ্বমতামত গড়ে তোলার জন্য যে প্রবাসী বাঙালিরা কাজ করেছেন তাদের মধ্যেও ছিলেন অনেক নারী। নূরজাহান মুরশিদসহ এই নারীরা মুক্তিযুদ্ধের জন্য তহবিল সংগ্রহ করেছেন, জনমত গঠন করেছেন। তারাও কি খুব বেশি স্বীকৃতি পেয়েছেন?
মুক্তিযুদ্ধে যে নারীরা পাকিস্তানি বর্বরদের গণধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন পরবর্তিতে সবচেয়ে বেশি সামাজিক বৈরিতার শিকার হয়েছিলেন তারাই। ক্যাম্পে আটক একজন পুরুষ মুক্তিযোদ্ধার মতো একজন নারী মুক্তিযোদ্ধাও একইভাবে শারীরিক মানসিক চরম নির্যাতনের স্বীকার হয়েছিলেন। কিন্তু পরবর্তিতে পুরুষযোদ্ধা মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি নিয়ে সমাজে প্রতিষ্ঠা পেলেও নারীকে দেওয়া হয়নি মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে নারীর অবদান কারও চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। পাকিস্তানি হানাদার সৈন্যদের নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়েছেন এদেশের প্রায় তিন লাখ নারী। তাদের ধর্ষণ করা হয়েছে, হত্যা করা হয়েছে এবং প্রচণ্ডভাবে আঘাত করা হয়েছে। এই প্রবল নির্যাতনকে ‘সম্ভ্রম হারানো’ বলা ঠিক নয়। কারণ ধর্ষণের শিকার যিনি হচ্ছেন তিনি ভিকটিম, তিনি তো সম্মানহানির কোনো কাজ করেননি। সম্ভ্রম হারিয়েছে নির্যাতক। সে মনুষত্ব হারিয়ে মানুষ থেকে পিশাচে পরিণত হয়েছে। একাত্তরে প্রকৃতপক্ষে সম্ভ্রম হারিয়েছিল পাকিস্তানিরাই। তারাই সারা বিশ্বের চোখে ধর্ষক, হানাদার ও নরপিশাচ হিসেবে পরিচিত হয়েছে। তাদের প্রকৃত পৈশাচিক রূপ প্রকাশিত হয়েছে। অথচ যুদ্ধের পর নির্যাতনের শিকার নারীরা এক অন্যরকম বৈরিতার মুখোমুখি হন। তাদেরকে ‘সম্ভ্রম হারানো’ নারী বলে সমাজে একঘরে করে ফেলা হয়। যিনি ধর্ষণের শিকার হলেন তাকে মমতাভরে গ্রহণ করার পরিবর্তে নির্যাতনের দায় তার উপরেই চাপিয়ে পরিবারে ও সমাজে তাকে আশ্রয়হীন করে ফেলা হলো।

শত নির্যাতনের পরেও তারা স্বীকার করেননি, প্রকাশ করেননি কোনো মুক্তিসেনার নাম। অনেক নারীদের পরিবারের সদস্যরা তাকে গ্রহণ করেনি। তাদেরকে আশ্রয় নিতে হয়েছে কোন আত্ময়দের বাড়ীতে। কারণ তিনি নারী।
এভাবেই আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ- যা ছিল নারী-পুরুষের সম্মিলিত জনযুদ্ধ, নারীর জন্য জন্ম দেয় দ্বিতীয় দফা সংগ্রামের। যুদ্ধে ভয়ংকর নির্যাতনের শিকার এই নারীরা তাদের পরিবার দ্বারা প্রত্যাখ্যাত হন। সেইসঙ্গে যুক্ত হয় যুদ্ধশিশুর বিষয়টিও। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান এই নারীদের পুনর্বাসনে এগিয়ে আসেন। তিনি এই নারীদের জন্য আশ্রয়কেন্দ্র স্থাপন করেন। তিনি তাদের নিজের কন্যার মর্যাদায় জীবনে প্রতিষ্ঠিত করার প্রচেষ্টা নেন।
কবি সুফিয়া কামাল, ড.নীলিমা ইব্রাহিমসহ বিভিন্ন সমাজ সেবকের উদ্যোগে সরকারি পর্যায়ে যুদ্ধাহত নারীদের পুনর্বাসনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। বেসরকারি পর্যায়ে মাদার তেরেসা প্রতিষ্ঠিত মিশনারিজ অফ চ্যারিটিজ এর কর্মীরা যুদ্ধশিশু এবং নির্যাতনের শিকার নারীদের আশ্রয় ও পুনর্বাসনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক সেবা প্রতিষ্ঠানও এ কাজে এগিয়ে আসে। যুদ্ধশিশুদের অনেককে বিদেশে বিভিন্ন পরিবারে দত্তক দেওয়ার ব্যবস্থাও করা হয়।

নির্যাতনের স্বীকার এই নারীদের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি পেতে অপেক্ষা করতে হয় চার দশকেরও বেশি সময়। তবে সকলে এখনও এই স্বীকৃতি পাননি।
এই নারীরা বীরযোদ্ধা। তাদের যথাযথ সম্মান জানাতে হবে, স্বীকৃতি দিতে হবে। এবং তাদের বিভিন্ন সহায়তাও দিতে হবে। তাদের আত্মত্যাগের কথা প্রচার করতে হবে গৌরব সহকারে। তারা আমাদের জাতির জন্য গৌরবের। তারা যুদ্ধের বীর নারী। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে যে নারীরা অস্ত্রহাতে যুদ্ধ করেছেন, যারা মুক্তিযোদ্ধাদের ঘরে আশ্রয় দিয়েছেন, যারা খবর পৌঁছে দিয়েছেন মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে।যারা পাকিস্তানী সেনা বাহিনীর নির্মম নির্যাতনের স্বীকার হয়েছেন তারা সবাই মুক্তিযোদ্ধা। তাদের বীরত্ব ও আত্মত্যাগের ইতিহাস আমাদের বিজয়ের ইতিহাস, গৌরবের ইতিহাস।।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here