জীবনধারা কালের পরিক্রমায় লেখক -বাদল কৃষ্ণ বণিক লিখেছেন বাস্তবধর্মী ছোটগল্প “ নিমলের_নির্মাল্য ”

569
লেখক -বাদল কৃষ্ণ বণিক

নিমলের_নির্মাল্য

                 বাদল কৃষ্ণ বণিক

সারাদেশব্যপী করোনা আতঙ্ক, মস্তিষ্ক প্যারালাইজড প্রায়, বাহিরে মুখখানি হাসিমুখ হলেও ভিতরে আতঙ্ক চাপে ভেসে উঠে। অন্যান্য দিনের মতো মিতা ঘরের কামকাজ শেষ করে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল আঁচড়াছিল, ঠোঁটে হালকা লিপস্টিক দিতে হঠাৎ তার স্মার্ট ফোনে ইমুতে কল আসলো, ভেসে উঠলো নির্মলের হাসিমাখা ছবিটা, বুকটা ধক্ করে উঠলো। মিতার মনেও করোনা আতঙ্ক, নির্মল ইতালিতে থাকে, মিতার মনেও নির্মলের সুস্থতা নিয়ে টেনশন কাজ করে। লিপস্টিক কোনমতে ঠোঁটে দিয়ে কলটা ধরলো, আনন্দ মনে নির্মলের ভিডিও কল টা ধরলো। মিতা সপ্তাহে রবিবার দিন শেষে সন্ধের সময় ভিডিও কলে কথা হয়। মিতার মা জানে নির্মলেরর সাথে দীর্ঘ দুবছর ধরে সুন্দর একটা সম্পর্ক। মিতার মা সুহাসিনী নির্মল দেশে ফিরলে ওদের বিয়েটা সেরে দিতে চাচ্ছে। মিতার বাবা একরোখা টাইপের নির্মল ছিল হিন্দু নিম্ন বর্ণের, মিতা ব্রাহ্মণ। তাই বর্ণপ্রথায় কারণে এদের বিয়ে মানাটা সম্ভব নয় – এটা সাফ জানিয়েছিল সুহাসিনীকে। ইঞ্জিনিয়ার নির্মল ইতালির একটি বহুজাতিক কোম্পানিতে চাকরী করতো । মিতা ভিডিওকলে একে অপরকে দেখার স্বাদ যেন শেষ হয়না এমনিভাব এদের, একে অপরকে ছাড়তে চায়না। কুশলসংবাদ জেনে নির্মল বললো, ইতালির অবস্থা অত্যন্ত হৃদয়বিদারক। প্রতিদিন করোনায় মারারা যাচ্ছে গড়ে সাত’শ মানুষ। মিতা তাকে হাতে পায়ে ধরে বললো, ‘ তুমি চলে আসো যেকোনভাবে, নয়তো আমি মরে যাবো তোমার টেনশনে ‘ কথার ফাঁকে মিতা বললো, ” মা বলেছে এবার আসলে আমাদের বিয়েটা সেরে ফেলবে, যদিও বাবার আপত্তি আছে। বাবার শত আপত্তি থাকুক তাতে যায় আসেনা আমার, আমি তোমাকে মন দিয়েছি, প্রেম মানে জাত ধর্ম বর্ণ, মানে মানবিকতা। ” হঠাৎ নেট চলে যাওয়ায় লাইন কেটে গেল। বারবার চেষ্টা করেও নির্মলের কাছ থেকে কোন উত্তর পাওয়া যায়নি। মিতার মন খারাপের সময়টায় একটু আনন্দ দিলেও হতাশায় করে দিলো ইন্টারনেট। মিতা তার মা’কে নির্মলের কথাগুলো শেয়ার করতে লাগলো, সুহাসিনী দেবী তখন রাতের রান্নাবাড়া করছিল উঠানের একদিকে, চৌচালা টিনের ঘরের কোণায় লাগানো সাদামাটা বিদ্যুতের বাতি থেকে, মিতা ও তুলসী তলায় প্রদীপ জ্বালাতে জ্বালাতে মার কাছে কথাগুলো বলে যেন ভিতরের তাপ কমাতে চেয়েছিল, মিতার বাবা শুনে বললো, এখন ইতালিতে যা চলছে তা সামাজিক যোগাযোগে সব আসছে প্রতিদিন মানুষ মরে লাশের মিছিল চলছে। ” হে বাবা, নির্মলের সাথে কথা বললাম এখন ” মিতার বাবা শুনে কপাল কুঁচকে কিছু কথা না বলে চলে গেল।

মিতা ও নির্মল একই গ্রামের তাদের দুজনের বাড়ির মাঝখানে একটা বড় পুকুর, পূজার সময় বেশ আনন্দ হয় নির্মলদের বাড়িতে, পুরোহিত করেন মিতার বাবা হেমেন্দ্র ভট্ট। যজমানি করেন নির্মলদের বাড়িতে সাতপুরুষ ধরে। এজন্য মিতার সাথে ওদের সম্পর্কটা দীর্ঘ দিনের। কিন্তু মিতা নির্মলের এ সম্পর্কটায় বেশ চিঁড় ধরালো হেমেন্দ্র ভট্টের মনে। তাছাড়া নির্মলদের টাকাপয়সার কাছে হেমেন্দ্র ঠাকুর অসহায়, গরীব ব্রাহ্মণ যজমানি করে কি আরর আয় হয়, কত টাকাই বা আসে মন্দিরের দক্ষিণায়, আজকাল মানুষ ধর্ম থেকে অনেক দূরে, ঠাকুরকে প্রণাম করে হাতে পাঁচ টাকাও উঠেনা, তাই যজমানদারদের বিভিন্ন পাবনের উপর নির্ভর করতে হয়।
ঘুম আসেনা মিতার, মনে একটা হতাশা, একটা তাপ, সারারাত ধরে দুঃচিন্তা কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে, নির্মল সত্যি সুস্থ আছে তো ? সন্ধের পর পরই রিমোট কন্ট্রোল হাতে নিয়ে টিবিতে দেখতে থাকে মিতা, এতদিন ভারতের স্টার জলসা, জি টিবি’র সিরিয়াল দেখতো, কিন্তু করোনাভাইরাস আক্রমণে সংবাদ এখন তার বাতিক।
বেশ কয়দিন ধরেই এসব সংবাদে মিতাকে একেবারে ব্যতিক্রম নীরবতায় আচ্ছন্ন করে ফেলেছে। কলটলও আসেনা, নেটেও তাকে পায়না। ডাটা সারাক্ষণ অপেন থাকলেও নির্মলের কোন সংবাদ পায়না মিতা। মিতার খাবারদাবারে কোন আগ্রহ নেই, মাথায় ভনভন করে একটা অজানা সংবাদ। আবার মনে একটা প্রশান্তি আনে, ইতালিতে যারা মারা গেল তাদের গড় বয়স সত্তর। কিছুক্ষণ মনের ভিতরে এসব হিসাব মিলাতে মিলাতে বেশ দশ পনের দিন চলে গেল। বাংলাদেশ বিমান বন্দরে বেশ লোকজন বিদেশ ফেরত আসলেও নির্মলের কোন খুঁজ পায়নি মিতা। সাতসকালে একটা অচেনা নাম্বার থেকে কল আসছে, কিন্তু মিতা তা দেখেও ধরেনি, বিশটা কলের পর মিতা কল ব্যাক করলো, ফোনের অপর প্রান্ত থেকে অজানা অচেনা একজন ডাক্তার বললো,
” নির্মল দেব’কে চিনেন আপনি ? “
হে বলুন তো, কি হইছে ?
আপনি কাওকে বলবেন না, তিনি করোনায় আক্রান্ত, আমাদের ইউনিটে আছেন তিনি। ঠিকানা শুনে মিতা কলটি কেটে দিলো।

এক দৌড়ে মা’কে জড়িয়ে ধরে বললো, মা আমি আর বাঁচব না, নির্মল করোনা আক্রান্ত পরিস্থিতি খুব খারাপ, বিমান বন্দরেই সে ধরা খেলো করোনায়। ভাইরাস নিয়ে দেশে ঢুকেছিল আরো এক সপ্তাহ আগে। বলতে বলতে মিতা অজ্ঞান, বারবার মাথায় জল দিলেও একটু হুশ আসলেও জ্ঞান শূন্য হয়ে পড়ে।
এখন তো সারাদেশব্যপী কলডাউন, সেনাবাহিনী পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করছে, ঘর থেকে বেরও হওয়া দায়। একসাথে চলাফেরা করাও অসম্ভব এক পরিবেশ। দোকানপাট বন্ধ, বিশেষ কোন কাজে বের হলেও স্বল্প শিক্ষিত মানুষ এর উপর ঢাকায় যাওয়া ব্যয়ভার বহন করাও কঠিন। এমতাবস্থায় হতাশাগ্রস্থ মিতার পরিবার। ডাক্তারের ফোন থেকে আরেকটি ফোন আসলো নির্মল নেই কিছুক্ষণ আগেই চলে গেল অজানা ঠিকানায়।।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here