বিভূতিভূষণ স্মৃতি পুরস্কার প্রাপ্ত লেখিকা ও কবি সুজাতা দাস এর লিখা ছোট গল্প “প্রতিচ্ছবি”

617
ছোট গল্প “প্রতিচ্ছবি”
বিভূতিভূষণ স্মৃতি পুরস্কার প্রাপ্ত লেখিকা ও কবি সুজাতা দাস এর লিখা ছোট গল্প “প্রতিচ্ছবি”

প্রতিচ্ছবি

                 সুজাতা দাস

জীবন একটা আয়নার মতো-
দেখা যায়, ছোঁয়া যায়, কিন্তু ধরা যায়’না কিছুতেই-
একটা পিচ্ছিল পদার্থের মতো যেন সবকিছু, তাই নিজেকে ধরতে না পারার কষ্টটা মনে মনে অনুভব করে শর্মিষ্ঠা-
সংসারে অনাহূত হয়ে পরে থাকার দায় শর্মিষ্ঠার মাথায় চাপিয়ে দিয়ে, শংকরের এই সংসার থেকে বিদায় নেওয়াটাকে
মন থেকে মেনেও নিতে পারেনি শর্মিষ্ঠা।
নিজের এই পরিস্থিতির কারন যে শংকর এটা মন’থেকে মুছতেও পারে’না কিছুতেই শর্মিষ্ঠা-
সর্বক্ষণ দোষ ধরতে থাকা শর্মিষ্ঠার কারনে, সংসার থেকেই যে একদিন বিদায় নেবে শংকর, ভাবনার’ও অতীত ছিল শর্মিষ্ঠার কাছে-
হয়তো অনেক অনেক উচ্চাশা ছিল শর্মিষ্ঠার মনে ছোট্ট থেকেই-
কোনটাই পূরন হয়নি কখনও, অনেক ছোট বেলায় মা মারা যাওয়ায় হয়তো ঠিক শিক্ষায় মানুষও হতে পারেনি শর্মিষ্ঠা-
কিন্তু কপাল গুনে পড়লো এসে অনেক ভালো একটা ছেলের হাতে, যার নামটাই শংকর কিন্তু স্বভাবে কোথাও নামের সাথে কোন মিল খুঁজে পাওয়া যায়নি কখনো।
কোন তাণ্ডব করবার একবিন্দু ইচ্ছেও তার স্বভাবে ছিল’না কখনও; এহেন শংকর এর অবস্থা দিনে দিনে শোচনীয় হবে এটাই স্বাভাবিক ছিল আর শর্মিষ্ঠার কারনে হলো’ও-
যথারীতি সংসার করতে এসে শংকরের দোষ ধরাটাই প্রাধান্য দিতে থাকলো শর্মিষ্ঠা সবসময়ই-
সংসারে শর্মিষ্ঠা ছাড়া আর প্রত্যেকেই যে সৃষ্টিছাড়া এটা প্রতিপলেই বুঝতে থাকলেন সংসারের সবাই-
এই রোজকার চিৎকার চেঁচামেচির ডামাডোলের অস্থিরতায় অস্থির হয়ে একদিন শংকর বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন
হঠাৎ করে আর ফিরলেন না-
প্রথমে ব্যাপারটা এমন ছিল’যে কোথায় যাবে? এখানেই ফিরতে হবে পেটে টান পরলেই ফিরে আসবে-
কিন্তু অনেক খোঁজাখুঁজির পরে’ও যখন খোঁজ পাওয়া গেল’না শংকরের; তখন কান্নাকাটি শুরু করলো শর্মিষ্ঠা হাত’পা ছড়িয়ে-
আমার কী’হবে, আমি এমন’কী বলেছি যে বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে হবে-
আমার কী’হবে এরপরে, সামান্য কথা’কী স্বামী’স্ত্রীতে হয়’না-
কোন স্বামী তার স্ত্রীকে ছেড়ে সংসার ছেড়ে চলে যায় নিরুদ্দেশের উদ্দেশ্যে, এই গোছের উক্তি-
অবশেষে পরিস্থিতির দায় শংকরের ঘাড়ে চাপিয়ে বিলাপ, নিশ্চয়ই তলে তলে অন্য ব্যবস্থা করে রেখেছিল না হলে আমার কথা ভুলে গেল কী’করে-
নিশ্চয়ই কোনও শাকচুন্নি তাবিজ করে রেখেছে তাই শর্মিষ্ঠার কথা একেবারেই ভুলে গেছে-
এইসব বিলাপ করতে করতেই দিন থেকে মাস- মাস থেকে বছর ঘুরে দিনের মতো দিন চলতে থাকলো শংকর ছাড়াই-
অনেক বছর হয়ে গেছে শংকরের কোনও হদিস আর পায়নি আর শংকরের পরিবার, দুই ছেলে অনেক খোঁজাখুঁজির পর হাল ছেড়েছে শংকরের-
হয়তো তারাও মনে মনে ভেবেছে হয়তো ঈশ্বরের কোলে স্থান পেয়েছেন তাদের বাবা-
ছেলেদের বিয়ে হয়ে গেছে, ছেলেরাও নিজের সংসার নিয়ে ব্যাস্ত এখন মায়ের খবরও ঠিক মতো নেবার সময় পায়না তারা কোনও বেলাতেও-
আজ এই সময়ে এসে শর্মিষ্ঠা হঠাৎ করেই একদিন উপলব্ধি করলো, তার নিজে হাতে গড়া সংসারে নিজেরই কোনও মূল্য নেই-
ঠিক এই সময়ই হঠাৎ শর্মিষ্ঠার মনে হল শংকরের সাথে সে ভালো ব্যবহার করেনি কখনও, কেন খারাপ ব্যবহার করতো শংকরের সাথে? ভাবতে ভাবতেই চোখে জল চলে এলো-
ক’তো বাজে ব্যবহার সে’করেছে শংকরের সাথে তবুও শংকর টু’শব্দ করেনি কখনও- বরং মা’কে বলেছে ছোটবেলায় সব হারিয়ে অন্যের দয়ায় থেকেছে, হয়তো লাথি’ঝাঁটা খেয়ে মানুষ হয়েছে তাই একটু ওমন-
তুমি তোমার ভালোবাসা দিয়ে মানিয়ে নিও মা-
আজ তাঁর কারনেই ঘরছাড়া শংকর এই উপলব্ধি করতে পারলো শর্মিষ্ঠা কেমন করে যেন-
আর সঙ্গে সঙ্গেই ঠিক করলো খুঁজে বার করবে সে শংকরকে, এখনও দেরি হয়ে
যায়’নি-
হঠাৎ’ই একদিন কাউকে কিছু না’বলে বেরিয়ে পড়লো শংকরের খোঁজে, রাতের আঁধারে নিজের কিছু সঞ্চিত অর্থ আর কিছু প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র আর শংকরের দুটি ছবি নিয়ে বেরিয়ে গেলেন শর্মিষ্ঠা-
জীবনের পরম’পাওয়া যা’সে হেলায় হারিয়ে ফেলেছে নিজের অবহেলা আর অনাদরে,
সেই অনন্ত ভালোবাসার খোঁজে-

2 COMMENTS

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here