ওপার বাংলার সাম্য দর্শনের কবি ও লেখক অ ল ক জা না এর মুক্ত গদ্য “ক্রমা এবং জীবাশ্মকথা”

374
সাম্য দর্শনের কবি ও লেখক অ ল ক জা না এর মুক্ত গদ্য “ক্রমা এবং জীবাশ্মকথা”

ক্রমা এবং জীবাশ্মকথা
—————————————————————-
                     অ ল ক জা না

(এক)
যত জোর খাটানো দুটো পায়ের ওপর। মন তো সার্বভৌম। কোন বারণই তার পক্ষে যথেষ্ট নয়। বরাবরই হেঁটে গেছে নিয়ন্ত্রণের বাইরে। প্রতি পলে তার সজোর উক্তি— “বন পুড়লে সবাই দেখতে পায়, কিন্তু মন পুড়লে কেউ জানতে পারে না” এই পন্থানুসরণ করে মন দিব্যি আছে। রাজার হালে, বলতে পারি রাজার মতো। মন চলে যায়।
একা সঙ্গীহীন। সহযাত্রী নিতে হয় বা নেওয়া উচিত সে কথা তাকে কে বোঝাবে ? সে তো কোনদিন কারো কথা নিতে অভ্যস্ত নয়। সুতরাং আজ কোন বাদসাধা অনর্থক, ছেলেমানুষির নামান্তর ছাড়া কিছুই নয়। অন্তর্ঘাতে কোন রক্তক্ষরণ নেই। তাই প্রিয় মুখ প্রিয় মানুষ অপমান, অপদস্থের চিতা সাজালে হাসতে হাসতে দেশপ্রেমিকের মতো আগুনের আহুতি সারা অঙ্গে মেখে নেয়।

নীরব নিস্পন্দ সুরের মূর্ছনায় বিলীন হয়ে যায়, হয়তো সেটাই অবধারিত তবুও তার অবিকৃত অভিব্যক্তি বড়ো অবিশ্লেষ্য অভিব্যক্তি। মনের এই স্বেচ্ছাচারিতা কখনো সখনো পীড়াদায়ক হলেও এতটাই একান্ত নির্জন যে তার খবর কেউ কখনোই পায় না। আড়ি পাতলেও না। এমন কি সেই মহাশয় শরীরের চরণজান পা যুগলও মনের গন্তব্য কিছুই জানে না। যত বেড়ী পায়ে। মনকে বাঁধে কে ? সে দৌড় আবার কারো আছে নাকি ? বাঁচার ঠিকানা সবারই আলাদা। যে যার মতো। “ক্রমা” মানে ক্লোরোফিল, হতেও পারে লোহিত কণিকা। তাকে আশ্রয় করেই তো আমার এই কবিতার সন্ন্যাস যাপন। আমার শরীরে তার স্বাদ আসে জ্যোৎস্না ভেজা আকাশের মতো। তাকে নিয়ে এখনো পালাই। সমাজ রাষ্ট্র সমস্ত রকম আপত্তি নিষেধের বহু যোজন দূরে। একাকারও হই। বহু গোপন সযত্নে গচ্ছিত ব্যক্তিগত অতীতের সঙ্গে।

(দুই)
কেউ জানতেই পারে না, কেউ বুঝতেই পারে না আমার এই সক্ষম ক্ষয়ের আগুন খেলা।
দুটো পা আপত্তির অদেখা বেড়ি পরে আটকে থেকে গেছে মহাদেশের সীমান্তে। সংসার আশ্রিত লক্ষণরেখায়। শরীরের ভার বইতে পারা মনের কম্ম নয়। তাই হয়তো বেচারা এত স্বেচ্ছাচারী ! পা ও শরীরকে ডাকলে, সঙ্গে নিলে সারা পৃথিবী জেনে যায় আমার নির্দিষ্ট গন্তব্যের সাতকাহন। তাই গোপনীয়তার চুপ কথায় বিশ্বাস রাখি। এখনো হাঁটি। নিরন্তর হেঁটে যাই মুখ ফেরানো ক্রমার কাছে। পেছনে তাকাই, তাকিয়ে দেখি, কেবল কী আমি একা ? এক পৃথিবী মানুষ সাজানো সংসার, মহাদেশ সীমান্তে পা রেখে যে যার মতো মিলেমিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে একান্ত গোপনীয় ব্যক্তিগত শ্বাসের সঙ্গে। পায়ে বেড়ী কিন্তু গন্তব্যের ঠিকানা পায় সাধ্য কার !

পূর্বনির্ধারিত সূচি অনুযায়ী ওপরওয়ালা প্রতিটি জীবনের জন্য শ্রেষ্ঠ উপহার বরাদ্দ করে রাখেন। যে যেমন স্তরের মানুষ, তার জন্য সেই মোতাবেক উপহার। পরমায়ুর যে কোন স্তরেই নাগালে পৌঁছে দেন। হতে পারে স্থাবর-অস্থাবর কিংবা কোন মানুষ উপহার। যার উপস্থিতির জোরে, আলোকে কক্ষপথ পালটে যায়। গতিরাগের মঙ্গলশঙ্খে এক পরমৈশ্বর্যের দ্যুতিলিখন যাত্রাপথ টুকু করে তোলে ফুলমগ্ন। তখন নিজেকে নিজের কাছে তীক্ষ্ণ প্রসন্নতায় বলতে শোনা যায়—“আমি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সুখী” তা এই সুখ, এই আনন্দ দীর্ঘ মেয়াদী হোক বা স্বল্পায়ু নিয়ে আসুক ? প্রতিটি জীবনই তার শ্রেষ্ঠ উপহারের সঙ্গে সাক্ষাতের ব্যাপারে ঈশ্বর কখনোই কাওকে বঞ্চিত করেন না।

(তিন)
এই উপহার বড়োবেশি মায়াময়। কারণ হাতে তুলে দেয়ার পরই ছিনিয়ে নেয়ার নির্ঘণ্ট নির্ধারণ করতে থাকেন দাতা। ফলে পাওয়ার আনন্দের থেকে হারিয়ে যাওয়ার বিষাদঘন সুর অনেক বেশি অন্তর্দাহী। তা ইতিমধ্যে যারা এই মর্মে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছে তারা জানে উপহারের বোধনবিসর্জন খেলা। মহাবিশ্বের প্রতিটি নিয়মের মধ্যে এই উপহার প্রক্রিয়াটিও যথেষ্টই গুরুত্বের সঙ্গে সাবলীল এবং নিত্য আবর্তিত। উপহার কাজের গতি বাড়িয়ে দেয়। নিজেকে নিয়ে নতুন করে ভাববার ও মূল্যায়ন করার অবসরে এক অন্তর্মুখিনতার সৃষ্টি করে। অপার মুগ্ধতার জ্যোতির্ময়ী “ক্রমা” কবিতার বেদমন্ত্র, আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ উপহার বলা যায়।

তখন নতুন করে নিজেকে ভালোলাগা, ভালোবাসার কায়দাকানুন একটু অদ্ভুত ছিল বইকি। তারপরই ধীরলয়ে একদিন সেই উপহারের লীনতাপ বেরিয়ে গেলে জীবন একেবারে ভেতরে ভতরে কমজোরি আলম্বহীন হয়ে যায়।
জীবনের এক শ্রেষ্ঠ উপহারের সঙ্গে কয়েক ঋতু যাপনের স্মৃতিসম্পদ, সযত্নে আমিও গচ্ছিত রেখেছি। জীবাশ্মের মতো মানবিক দহে। আসলে ঈশ্বর জীবনের শ্রেষ্ঠ উপহার হাতে তুলে দেয়ার পর একদা ফিরিয়ে নেন। তখন শূন্যতার ভেতর পড়ে থাকে সুখকর কিছু স্মৃতি বিস্মৃতির টুকরো আর তাকে না আটকে রাখতে পারার অনিচ্ছুক ব্যর্থতার জীবাশ্ম।
———————————————————————

Content Protection by DMCA.com

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here