“মাতৃত্বের স্বাদ ” ভিন্ন ধারার –অনু গল্পটি সৃষ্টিশীল লেখনির আলোয় আলোকিত করেছেন ভারতের লেখক ও কবি সুতপা দাস ।

1033
“মাতৃত্বের স্বাদ ” ভিন্ন ধারার –অনু গল্পটি সৃষ্টিশীল লেখনির আলোয় আলোকিত করেছেন ভারতের লেখক ও কবি সুতপা দাস ।
লেখনির আলোয় আলোকিত করেছেন ভারতের লেখক ও কবি সুতপা দাস

মাতৃত্বের স্বাদ

                      সুতপা দাস

বাড়ি ভর্তি আত্মীয় স্বজন সবাই ব‍্যস্ত,কেউ নিজেকে নিয়ে কেউ দায়িত্ব পালনে। আজ যে তাতান প্রথম অন্ন মুখে নেবে তাতানের মামার হাতে! সুজাতা আর অপূর্ব ও এসেছে পুনে থেকে।সুজাতার একমাত্র দেওরের ছেলের অন্নপ্রাশন বলে কথা,একমাত্র বংশধর ও বটে।না এলে হয়!তাছাড়া সুজাতা বাড়ির বড়ো বৌ ,একটা দায়িত্ব ও তো আছে।

অপূর্বরা দুভাই আর একবোন।অপূর্বই সবার বড়।বাবা ছিলেন একজন প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক।অপূর্ব যখন ফাস্ট ইয়ারে পড়ে তখনই তিনি রিটায়ার্ড করেন তার ছয় মাসের মধ‍্যেই,হঠাৎ একদিন রাতে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে ইহলোক ত‍্যাগ করেন ।ছোট ভাই বোন ,সংসারের সমস্ত দায়িত্ব অপূর্ব র ওপর এসে পরে।পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যায়। বাবার পেনশনের ঐ কটা টাকায় সংসার চলে কি করে!

দুর সম্পর্কের এক আত্মীয়ের চেষ্টায় অপূর্ব একদিন চলে আসে পুনে আর একটা প্রাইভেট কোম্পনিতে কাজও পেয়ে যায়।এরপর থেকে শুরু হয় জীবন সংগ্ৰাম।
ছোট ভাইও বোনের পড়াশোনার খরচা সংসারের খরচা সব একাই সামলাতে হয়েছে। এসব সুজাতা অপূর্ব র মুখে শুনেছে বিয়ের পর।

বিয়ের আটটি বছর পেরিয়ে গেছে কিন্তু ভগবান মুখ তুলে চাননি সুজাতার দিকে তাই আজও সুজাতার কোল খালি। অনেক ডাক্তার, কবিরাজ দেখিয়েছে অপূর্ব সাধ‍্য অনুযায়ী। যেদিন সুজাতা জানতে পারে যে সে আর কোনদিনই মা হতে পারবেনা গর্ভধারণের ক্ষমতাই নেই সুজাতার, সেদিন
সুজাতা অপূর্ব র বুকে মুখ লুকিয়ে সারারাত
কেঁদেছে। অপূর্ব অবশ্য নিজের মনের কষ্ট লুকিয়ে স্ত্রীকে স্বান্তনা দিয়েছিল। কেঁদোনা তুমি ,এমন তো অনেক দম্পতি আছে যাদের সন্তান নেই?
আমরা না হয় একটা বাচ্চা এডপ্ট করে (adopt)নেবো ।
কাঁদতে কাঁদতে ই সুজাতা বলেছিল আমি হতভাগী ,তোমাকে কোনদিনই পিতৃ সুখ দিতে পারবোনা।
দুজনেই সেদিন দীর্ঘশ্বাস ফেলেছিল
আর অল‍ক্ষ‍্যেভগবান হেসেছিলেন।

সন্তান হলো স্বামী আর স্ত্রীর ভালোবাসার মধ‍্যে সুন্দর এবং মজবুত সেতুর বন্ধন।সন্তানের মাধ‍্যমেই দাম্পত্য জীবন পূর্ণতা পায়। নাহলে উভয়ের মনেই চাপ সৃষ্টি হয়,আর এই কারনেই হয়ত
অপূর্ব আজকাল কেমন যেন একটু উদাসীন সব ব‍্যপারে! সুজাতাকে সেই শূন‍্যতা আজও কুঁড়ে কুঁড়ে খায়।অপূর্ব র সাধ‍্যের বাইরে গিয়ে ট্রিটমেন্ট করানোর ক্ষমতাও
ছিলো না ।তা না হলে আজকের দিনে অর্থ
থাকলে কি না হয়!মেডিক্যাল সাইন্স কতো উন্নতি করেছে! নিজের অসামর্থ‍্যতা লুকাতেই হয়তো পালিয়ে বেড়েছে, সুজাতা বোঝে তাই আর কিছু বলেনা।

এই বন্ধাত্বের জন‍্য শাশুড়ির কাছেও কম কথা শুনতে হয়নি সুজাতাকে!
আমার ছেলের জীবনটা নষ্ট হয়ে গেলো এই বাজা মেয়েটার জন‍্যে।আমার হয়তো আর বংশধরের মুখ দেখা হলোনা আরো অনেক কথা।সেসব মনে হলে সুজাতা আজও কাঁদে লুকিয়ে লুকিয়ে।

এরমাঝে ননদ বর্ষারও বিয়ে দিয়েছে ভালো ঘরে। বর্ষার স্বামীও স্কুল টিচার ।সমীর আর বর্ষার একটা ফুটফুটে মেয়েও হয়েছে।মুখে কিছু না বললেও মেয়েকে সুজাতার কাছে খুব একটা ঘেসতে দেয়না বর্ষা।সুজাতা সবই বোঝে।

ছোট ছেলে চঞ্চল যখন ব‍্যঙ্কের চাকরিটা পেয়ে গেলো তখন সুজাতার শাশুড়ি ছোট ছেলের বিয়ের জন‍্যে উঠে পড়ে লাগলেন।ঠিক সময়ে চঞ্চল আর দীপার ও বিয়ে হয়ে গেলো গত বছর ফাল্গুন মাসে।দের বছরের মাথায় দীপার কোল আলো করে তাতান এলো।বাড়ির সবাই খুব খুশি।শাশুড়ি ফোন করে জানিয়েছিলেন খবরটা বড়ো বৌকে। আজ আমার ইচ্ছে পূরণ হলো বুঝলে বৌমা।অবশেষে বংশ রক্ষা করলো দীপা।
বংশ প্রদীপ এলো ঘরে।
কথাটা যে উনি সুজাতাকে খোঁচা দিয়েই বলেছিলেন বুঝতে অসুবিধা হয়নি সুজাতার সেদিন একটুও।

আজ সেই সবার চোখের মণি,তাতানের অন্নপ্রাশন।বাড়িতে এতো লোকজন দেখে তাতান কিছুতেই
চুপ থাকছে না ,কেবলই কাঁদছে।দীপাকেও
ছাড়ছেনা।কেউ বলছে খিদে পেয়েছে মনে হয়,কেউ বলছে ঘুম পেয়েছে একটু নাহয় ঘুম পাড়িয়ে দাও।দীপা তাতানকে ঘরে নিয়ে
গিয়ে ব্রেস্ট ফিড দিয়ে ঘুম পারিয়ে দিয়ে–
সুজাতাকে ডেকে বললো দিদি ,তুমি তো এখানেই আছো তাতান যদি উঠে পরে একটু দেখো।আমাকে কেন ডাকছে দেখে আসি।

–ঠিক আছে তুই যা আমি দেখবো।
দীপা চলে গেল।
মিনিট পনেরো পরেই তাতান উঠে কাঁদতে লাগলো।
আশেপাশে কেউ নেই, দীপাও আসছেনা দেখে সুজাতাই তাতানকে কোলে তুলে নিয়ে ঘরের বাইরে বেড়িয়ে এলো।
তাতান চুপ করেও গেল, কিন্তু হঠাৎ কাকীমা শাশুড়ি সুজাতার কোলে তাতানকে দেখেই বলে উঠলেন—
—–দীপা কোথায়?তুমি কেন আবার কোলে নিতে গেলে বাছা?
—-না,মানে ও ঘুম থেকে উঠে আবার কান্না শুরু করে দিয়েছিল কাউকে দেখতে না পেয়ে ,তাই নিয়েছি।
——-কাউকে তো ডাকলেই পারতে বাছা,আজ একটা শুভ দিন বলেই হঠাৎ থেমে গেলেন।
সুজাতার বুঝতে একটুও অসুবিধা হলোনা কেন কাকীমা শাশুড়ি এমনটি বললেন বা কি ইংগিত করতে চাইলেন।
দুঃখে ,অভিমানে বুকটা ভেঙ্গে গেলো যেন।
তাতান তো এ বাড়ির ই ছেলে!তবে তাতান কি সুজাতার কিছুই হয় না!
এমন সময় শান্তিলতা দেবী মানে সুজাতার শাশুড়িও এসে হাজির হলেন ।ছোট জাকে জিজ্ঞেস করলেন কি হয়েছে রে ছোট? জায়ের মুখে সব শুনে উনিও শুরু হয়ে গেলেন—-বলিহারি আক্কেল তোমার বৌমা,এই শুভ দিনে—–
বাকিটা শোনার আগেই সুজাতা নিজের ঘরে গিয়ে বিছানায় পরে কাঁদতে লাগলো।
আর বাইরে বেড়োয় নি সারাদিন।

অনুষ্টান মিটে গেলে অপূর্ব সুজাতাকে নিয়ে ফিরে এলো পুনেতে।আসার সময় অবশ‍্য দীপা আড়ালে বড়ো জাকে বলেছিল–
দিদি তুমি এদের কথা মনে রেখোনা,যুগ পাল্টিয়ে গেছে কিন্তু এনাদের মানসিকতা
পাল্টায়নি।তাতান যেমন আমার ছেলে তেমনি তোমার ও ছেলে।ছোট জায়ের কথায় চোখে জল এসে গিয়েছিল সুজাতার,জড়িয়ে ধরেছিল দীপাকে ।

পুনেতে ফিরে আসার প্রায়— চার পাঁচ দিন পর ,একদিন ভোরে হঠাৎ বাচ্চার কান্নার আওয়াজ শুনে সুজাতার ঘুম ভেঙে যায়! অপূর্ব কে ডেকে বলে –শুনতে পাচ্ছো, মনে হচ্ছে আমাদের দরজার কাছে কোন বাচ্চা কাঁদছে?
–দুদিন হলো বাড়ি থেকে এসেছ, আসলে তাতানের কান্না শুনে শুনে এমন হয়েছে যে ঘুমের ঘোরেও তা শুনতে পাচ্ছ। কেউ কাঁদছেনা ,আমাকে ঘুমোতে দাও,বলেই পাশ ফিরে শুলো অপূর্ব!
সুজাতার বারবারই মনে হচ্ছে না দরজার কাছ থেকেই আসছে কান্নার আওয়াজ!
আর শুয়ে থাকতে না পেরে উঠে এলো।তখনো ভোরের আলো ঠিক করে ফোটেনি।
আওয়াজটা কোথা থেকে আসছে বোঝার চেষ্টা করলো।নাঃ দরজার দিক থেকেই আসছে!
আস্তে আস্তে দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো , ভয়ে ভয়ে দরজা খুলতেই দেখে সিড়িতে একটি সদ‍্যজাত শিশু পরে আছে আর কেঁদেই যাচ্ছে! এদিক ওদিকে তাকিয়ে দেখলো ,কোথা থেকে এলো ?আর কেইবা রেখে গেলো?ভয় ও হলো!কাউকে দেখতে না পেয়ে ক্ষণকাল বিলম্ব না করে সুজাতা শিশুটিকে দুহাতে তুলে নিয়ে বুকে চেপে ধরলো ,আর এক পরম তৃপ্তির অনুভূতি হলো !শিশুটিও যেন নিরাপদ আশ্রয় পেয়ে চুপ করে গেলো! আকাশের দিকে তাকিয়ে সুজাতা মনে মনে ভগবানকে ধন্যবাদ জানালো ,যদি এ আর্শীবাদই দিলে প্রভু তবে কোনদিন কেঁড়ে নিওনা ,আর চোখ থেকে বেরিয়ে এলো এতদিনের আকাঙ্খিত পরম তৃপ্তিতে ভরা, মাতৃত্বের স্বাদের অশ্রু ধারা।।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here