স্মার্টফোনই নিলো প্রাণ
নাসরীণ জাহান রীণা
লক্ষ্মীদেবীর গৃহে আজ অলক্ষ্মীর নজর পড়েছে। সারাদিনমান ঘুরেও হাঁড়িতে দেয়ার মতো কিছুই যোগাড় হলো না। বাচ্চা তিনটেকে কি দিয়ে বুঝ দেবে ভেবে কুল পাচ্ছে না। কয়েকদিন থেকেই কোনদিন একটু শাকপাতা, কোনদিন লবন-মরিচ আর কোন কোনদিন শুধু ডাল ছাড়া কিছুই পাতে দিতে পারছেনা। বড় মেয়ে দু’টোকে যা একটু বুঝিয়ে সুজিয়ে পেঁয়াজ দু’এক টুকরো পাতে দিলেও তারা গোগ্রাসে পাতের কিঞ্চিৎ ভাতটুকু খেয়ে নিচ্ছে। কিন্তু ছেলে গোপাল তা মোটেই মানছেনা। বাবা-মা’কে শর্ত দিছে,মাছ ছাড়া ভাত মুখেই তুলবে না। পুঁটি আর পুতি আধপেটা খেতে খেতে শরীরটাকে জ্বালানির মতো যেনো চেলাকাঠ শুকোচ্ছে। কি আর করবে? মায়ের মুখের দিকে তাকালেই বুঝতে পারে মা লক্ষ্মীর ভাণ্ডারে যে এই পেটে ছানি দেয়ার মতো চারটে ভাত জুটেছে তাও ঢের। মেয়েদের বিধাতা এই এক ধৈর্য্যের চাক দিয়ে তৈরি করেছে তারা যেই বয়সেরই হোক যে কোন পরিবেশে নিজেকে খুব মানিয়ে নেয়ার চেষ্টা করে। মানাতে মানাতে কখনও কতো ঠকের নিচে চাপা পড়তে হয় ; তবু তারা ঠেলে উঠতে জানে না।
লক্ষ্মীদেবীও কম মানাননি নিজেকে। ভাগ্য করে দিনমজুর স্বামীর ঘরে এসেছে। আর আসার পর থেকেই মানিয়েই যাচ্ছে। নিজের জমির কিছু ধান আসে ঘরে সুনীলের ; তাতেই পাঁচকপাল। নইলেতো ভুখাই থাকতে হতো। ঘরের ভাতটুকুই আসল বল। পাশের ঘরের গীরিবালার তাওতো নেই। গীরিবালা প্রায়ই বলে —
———দিদি তুমি সত্যিই লক্ষ্মী। তোমার ঘরে ভাত আছে। ঘরে ভাত থাকলে লবন দিঅ খাওন যায়।
—— হ বইন, তাও রক্ষে। নইলে পোলাপাইন লই কোনদিকে যাইতাম ; কি কইত্তাম ?
মাঝে মাঝে কিছু চাল বাড়িয়ে দেয় ভাতে। গিরিবালার পোলাপাইন গুলোর মুখের দিকে তাকান যায় না। তাই লক্ষ্মী ভাত দেয়। নিজের রান্না করা যা থাকে একটু তরকারি ঝোলও দেয়। লক্ষ্মীর সংসারও তাদের আশীর্বাদ কিংবা স্বয়ং লক্ষ্মীর কৃপায় ভালই চলছিল। ঘরে চাল আছে। আর বাকী খরচ বহনে স্বামী সুনীলের সাথে লক্ষ্মীদেবীও গতরখান খাটায়।
মধ্যবিত্ত বাবার আদরের মেয়ে লক্ষ্মী। গায়ের রং একটু কালো ছিলো বলেই একটু নিচু ঘরে বিয়ে দিতে হলো। কিন্তু বাবার কাছে লক্ষ্মী ছিলো লক্ষ্মীর মতোই। এমন কোন আবদার নাই যা বাবা রাখতো না। বাবা বলতো,
” তুই যদি আমায় আকাশের চাঁদ পাইড়া দিতে বলস তাও আমি চেষ্টা করুম। ”
সুনীল ছেলেটা সৎ ছিল আর গায়ের রঙও ফর্সা। তাই লক্ষ্মীর বাবাও ছেলে দেখেই এক বাক্যেই সমন্ধ পেয়ে রাজী হয়ে গেছিল। লক্ষ্মীর গায়ের রঙ একটু কালো হলেও মায়ার গড়ন ছিলো।
বিয়ের পর সুনীলের সংসারে এসে শ্বশুর-শাশুড়ি আর এক ননদকে পায় সে। রান্নাবান্না ঘর গৃহস্থালীর কাজে পাকা ছিলো। ননদ কাননের বিয়েথা তার হাতেই দেয়। শ্বশুর-শাশুড়িও তার সেবাযত্নে মুগ্ধ ছিলো। স্বামীর সাথে ধান থেকে চাল করে বাজারে বিক্রি করার কাজেও সাহায্য করতো লক্ষ্মী। সুনীল দিনমজুরের ফাঁকে ফাঁকে নারিকেল-সুপারির ব্যবসা করতো। লক্ষ্মী গৃহে থেকে নকশীকাঁথা সেলাই করতো, মুর্তা দিয়ে শিতলপাটি বানানোর কাজ করতো। এসব ছিলো লক্ষ্মী-সুনীলের পারিবারিক বাড়তি আয়।
মোটামুটি সাচ্ছন্দেই তাদের সংসার চলছিলো। গেলো বছর সুনীলের বাবা মারা যাওয়ায় সে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। বাবারা যে মাথার ছাতা হয় ; বটবৃক্ষ হয় সুনীল তা হাড়ে হাড়ে টের পেলো। বাবার মৃত্যুর পর থেকেই শারিরীকভাবেও তাই দুমড়ে মুচড়ে পড়ছিলো। আগের মতো কাজে যেতে পারছে না। একদিন কাজ করলে তিনদিন বিছানায় পড়ে থাকতে হয়। এদিকে ছেলেমেয়েরাও বড় হচ্ছে। খিদা বাড়ছে, পোশাক-আশাকের চাহিদা বাড়ছে। বড়মেয়ে পুঁটি দশম শ্রেণিতে পড়ে। তার স্কুলের খরচ,প্রাইভেট পড়ার খরচ। ছোট মেয়ের একটি কঠিন বিমার আছে। তার চিকিৎসা খরচ। সব মিলিয়ে সংসার সামলাতে সুনীলের এখন মাথায় হাত।
লক্ষ্মীদেবী আজ কচুরছড়ার সন্ধানেই টুকরি আর নিড়ানি হাতে করে বেরিয়েছে। কারন,সে জানতো ছাড়াবাড়ির তালপুকুরের কলমিলতা বেশ কিছুদিন ধরেই আশপাশের আট পরিবারের কুলবধুর দ্বারা সাবাড় হয়েছে। আর কচুর লতির কথা কি আর বলবো, সেতো কুলবধুরা ভুমিষ্ট হওয়ার জন্য অপেক্ষায় থাকে। কে কার আগে গিয়ে নার কাটতে পারে। তাই আজ লক্ষ্মী এটাই স্থির করলো যে,কচুর ছড়াই আসল সম্বল। কিন্তু এটাও তার একার ভাবনা হয় কি করে? সবার ঘরেই এখন টানাটানি। কি এক অদৃশ্য অসুখ আসলো দুনিয়াতে। করোনা’ নাকি তার নাম। লক্ষ্মীর ঘরে একেতো আকাল আরো দেশে করোনার ক্রান্তিকাল। সুনীলের কাজ বন্ধ।ছেলেমেয়েদের স্কুল বন্ধ। লক্ষ্মীর হাঁড়িতে আগুন জ্বালাও প্রায় বন্ধ। কয়েকটা কচুরছড়া টুকরির তলায় করে নিয়ে এসে লক্ষ্মী রান্নাঘরে মাটিতে বসে হাঁপায়। আর নিজে নিজে বকতে থাকে।
———– আর পারছি না। জীবনটা আমার গেলো তোমার সংসারে খাটতে খাটতে। এই সংসারে আইছি পর্যন্ত খাটতেছি গাধার মতন তবু শান্তির দেখা পাইলাম না। যেই লক্ষ্মী আমি বাপের বাড়িত কুটাটি পর্যন্ত নাড়িনি তার আইজ এই দশা। না পাই ঠিকমতন খাইতে না পাই পরতে। তুমি আমারে বান্দি পাইছো? নিজে ঘরে শুইয়া থাকবা আর আমার হইছে মরণ। পোলামাইয়া তো আমার কাছে খাওন চায়। সারাদিন শুইয়া শুইয়া আরাম করবা আর সময়মতো খাওন চাইবা।
সুনীল পরিবারের অনটনের কথা চিন্তা করতে করতে রাতে ঠিকমতো ঘুমাতে পারে না। মাঝে মাঝে বুকে চিন চিন ব্যথা অনুভব করে। কিন্তু কাউকে বলতে পারে না। ডাক্তারের কাছেও যাওয়ার যোগাড় নেই। হাতে টাকা-পয়সাও নেই। এদিকে করোনার কারনে সবদিকে লকডাউন ।
স্ত্রীর এতক্ষণের কথাগুলো তার কানে কাঁসার মতো বাজলো। কিন্তু কিছুই বলতে পারলো না। শুধু নিরবে চোখের জল ফেলা আর দীর্ঘশ্বাস ছাড়া আর কিইবা করার আছে।
মাঝে মাঝে সুনীলের আর বাঁচতে ইচ্ছে করে না। একদিকে পারিবারিক অনটন,নিজের অসুস্থতা, স্ত্রীর বকাঝকা তার উপর পুঁটি’র জন্য মোবাইল কিনতে হবে। চিন্তায় চিন্তায় মাথাটা ভোঁ ভোঁ করে তার। দম বন্ধ হয়ে আসতে চায়। তবু দমটা বেরিয়ে যায় না কেন তার, তাই ভাবে। শেষ সম্বল গরুটি বিক্রি করে সেদিন কিছু টাকা দিয়ে ঘরের জন্য কিছু খাবার আনে। নিজের ব্যথা দমিয়ে রাখতে কিছু ওষুধ আনে। আর কিছু টাকা রেখে দেয় পুঁটি’র জন্য একটা মোবাইল কিনবে।
সকাল সকাল একটু পানতা খেয়ে বেরিয়ে পড়ে মোবাইল কিনার উদ্দেশ্যে। পুঁটি’র স্কুলের সবার মোবাইল আছে। অনলাইন না কি যেনো, ওটাতে নাকি কেলাস হয়। করোনার জন্য স্কুল বন্ধ বলে। বেশকিছুদিন থেকেই পুঁটি বাবাকে ফোনের কথা বলেই যাচ্ছে। এখনও পর্যন্ত বিহিতব্যবস্থা কিছু হচ্ছে না। পুঁটি’র মাও কি লক্ষ্মী থেকে অলক্ষ্মীর মুর্তি কিছু কম হচ্ছে ?
যাইহোক আজ দেখি কিছু করা যায় কিনা, সুনীল ভাবে।
বাজারে গিয়ে একটা মোবাইল কিনে দ্রুত বাড়ি ফিরে। যাহোক আজতো অন্তত জ্বলন্ত আগুনে কিছুটা হলেও জল পড়বে।
ডেড বডিটা ঝুলন্ত অবস্থা থেকে নিচে নামিয়ে আনে আইনের লোক। সারা বাড়ি শোকের মাতম। স্ত্রী-কণ্যা মূর্ছা যায় বারবার। কি হতে কি হয়ে গেলো। লক্ষ্মীদেবী কপাল চাপড়ায়। ঘরের পালায় মাথা বাড়ি মারে আর চিৎকার দিয়ে বলে,
——এ আমি কি করলাম, কেন এতো বকলাম! স্মার্টফোন আনে নাই দেখে কেন এতো রাগ করলাম? ওরে তোরা আমার স্বামীকে এনে দে। আমি সইতে পারছি না। আমি নিজেকে ক্ষমা করতে পারছি না। আমিই দোষী ; আমিই খুনী।
পুঁটি সুনীলের লাশ জড়িয়ে বিলাপ করে।
” ও বাবাগো কেন আমি স্মার্টফোনের জন্য তোমায় এতো কথা বললাম ? কেন সবার সাথে তুলনা করতে গেলাম? কেন বললাম, সবাইকে স্মার্টফোন কিনে দিয়েছে তাদের বাবা। তুমিই পার না। কেন বলতে গেলাম, কেন ?
এ সব স্মার্টফোনের জন্য ; সব করোনা’র জন্য। আমার বাবা নেই ! চলে গেছে আমাদের ছেড়ে !
সমাপ্ত