উনুন এবং ড্রয়ার
——————–
অ ল ক জা না
(এক)
যদি ভালোবাসতে না পারো তবে চিতা জ্বালাবে কিভাবে ? ভালোবাসা আসলে সেই পাঠ, যে কোন সম্পর্কের উৎস-মোহনার হদিস ও গতিপ্রকৃতি জানিয়ে দিতে পারে। শুধু তাই নয়, হয়ত দীর্ঘ সময় সহাবস্থানও হয়, আর এখান থেকেই একটু একটু করে কমতে থাকে পার্থিব মায়া। আর সেই শূন্যতার ভেতর জমতে থাকে খোলামকুচির মতো নিষ্ঠুরতা। তবেই না প্রিয়জনের মুখাগ্নি করা যায়। জীবন ভালোবেসে না চাইতে কতকিছুই মেনে নিতে হয়।
এক ঋতুতে কেউ আটকে থাকতে পারে কি ? আবর্তন রেখার গা ঘেঁষে নেমে আসে বৃষ্টিপাত। নেমে আসে গন গনে অগ্নিস্রাব রোদ। সবই এখন গা সওয়া। কারণ প্রাত্যহিক বেঁচে থাকার আধারে মৃত্যু এখন সহজলভ্য। শূন্যতা রাখতে, বাইরে ভেতরে জায়গার অভাব হয়না কখনো। প্রতিদিনই জ্বলে ওঠে প্রয়োজনের উনুন। গর্ভে ধারণ করে জ্বালানি। আসলে অনেক গুলো শরীর পুড়ে যাচ্ছে এক সঙ্গে। অনেক গুলো চিতা জ্বলে উঠছে একত্র।
কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের পরের অগ্নিজোট। জ্বলন্ত উনুন দেখলে কৃষ্ণের কথা মনে পড়ে খুব। একদা উনুন, আগুনের আঁচ খেতে খেতে নিষ্ঠুর হয়ে ওঠে। তখন তার কাছে সমগ্র পৃথিবী জ্বালানির মতো। প্রেম পরকীয়া সবই অজ্ঞতার অপরিণত বোকা বোকা কাহানী। কেবল পোড়ানো ছাড়া তার দ্বিতীয় কোন অভিসন্ধি নেই। এতকাল নিজে বিভিন্ন ভাবে পুড়েছে, এবার সুদেআসলে সমস্ত চিতা একত্র সাজানোর পালা।
সবাই তো প্রিয়জন। সবাই তো কোন না কোন ভাবে রক্তের সম্পর্কের আত্মীয় ছিল । প্রত্যেকের নাড়ির সঙ্গে জড়িয়ে ছিল ভালোবাসা ওতপ্রোত ভাবে। তবুও আগামী পৃথিবীর সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য শিক্ষা নীতিজ্ঞান ও আহার বিহারের জন্য পোষ্য আগুনের আধার হয়ে ওঠাকেই গ্রহণ করলেন সর্বংসহা কৃষ্ণ। এত পথ ছিল তবুও সামনে পেছনের সবকিছু জেনে বুঝে তিনি এক দেহেই ভালমন্দ, নায়ক খলনায়কের স্বভাব বয়ে বেড়ালেন। আসলে কৃষ্ণ খাঁটি প্রেমিক। তবেই না উনুনের মতো অশান্ত দহন সামলে প্রিয় মুখের ছাই বিকার বুকের অলিন্দে সঞ্চয় করতে পারেন ?
(দুই)
ঝড়ের সাহস হয়ত ছিল কিন্তু পৌঁছতে পারেনি। বহুভাবে আক্রান্তের ভাঙাচোরা ছবি সামনে পেছনে
পড়ে থাকলেও অটুট অবিচ্ছিন্ন থেকে গেছে প্রিয় সেই ড্রয়ার। কি আছে, কি থাকতে পারে ? বড়জোর দু চারটে ফেলে দেওয়া কলম, কাগজের টুকরো, ধুলোর আস্তরণ আর নেলকাটার। কিছু অচল খুচরো পয়সা থাকাও অসম্ভব নয়। এই সমস্ত জরুরি কিংবা অপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি নিয়ে এক নিটোল সম্পদের মতো অবিকৃত থেকেছে ড্রয়ার। দু একটা ছবিও ছিল, কিশোর বয়সের। আরো কিছু কিছু জিনিস থাকতেই পারে, ফেলে দেয়ার অঢেল সময় হয়ত ছিল অথচ এখানেই এক আলস্য ভূত ঘাড়ে চেপে বসে। তার জয় সর্বত্র, মানে না ফেলাই স্থির এবং নিশ্চিত হয়ে থাকল।
তারপর বয়ে যাচ্ছে সময়। যার ভেতর ভয় বিষাদ প্রণয় ভ্রম বিচ্ছেদ বর্ষিত হচ্ছে যার যেমন ললাট, সেই মাপে। জীবন চালাতে কতকিছুর না দরকার ?
আবার অনর্থকতায় বহু সময় অপচয় হয়ে যায়। এসবের হিসেব আবার হয় নাকি ? কিছু অনিচ্ছে অবজ্ঞায় থেকে গেছে, মুছে ফেলাও সহজসাধ্য নয় তবেই না তার নাম স্মৃতি অথবা অসফল স্বপ্নের মতো একটা ধূসরতা। ঠিক ড্রয়ারের আদলে থেকে গেছে মননে মজ্জায়, অন্তর্গত রক্তের জালকে ঝুলে থাকা কণিকার মতো।
বাতাস ছন্দ হারালে দুর্দান্ত ঝড়ের আকারে ফেরে। তখন মানুষ মারে ঘর ভাঙে উড়িয়ে নিয়ে যায় পুরনো জঞ্জাল। মগজের ভেতর থেকে যাওয়া অসমাপ্ত কথারা সহমরণেই সুখ ভেবে চিরদিনের জন্য চুপ থেকে যায়। এ ঘরটির ছাউনি উড়ে গেছে। এলোমেলো সাংসারিক তৈজসপত্রের সঙ্গে একাকার চেয়ার টেবিল। উলটে পড়ে আছে টেবিল। কিন্তু তার সেই মগজ ড্রয়ারটি মৃত মানুষের মাথার মতো চিরন্তন ইচ্ছে নিয়ে অনিবার্য অটুট। কি সাধ্য ঝড়ের, ড্রয়ারের অন্তর খুবলে নেবে ? কি সাধ্য ঝড়ের, মাথার ভেতরকার মিঠেকড়া অম্লমধুর স্মৃতি ছিনিয়ে নিয়ে যায় ?
সেই সব নিবিড়তা। সেই আলাভোলা বালখিল্য সময়। অসফল স্মৃতি স্বপ্ন বয়ে বেড়ানো সহজাত গুণ বটে। এখনো থেকে গেছে সেভাবেই ড্রয়ার সঞ্চয়ের মতো মগজের ভেতর হয়ত একটা নির্জীব গ্রহ। যার উত্তরাধিকার কেবল মাটি কিংবা আগুন।