কলমযোদ্ধা আওলিয়া খানমের এর জীবন ঘনিষ্ঠ গল্প “ওরা তিনজন ”

634
কলমযোদ্ধা আওলিয়া খানমের এর জীবন ঘনিষ্ঠ গল্প “ওরা তিনজন ”

ওরা তিনজন

—আওলিয়া খানম

ওরা তিনজন ফ্লাটবাড়ীর সিড়ি ছাদ সামনের খালি জায়গাটুকু পরিস্কার করে। আজকাল প্রতিদিন আসেনা। সপ্তাহে চারদিন আসে। তারা আমেনা ইয়াসমিন ও খোদেজা । তবে এরা বেশ ভাল আছে । এরা মাসের বেতনও পাচ্ছে আবার কিছু ত্রানও পাচ্ছে ।ওদের তিনজনের স্বামীই রিক্সাচালক । অফিস স্কল কলেজ সব বন্ধ থাকাতে ওরা রিক্সা চালিয়ে তেমন একটা সুবিধা করতে পারছেনা।
বিক্সার জমাই তুলতে পারেনা। তাই আজকাল মাঝে মধ্যেই রিক্সা নিয়ে বের হয়না। এই তিনটি পরিবারই একসাথে থাকে পাশাপাশি ওদের ঘর। ওদের সবারই একটি করে ঘর ও বারান্দা আর মিলিতভাবে হচ্ছে রান্নাঘর। একচুলা দুই পরিবার গোসলখানা ও ল্যট্রিনও ঐ একই নিয়মে ।
বাসায় যারা কাজ করে তাদের অনেকেই আজকাল নিয়মিত যাচ্ছেনা। অনেকেই আবার বাসার মালিকেরা এপ্রিল মাস থেকে ছাড়িয়ে দিয়েছে ।কাজও করাবেনা বেতনও দিতে হবেনা।
ঝাড়ু দেয়া সিড়ি মোছার ফাঁকে ওরা তিনজনই বসে গল্প করে আর বলে , যাক যারা বাসায় ছুটা কাজ করে তাদের থেকে অন্ততঃ আমরা ভাল আছি । ইয়াসমিন বলে, আরে আমরাতো আর বাসার ভেতরে যাইনা,তাইতো আমাদের কাজ ছাড়িয়ে দেয়নি।
খোদেজা বললো, আসলেই তা নয় বাড়ীর সিড়ি উঠান গাড়ীবারান্দা এসব পরিস্কার কে করবে। বেগম সাহেবরাতো নিজেদের ঘরই পরিস্কার রাখতে নিশ্চয় হিমশিম খাচ্ছে। তাই আমাদের কাজ আছে ।আমেনা বললো, ভাগ্যিস আমরা বাসায় কাজ করিনাই। সাথে খোদেজা যোগ করলো,না কইরা ভালই আছি । বাসার কাজে বেগম সাবেরা বড় বেশী প্যনপ্যানানীকরে। এমনে না ওমনে। কিছুতে্ই্ তাদের পছন্দ হয়না, আবার আমাদের ছাড়া তাদের চলেও না।
ইয়াসমিন বলে হ ঠিকই কইছস, নিজেরা পারেনা কিছু কাম কাজ,তা আবার আমাদেরকে শিখাইতে আসে।
রোজার দিন দুপুর গড়াতেই ওদের কাজ শেষ হয়ে যায় । ওরা সব গুছিয়ে ম্যানেজারকে বলে চলে যায় ।
ইয়সমিন একটু কমবয়সী,তাই ও একটু বেশী পটরপটর করে,বলে ম্যনেজার সাব ,এই ঈদে আমাগো বোনাস দিবেন না। দোকান বাজার বন্ধ কেওতো কোন কাপড় চোপরও দিলোনা।
ম্যনেজ্যার খেঁকিয়ে উঠে বলে এত প্যট প্যাট করিস কেন।দেওয়ার সময় দেব ।কাপড় চোপড় কে দেবে না দেবে তার আমি কি জানি।
তোরা চাইযা নে।
আহা ম্যানেজ্যার সাব এইটা কি কইলেন,এই করোনার কালে আমরা বুঝি বাসায় যামু। বাসায় কাজ করুইন্যা বুয়াদেরই কেও আসতে দেয়না,আর আমরা যাই বকা খাইতে ।
আমাগো মাথা খারাপ হয় নাই ।
আইচ্ছা এখন যা, দেখি আমি কি করতে পারি।
ওরা তিনজন পাশাপাশি বস্তিঘরেই থাকে ।ইয়াসমিনের দুই ছেলে আর শ্বাশুড়ী ও দেবর নিয়ে সংসার । দেবরটি রাজমিস্ত্রিরি যোগালীর কাজ করতো। এখন কাজ নেই ।তাই ঘরের ছোট বারান্দাটায় দুই হাটুর মাঝখানে মুখ রেখে চিন্তায় অস্থির। কবে যে কাজ শুরু হবে ,লকডাউন যাবে । ইয়াসমিনের স্বামীও মাটিকাটার কাজ করে । সেটাও বন্ধ ।
শ্বাশুড়ীর কাছে ইয়াসমিনের এখন অনেক মূল্য । বিষয়টা ইয়াসমিন বুঝে।আগে কাজ থেকে যাওয়া আসার সময় খেয়ালই করতো না। এখন তেমনটি নয় । আসার সাথে সাথেই বলে বও আইছস গা হাত ধূইয়া চাইট্টা খাইযা নে। ভাত রানছি আর লগে ডিম আলুর তরকারী । যা খাইয়া নে।সেই সকালে গেছস । তখন ইয়fসমিন বলে আম্মা আমি আর আপনে না রোজা রাখছি ।
আরে হ তাইতো,আমি ভূইল্যাই গেছি । বয়স হইছেনা, সব কথা সব সময় মনে থাকেনা। ।আম্মা আপনি ভূইল্যা গিয়া রোজা ভাইঙ্গা ফেলেন নাইতো । ওর শ্বাশুড়ী বললো আরে না্, রোজা আবার কেও ভূইল্যা যায় ।না আমারটা ভুইল্যা গেলেনগাতো তাই আপনেরে জিগাইলাম ।
আমেনার আছে দুটা ছোট ছোট ছেলে ।ওরা বাসার সামনে একটা খালি জায়গা আছে সারাদিন ওখানেই খেলে সময় পার করে। আমিনা ঘরে ঢুকার আগেই ওরা বলে উঠে মা আইছে।মা আইছে ! আইজ কি খাওয়াবা মা ।বড় ছেলেটা বয়স দশ বছর ।ও বলে মা এট্টু খিচুরী খাইতে মন চাইছে। আমেনা বললো, কি দিয়া রানমু রে বাপ ঘরে তেল নাই মশলা নাই কি দিয়া খিচুরী রানমু।
মা শুধু লবন দিয়া ডাল চাল একসাথে সিদ্ধ কইরা দাও ।
আমেনা মনে মনে ভাবলো আহারে সে কি করবে?এর বাপটা যে ক্ই গেছে।
আমেনা বড় ছেলে ফুয়াদকে জিজ্ঞাসা করলো,এই তর বাপ কি গাড়ী লইয়া বাইরইছে। ফুয়াদ বললো ,হ মা বাইরইছে । বাবায় কইয়া গেছে তর মারে কইছ খিচুরী রানতে।
আইচ্ছা আইচ্ছা রান্দুম।
আমেনা ডাল চাল ধুয়ে আদা রসুন পিয়াজ হলুদ কাচামরিচ দিয়ে চুলায় চাপিয়ে দিলো সেদ্ধ হওয়ার পর একটু তেল পেয়াজ ভেজে উপর দিয়ে দিয়ে দিলেই খুব ভাল খিচুড়ী হয়ে যাবে । অন্য একটি চুলায় ডিম আলু সেদ্ধ দিয়ে দিলো । দু একটা সবজি ছিল ওসবও কেটে দিয়ে দিলো ।এখন এটা সবজি খিচুরী হযে গেল। ছোট ছেলেটার বয়স সাত বছর সেও এসে দেখে গেছে।চোখে মুখে খুশীর আভা ।ওদের বাপও এসে পরেছে ঢুকতে ঢুকতে বলছে কি দিন আই্রলো একটা খেপ পাওয়া যায়না ।
আমেনা বললো, কেমনে পাইবা , ইশকুল বন্ধ কলেজ বন্ধ পোলাপানরে মা নিয়া ইশকুলে যাইতো কোচিংএ যাইতো ,তয় রিসকা ভালা চলতো । রাহেলার স্বামী বলে তাও ভাল তর কামডা আছে ।
আরে আরো খবর আছে।
আমেনা উত্তরে বললো কি খবর? শোন, আমাগো বস্তিতে কয়ডা ঘর আছে গুইন্যা নিয়া গেছে । সাহায্য দিবো্ । কি কও!সত্য কইতাছি। কাইল পরশুর মধ্যে পাইয়া যামু। আমিনা দুইহাত তুলে উপরে তাকিয়ে বললো,আল্রাহ তুমি আমাগো দিকে মুখ তুইল্ল্যা চাইছো । আমিন ! ।
এই খবর শুনে সাথে সাথেই সে খোদেজা ও ইয়াসমিনকে ডেকে বললো,তোমরা শুনছো আমাগো ঘর নাকি গুইন্যা নিয়া গেছে ত্রান দিবো। ইয়সমির বললো,হ শুনছি, কি আর দিবো ,চাইল ডাইল আলূই দিবো মাছ গোছ তো আর দিবোনা।
খোদেজা বললো, তুই একটা বোকার হদ্দ। ত্রান কি মাছ গোছ দেয় । চাইল ডাইলই দেয় । শোন তাওতো কিছুডা পাইলাম । নাইমামার চেয়ে কানামামাই ভালা
এভাবেই তাদের দিন যাচ্ছে । আবার সামনে আসছে কোরবানীর ঈদ।তারা এটি নিয়েও আলোচনায় মেতে উঠে ।
ইয়াসমিনই বেশী কথা বলে। আইচ্ছা আমেনা বু,এইবার বড়লোকেরা কোরবানী কেমনে দিবো।
এইটা নিয়া তোর এত চিন্তা কেন?
এইটা কি কইলা বু তুমি।চিন্তা থাকবোনা।
পঞ্চাশটা ফেলাট থেইক্যা হগলতেই আমাগোরে গোস্ত দেয় ।বাসায় বুয়াগোর থেইক্যা আমডাই বেশী গোস্ত পাই।
তো চিন্তা করুমনা।
হেই গোস্ত কতদিন ধইরা খাই। পোলাপানডি থুশীতে নাচতে থাকে । আমার বড় পোলায় কয় ,মা কোরবানী বছরে কয়েকবার হইলে কত ভালা হইতো ।
এতক্ষন আমেনা চুপ করে বসেছিল।বললো,ইয়াসমিন তুই পারছও।তোর মুখটা সারাদিন বন্ধ হয়না।
এভাবেই কাটছে ওদের তিনজনের দিনরাত্রি।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here