সমকালীন সৃজনশীল লেখক-জসীম উদ্দীন মুহম্মদ এর লিখা ছোট গল্প “সন্দেহ”

482
সমকালীন সৃজনশীল কবি-নাসিমা হক মুক্তা এ র লিখা কবিতা “মুখচ্ছবি ”

সন্দেহ

            জসীম উদ্দীন মুহম্মদ

——————————
কলমি সারাদিন গতর খেটে খায়। যেমনি স্বামীর সংসারের ঘানি তেমনি প্রতিবেশির ঘাটের পানি। হররোজ একই রুটিন। নাকের জল চোখের জল সামনাসামনি। কাপড় কাছো, ঘর-দোর মোছো, বাটনা বাটো, সবজি কাটো, উনুনে হাড়ি চাপাও, চাল, তেল-জল, মশলা, লবণ দাও…! শুধু এখানেই শেষ নয়; গোছগাছ কর, অতঃপর বাড়িতে যাও। আবার রাঁধ, আবার বাড়, খাওয়াও-খাও। সাহেবদের বউ-ঝিদের বকুনি খাও, সাহেবের কামুক চোখের চাহনি খাও, স্বামীর মন জুগাও; তিন তিনটা সাওয়াল-পাওয়াল সামলাও! ইস্কুলে নিয়ে যাও, নিয়ে আসো… আরও কতো কী! এসব একদিন প্রাগৈতিহাসিক ছিলো, এখন প্রতিদিনই নগদানগদি ইতিহাস হয়। কানের লতি ঘেঁষে সবেগে তেরছা বুলেট যেভাবে ক্ষিপ্ত গতিতে নিক্ষিপ্ত হয়, কলমিরও সেভাবেই দিনলিপি লেখা হয়। কলমির অসুখ-বিমুখ কেবল নামেই হয়। বাস্তবে সুস্থ থাকুক আর অসুস্থ থাকুক — কাজ করেই যেতে হয়। কাজ করেই খেতে হয়। অবশ্য তার অভ্যস্ত শরীর কোনোদিন না করে না। যেমন পেটানো লোহা কামারকে না বলতে জানে না তেমন।
আধা ল্যাংড়া স্বামী ছক্কু মিয়ার ঘরে কলমি যেন কলমি না। সরোবরে পদ্ম ফুটে থাকলে যেমন মনোহর লাগে কলমিকেও ঠিক তেমন মনোরমা লাগে। বলা যায় ডাইরেক্ট ফুটন্ত পদ্মফুল। উজ্জ্বল শ্যামলা গায়ের রঙ। সাড়ে পাঁচ ফিটের একটু বেশি উচ্চতা। নাক-মুখ-চোখের উপর কে যেন লাবণ্যের পর লাবণ্য মাখিয়ে দিয়েছে। গোল-গাল মুখখানি যেনো হাতে তৈরি পুতুলের চেয়ে কোনোঅংশে কম নয়। আর এই বেসামাল রুপটাই হয়েছে তার সাক্ষাৎ কাল-পুরুষ। এখানে কালপুরুষ মানে কাল জয়ী মহাপুরুষ নয়। কাল কেউটের মতোন পুরুষ। রাস্তাঘাটে হাঁটা যায় না…ছেলে -বুড়ো সবাই ঢক ঢক করে গিলে খায়। কলমির আর এসব ভাল্লাগে না। ঘিন ঘিন লাগে। তার কেবলই ফুলন দেবী অইতে মন চায়। কেউ তাকালেই চোখ দুটি খুইল্লা নিতে ইচ্ছা হয়। পুরুষ শাসিত সমাজে সে কিছুই পারে না। মাথা নিঁচু করে রাস্তার একধার ঘেঁষে নীরবে- নিভৃতে হেঁটে যায়।
ছক্কু মিয়া আধা ল্যাংড়া হলেও মানুষ হিসাবে তেমন খারাপ না। সারাদিন একপায়ে রিকশা চালায়। রাইত-বিরাইতে বাসায় ফিরে আসে। ফিরেই একটা হাঁক দেয়, আমার পরী কইরে…..। পরী কলমির ছোট মেয়ের নাম। যেমন বুদ্ধিমতী তেমন রুপবতী। বাবার গলা জড়িয়ে ধরে পকেট হাতড়ায়। খাবার খুঁজে। খেলনা খুঁজে। খাওয়া-দাওয়া শেষে ছক্কু মিয়া রোজকার মতো কলমির উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। বন্য আদরে কলমি প্রতিদিনই স্বর্গের সুখ পায়। অতঃপর কোথা থেকে ক্লান্তি আর অবসাদ এসে দু’চোখের সুড়ঙ্গে রাজ্যের ঘুম ঢেলে দিয়ে যায়।

ছক্কু মিয়া রিকশা চালায়; তবুও একটি পুরনো জরাজীর্ণ ভবনের দোতলায় থাকে। দুটি ছোট ছোট রুম। পাঁচ ফিট বাই দেড় ফিটের একটি বারান্দাও আছে। যেখান থেকে আকাশ ছোঁয়া যায়। আকাশের মতোন বিশাল বিশাল স্বপ্ন দেখা যায়৷ রাতের আকাশে নক্ষত্রের সাথে কথা বলা যায়। তারা খসা কিংবা উল্কা পতনের দৃশ্যও বাদ যায় না। এখানেই কলমি আর ছক্কু মিয়ার স্বপ্নেরা বড় হচ্ছে৷ এই স্বপ্নদের নাম পরী, তিতলি আর জোহরা। এরাই একদিন বড় হবে। পুরুষ শাসিত সমাজের ঘাড় থেকে ধর আলাদা করবে। এসব ভাবতেই তাদের ভাঙা নৌকোর পালে হাওয়া লাগে। জোড়া শালিক পতপত করে উড়ে। ভালোবাসারা আরও মজবুত হয়ে তাদেরকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রাখে। আর এই ভালোবাসা নিয়েই কলমির যত ভয়। কলমি জানে, ভালোবাসা যত বেশি, তার জ্বালাও তত বেশি। পান থেকে চুন খসলেই আর রক্ষে থাকবে না। সন্দেহের বিষবৃক্ষ সমস্ত জগত সংসার পুড়ে ছাইপাঁশ করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট।

খোলা বারান্দায় দাঁড়িয়ে কলমি এসব ভাবতে ভাবতে হাড়কাঁপানো শীতের মধ্যেও কলমি ঘামছে। কলমি জানে, তার এই একরত্তি মনে কোনো পাপ নেই। তার হৃদয়াকাশে ছক্কু মিয়া ছাড়া আর কারো কোনো স্থান নেই। লুলা হোক, ল্যাংড়া হোক…ছক্কুই তার প্রাণপতি। ছক্কুতেই বাঁচা, ছক্কুতেই মরা। ছোটবেলায় কলমি দাদীর মুখে শোনেছিল, লজ্জাস্থান মানুষ কয়জনকে দেখায়!! এইটুকু পর্যন্ত ভাবতে না ভাবতেই দরজায় ঠকঠক করে তিনবার শব্দ হয়। ছক্কু এসেছে ভেবে কলমি দৌড়ে যায়। সাথে সাথে আবার এটাও মনে হয় এখন তো ছক্কুর আসার কথা নয়। সে তো গ্রামের বাড়িতে যাবে বলে গিয়েছে। একটা সন্দেহের বীজ কলমির মনে দলা পাকে। তাহলে সেই খসরু কুত্তাটা নাতো? আজ সকালে তার বাসায় কাজ করার সময় কী জানি একটা বিড় বিড় করে বলেছিল! কলমি একেবারেই পাত্তা দেয়নি। তবুও একটা বাক্য তার কানের ছিদ্রের ভেতর বিষ ঢেলে দিয়েছিল—
আজ রাইতে তোর বাসায় আসব কলমি। তোর দুখের দিন শেষ। আমি তরে রানী করে রাখব। আল্লাহর কসম দিলাম, আমার কথা মিথ্যা না।
কলমি কোনো জবাব দেয়নি। হাতের কাজ শেষ না করেই পীপিলিকার মত পিলপিল করে চলে এসেছিলো। এতোকিছুর পরেও কলমিও বুকে সাহস সঞ্চার করে হাতে একটি পুরনো বটি নিয়ে দরজার কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলো, কে?
সাথে সাথে জবাব পাওয়া গেলো, কলমি দরজা খুল। আমি খসরু চৌধুরী।
কলমির মাথায় খুন চড়ে বসলো। তড়াক করে দরজা খুলে দিয়ে বলল, হাতের বটিটা দেখতে পাচ্ছিস তো শুয়োরের বাচ্চা… এক কোপে ধর থেকে মাথা আলাদা কইরা দিমু।
কলমির এহেন রুদ্র মূর্তি দেখে খসরু আর কথা বাড়ালো না। সিঁড়ি ভাঙতে লাগলো। এমন সময় ছক্কু মিয়া বাসায় ঢুকলো৷ সিঁড়িতে খসরু চৌধুরীর সাথে দেখা। একটা সন্দেহের ঘুর্ণিঝড় তার আপাদমস্তকে তীরের মতো বিদ্ধ হতে লাগলো। কিন্তু খসরুকে কিছুই বলল না। যা বলার কলমিকেই বলবে ভেবে দরজায় কড়া নাড়ল। কলমি জিজ্ঞেস করলো, কে?
ছক্কু মিয়া বলল, দরজা খুল মাগি। আমি তোর যম।
কলমি একেবারে হতভম্ব হয়ে গেলো। হাত থেকে বটিটি লাফ দিয়ে নিচে পড়ে গেল। সে কিছু বলার আগেই ছক্কু মিয়া রেগে-মেগে বলল, তোর সতীপনার প্রমাণ আজ হাতে-নাতে পেলাম কালনাগিনী। আমার খাস, আমার পড়স…. আর চৌধুরীর সাথে পরকিয়া করছ! তুই এক্ষুনি আমার বাসা থেকে বের হয়ে যা। আমি তোরে তালাক দিলাম… এক তালাক, দুই তালাক, তিন তালাক… বাইন তালাক।
এ যেন ভোজবাজি! কলমির আত্মপক্ষ সমর্থন করে অনেক কিছু বলার ছিলো। কিন্তু কিছুই বলা হলো না। হঠাৎ এক ঝড় এসে কলমির সমস্ত আকাশ চুরমার করে দিয়ে গেলো। ইতোমধ্যে পরী, তিতলি, জোহরা এসে পাশে দাঁড়িয়েছে। কেউ কিছু বুঝে উঠতে পারছে না। ছক্কু মিয়া আবার হুংকার ছাড়লো, বের হয়ে যা হারামজাদী। বের হয়ে যা…
একান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও কিংকর্তব্যবিমূঢ় কলমি দরজার দিকে পা বাড়ায়। পরী এসে মা-কে জড়িয়ে ধরে। কলমি পরীকে কোলে নিতে চাইতেই ছক্কু মিয়া জোর করে হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলে, তুই বের হয়ে যা নষ্টা মেয়েমানুষ কোথাকার…পরী আমার মেয়ে, আমার সাথেই থাকবে।
কলমির অনেক কিছুই বলার ছিলো। কিছুই বলেনি৷ বলা চলে বলতে পারেনি। কেবল দু’চোখের কোণে আলোড়িত জলোচ্ছ্বাস নিয়ে বের হয়ে গেলো। ———————————–

 লেখক পরিচিতিঃ সহযোগী অধ্যাপক, সরকারি আনন্দ মোহন কলেজ, ময়মনসিংহ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here