“ নিখিলেশের বোধদয় ” জীবন ধর্মী গল্পটি সৃষ্টিশীল লেখনির আলোয় আলোকিত করেছেন লেখক ও কবি শামসুন নাহার ।

553
লেখনির আলোয় আলোকিত করেছেন লেখক ও কবি শামসুন নাহার

নিখিলেশের বোধদয়

                               শামসুন নাহার

বৃদ্ধাশ্রমের খাটে শুয়ে শুয়ে ভাবছে নিখিলেশ,কি মধুময় একটা জীবন ছিল ওর।আর কিভাবে সে নিজে সেই স্বর্গীয় সুখ নষ্ট করেছে।কি বঞ্চনার জীবন ওর শুরু হয়েছে।নিজের প্রতি প্রচন্ড ধিক্কার আসে।চিৎকার করে বলতে ইচ্ছা করে নিশিতা আমি ভুল করেছি,আমি ভুল করেছি।যখন যৌবন ছিল তখন স্ত্রীর প্রতি কোন খেয়ালই করেনি।ও সারাক্ষণ পরকীয়া নিয়েই ব্যস্ত থেকেছে। স্ত্রী নিশিতা নিরবে সহ্য করে গেছে।ও তখন দুই সন্তানের মা।দিনের পর দিন ও অবহেলা করেছে আর নিশিতা ওর সর্ব্বোচ্চ চেষ্টা দিয়ে সংসারটাকে আগলে রাখতে চেয়েছে।
বিধাতার কি বিধান আজ সেই নিশিতার সন্তানেরাই ওকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে এসেছে।বিবাহিত জীবনে একচল্লিশ বছর সংসার করার পর যখন এই পরকীয়া নিয়েই দুজনের ঝামেলা হয়,তখনও নিশিতা চায়নি সংসার ভাঙ্গুক।কিন্তু নিখিলেশ যখন স্পষ্ট জানিয়ে দিল রাধাকে ছাড়া সে বাঁচবে না,তখন নিশিতা ওকে বলেছিলো তুমি রাধাকে বিয়ে করে নাও।কিন্তু নিখিলেশ সমাজের মাথা,সে দ্বিতীয় বিয়ে করে সমাজে ছোট হবে না।আর রাধা অন্যের স্ত্রী, দু সন্তানের জননী।অতএব বিয়ে সম্ভব নয়,শুধু গোপন অভিসারেই চলবে তাদের মন দেয়া নেয়া।একথা শোনার পর নিশিতা আর কোন কথা বাড়ায়নি।সোজা ঘুমের ঔষধ খেয়ে দিয়েছে বেশী করে।যেন ও মরে যায়।কিন্তু বিধাতার ইচ্ছা নয় ওর মৃত্যু হোক,ও বেঁচে গেছে।
ওর সন্তানেরা ওকে অনেক রাগ করেছে,কেন সে মরতে চায়?নিশিতা জানিয়েছে ওর এই পরাজিত জীবন ও রাখতে চায়না।ছেলেমেয়ে তখন বলেছে তুমিতো পরাজিত নও।।সে পরাজিত যে তোমার মত স্ত্রী কে ভালোবাসতে পারেনি।এ লজ্জা তার।নিশিতা চুপ হয়ে গেছে, আর ছেলেমেয়েদের যুক্তিই ওর কাছে যুক্তিযুক্ত মনে হয়েছে।
নিশিতার ধারণা ছিলো হয়তো এবার ওর স্বামী ভালো হয়ে যাবে।কিন্তু না তাদের ভালোবাসায় কোন ফাটল ধরলো না, আরো যেন মনে হলো,আকর্ষণ আরো বেড়ে গেল।নিশিতা খুব অসহায় বোধ করতে লাগলো।আর এরই এক পর্যায়ে আবার ঝগড়া ঝাটি শুরু হয়ে গেলো।এবার নিশিতা মরিয়া হয়ে উঠল,আর সংসার নয়।এবার মুখোমুখি প্রতিবাদ।একদিন রাধাকে ডেকে বুঝালো” রাধা তুমি আমার সংসার ভেঙোনা,তোমার স্বামী বিদেশ থাকে,আমি তাকে জানালে তোমার সংসারও ভাঙবে।বলো কিভাবে সমাজে মুখ দেখাবে?তার চেয়ে এই ভালো, তুমি সরে যাও।”রাধাও সম্মতি দিলো ঠিক আছে,কিন্তু কদিন পরেই নিশিতা দেখলো ওর স্বামীকে সব বলে দিয়েছে।এবার ধৈর্যর বাধ ভেঙে গেল।একদিন সন্ধ্যায় যখন নিখিলেশ বাড়ীতে ছিল তখন রাধাকে ডেকে নিশিতা বলল তোমাকে আমি বারণ করেছিলাম,এ কথা কেন তুমি নিখিলেশ কে বলে দিলে?তখন রাধা বুঝাতে চাইল, বলেছি এই জন্য যে, দাদা যেন সরে যায়।নিশিতা বলল আমি তোমাকে সরতে বলেছি,ওকে নয়।এরপর রাধা সাফাই গাইতে শুরু করলে নিশিতা আর সহ্য করতে পারেনা,দমাদম কয়েকটা চড় মেরে দিল রাধাকে।এবার নিখিলেশ তার পৌরষত্ব দেখালো রাধার পক্ষে।তখনই নিশিতা সিদ্ধান্ত নেয় আর যাই হোক এ সংসারে আর নয়।
ওর ছেলেমেয়ে প্রতিষ্ঠিত। দুজনই বাইরে থাকে।সকালেই শূন্য হাতে নিশিতা বাড়ী থেকে বেরিয়ে এলো।এক কাপড়ে।একবারও ও পিছনে ফিরে তাকায়নি।যে বাড়ীর সাথে এত বছরের সম্পর্ক, নিজ হাতে তিল তিল করে গড়া শখের বাড়ীটার সাথে ওর দুরত্ব শুরু হয়ে গেল।ছেলের বাসায় এসে উঠল।ছেলেকে বলল আর পারলাম না বাবা।ছেলে বলেছে ভালো করেছো,এখানেই থাকো।

নিখিলেশ পাশ ফিরে শুলো।স্ত্রী বাড়ী থেকে বেরিয়ে যাবার পর ও আর ছেলে মেয়ের সাথেও যোগাযোগ রাখেনি।নিজের প্রেম নিয়েই মত্ত ছিল।কিন্তু হঠাৎ করেই ওর হার্ট এ্যাটাক হয়।তখন খবর পেয়ে ছেলে এসে তাকে নিয়ে ঢাকায় ইব্রাহীম কার্ডিয়াকে ভর্তি করে দেয়।ওখানে চিকিৎসা শেষ হলে সুস্থ হয়ে উঠলে ছেলে বলে বাড়ী চলে যাও।তখন নিখিলেশ বলে বাড়ীতে তো কেউ নেই।আমি একা থাকবো কি করে?তখন ছেলেমেয়ে এক সাথে সিদ্ধান্ত নেয় তাহলে তাকে বৃদ্ধাশ্রমে রাখা হোক।একথা শুনে নিখিলেশের বুকের ভিতরটা চিনচিন করে উঠে। সে আভাসে ইঙ্গিতে বুঝাতে চায় ওদের মা যেন বাড়ীতে ফিরে যায়।ছেলেমেয়ে অনড়।জন্মের পর থেকে দেখেছে ওদের মা কত কষ্ট করে ঐ সংসারে ছিল।আর সমস্ত খবরদারী করেছে ঐ রাধা।কিন্তু বাবা বলে কিছুই বলতে পারেনি।শুধু বলে আমাদের কিছুই বলার নেই বাবা।তোমারও টাকার অভাব নেই,আর লাগলে আমরাও দেব।তুমি বৃদ্ধাশ্রমেই যাও।তোমার ভালো হবে।বাবা আর কথা বলেনি।ছেলেমেয়ের সিদ্ধান্ত মেনে নেয়।
আজ এই বৃদ্ধাশ্রমের খাটে শুয়ে সেই যৌবন থেকে শুরু করে বার্ধক্য পর্যন্তু ছবির মত চোখের উপর ভাসতে থাকে।মনে পড়ছে নিখিলেশের কত অবহেলায় নিশিতা বাড়ী ছেড়েছিল।আহা আর একবার যদি নিশিতা ফিরে আসতো।স্ত্রীর মর্যাদা নিয়ে কপালে হাতটা রেখে বলতো”তোমার কষ্ট হচ্ছে কি?”চোখ দিয়ে ফোটা ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে,আর মনে হচ্ছে কি ভুলটাই না করেছি।আচ্ছা নিশিতাকে একবার আসতে বললে হয়না? কিন্তু সাহস পায়না ছেলেকে বলার।যার খোঁজ আজ দশ বছর নেয়নি সেই উপেক্ষিত মানুষটার কথা কিভাবে বলবে।
আকাশ পাতাল ভাবতে ভাবতে নিখিলেশ যেন পাগল হয়ে যায়।বুকে প্রচন্ড ব্যথা অনুভব করে।বুকটা যেন চেপে আসছে।শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে।আয়াকে ডাক দেয় নিখিলেশ।আয়া আসতেই ওর সমস্যার কথা জানায়,সাথে সাথে আয়া কতৃপক্ষকে জানায়।কতৃপক্ষ দ্রুত এ্যাম্বুলেন্স এনে হাসপাতালে নিয়ে যায়।ততক্ষণে নিখিলেশের ফর্সা মুখটা কালো হয়ে গেছে।অক্সিজেনেও শ্বাস নিতে পারছে না।আস্তে আস্তে নিস্তেজ হয়ে আসছে।ডাক্তার এসে নাভীতে ইঞ্জেকশন দেয়।কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই জগতের সকল মায়া কাটিয়ে নিখিলেশ তার স্থায়ী আবাসে রওয়ানা দেয়।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here