আজ ভারত এর সমকালীন সৃজনশীল লেখক-অগ্নিমিতা দাস এর শুভ জন্মদিন। তার লিখা জন্মদিন উপলক্ষে প্রকাশিত হল গল্প“ডাক”

406
অগ্নিমিতা দাস এর শুভ জন্মদিন। তার লিখা জন্মদিন উপলক্ষে প্রকাশিত হল গল্প“ডাক”

ডাক____________________________

  অগ্নিমিতা দাস

রাজ হাই তুলে বললো__ ধুস! এইভাবে বসে বসে কোমর ধরে যাবে। সামনে কোথা ও দাঁড় করা ভাই। চা খাবো আর ইয়ে মানে তোদের ও তো !
কথা শেষ হতে না হতেই এনা ফোঁস করে উঠলো_ ইল্লি! নিজেদের বেলায় আঁটিসাটি পরের বেলায় দাঁত কপাটি! কাল যখন মৌয়ের দরকার ছিল তখন তো খালি বলছিলি একটু দাঁড়া সামনেই একটা পেট্রোল পাম্প পড়বে। এখন নিজের হয়েছে তাই বলে গজগজ করতে করতে এনা রাইয়ের মাথায় হাত বুলোলো। রাই গাড়ির জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে ছিল। দুপাশে খালি সবুজ আর সবুজ। চকচকে চওড়া রাস্তা দিয়ে তাদের সুমো এগিয়ে যাচ্ছে। জাকির গাড়ি চালাচ্ছে। রাজ অনিন্দ্য বদলাবদলি করে মাঝে মাঝে জাকিরকে ফ্রি করছে।তাদের গাড়ি ক্রমশ পাহাড়ের পাকদন্ডী বেয়ে ওপরে উঠছে। মেয়েরা বলেছিল প্রফেশনাল ড্রাইভার নিতে। রাজ তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়েছে। রাইয়ের চোখমুখ এখন বেশ উজ্জ্বল ভাব।সেটা কি অভীকের সাথে দেখা হবে বলে না প্রকৃতির আদরমাখানো কোলে এসে তা বোঝা মুস্কিল। তবে এনা আর মৌপিয়ার ওকে দেখে বেশ রিলিফ লাগছে। যা অবস্থা চলেছিল ওর ওপর দিয়ে। রাইয়ের বাড়িতে ঠাকুমা ছাড়া কেও নেই। মা বাবার ডিভোর্স হয়ে গেছে। তারা নিজেরা যে যার মতো সংসার করছে।ইনফ্যাক্ট ঠাকুমার কাছেই সে ছোট থেকে মানুষ। রাইয়ের ট্রমা পিরিয়ডে তারা তো টাকা পাঠিয়ে খালাস। সাইক্রিটিসের সাথে কনস্যাল্ট করা। সেশনের সময় সঙ্গে যাওয়া। সব করতে হয়েছিল এই অভিন্ন হৃদয়ের বন্ধুদের। প্রথম ছমাস তো এনা আর মৌপিয়াকে বদলাবদলি করে ওর কাছে শুতে হতো। রাই তখন চোখ বন্ধ করলেই বাচ্চার কান্না শুনতে পেত আর তখন কান চেপে চিৎকার করে কি কান্না। তখন ওদের রাইকে ভুলিয়ে ভালিয়ে ঘুম পাড়ানোর দায়িত্ব ছিল । প্রতিবছর এই শীতে ওরা যে যেখানেই থাকে কথাবার্তা বলে ঠিক করে পাহাড়ে সাতদিনের জন্য ঘুরতে যাবেই। মাঝে তিনবছর রাইয়ের জন্য যাওয়া হয় না। কিন্তু যখন জাকির কনফার্ম করলো যে মোহিনীকে সে দক্ষিণ কলকাতার এক অভিজাত কফি শপ থেকে একটা ছেলের সাথে গল্প করতে করতে বেরোতে দেখেছে। তখন রাজ সোর্স লাগিয়ে খবর নিল মোহিনী ওদের ফার্ণ রোডের বাড়িতে ওই ছেলেটার সাথে উঠেছে। অভীক সাথে নেই। তখনই ওরা প্ল্যান করে এই ট্যুরের ব্যবস্থা করলো। রাইকে জানাতেই সে প্রথমে প্রবল আপত্তি করেছিল। কিন্তু এনাক্ষী ওরফে এনা যখন শক্ত মুখে বলেছিল___ অভীকের সাথে শুধু তোর নয় । আমাদের সবার একটা বোঝাপড়া বাকি আছে। আফটার অল উই আর চাইল্ড হুড ফ্রেন্ডস। ও কি ভেবেছে এইভাবে পালিয়ে পার হয়ে যাবে। এতদিন তোর মুখ চেয়ে কিছু করিনি। এখন তোর কথা আমরা শুনবো কেন।

রাজের যতই কোমরে ব্যাথা করুক না কেন সরু রাস্তায় অন্য গাড়ি যাতায়াতের অসুবিধা হবে তাই গাড়ি একেবারে ওদের বুক করা গেষ্ট রুমে গাড়ি থামলো।পাহাড়ের অনেক ওপরে প্রকৃতি যেখানে নিজেকে উজাড় করেছে সেইখানে ডাকবাংলোর ব্যালকনিতে রাই দাঁড়িয়ে ছিল। সন্ধ্যা নেমে গেছে। লাল আলো ঝুপ করেআকাশের কালো কার্পেটে মুখ লুকোয়। তখন সেই কার্পেট সেজে ওঠে লক্ষ লক্ষ ঝাড়বাতির আলোয়। হলুদ সাদা বড় আলোটা থেকে যেন মাখন চুঁইয়ে চুঁইয়ে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। সেই আলোয় স্নান করে কেমন যেন মায়াবী লাগে দূরের গ্রামগুলো। কুলকুল করে পাহাড়ী ঝর্ণার শব্দ শোনা যায়।
____ এখানে নেট এত প্রব করছে। তখন থেকে মাকে ট্রাই করছি, পাচ্ছি না। এনার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বললো রাই বলল__ আমার এয়ারটেল, একবার ট্রাই করতে পারিস! তোর তো জিয়ো, ওর নেটওয়ার্ক এখানে পুওর তো হবেই। এনা রাইয়ের ফোন নিয়ে বার ছয়েকের চেষ্টা পর সবার বাড়িতে জানিয়ে দিল ওরা ঠিকমতো পৌঁছেছে। নেটওয়ার্ক যখন পাওয়া গেছে তখন একেবারে সকলকে কল করা ভালো।
___ কি রে অন্ধকারে ভূতের মতো দাঁড়িয়ে কি করছিস! জানিস ওই জঙ্গলে রাতে বাঘের ডাক শোনা যায়। চৌকিদার বলছিল। যাবি নাকি আজ রাতে জঙ্গলে! শুনেই বেশ থ্রিলিং লাগছে। কফির ভাগে চুমুক দিতে দিতে রাজ বললো।
___ তোর গায়ের গন্ধে বাঘ, ভাল্লুক হাতি সব পালিয়ে যাবে। কদিন স্নান করিস নি। শীতকালে তো সবসময় কাকচান করে কাটাস তাতে আবার এই ঠান্ডার দেশে। প্লীজ তোর মোজাগুলো একটু ধুয়ে নে। বাথরুমে গীজার আছে আর আমার কাছে কাপড় কাচার সাবান আছে। রাজ একটু ও অপ্রিতভ না হয়ে নিজের বগলের তলায় এনার মুখটা চেপে ধরার চেষ্টা করতে লাগলো। শুরু হলো মারপিট। দেখেশুনে মোহিনী ও অনেকদিন বাদে হো হো করে হাসতে লাগলো।
ওর চোখে ভাসছে অনেক দিন আগের রেড স্কার্ট আর সাদা শার্ট পরা বছর ছয়েকের মেয়েটার সাথে ওর বয়সী রেড সোয়েটার পরা ছেলেটার তুমুল মারপিট। ব্যাগ, ওয়াটার বোতল সব ধুলোয় পড়ে। ওরা ছয়জন বাচ্চা হাঁ করে তাকিয়ে ছিল, কি করবে বুঝতে পারছিল না।
রাজজয়, জাকির, অনিন্দ্য, মৌপিয়া, রাইকিশোরী, এনাক্ষী, অভীক ছোট থেকেই এক স্কুলে পড়তো। মোটামুটিভাবে সবার বাড়ি কাছাকাছি ছিল। টুয়েলভের পর সবার ছাড়াছাড়ি।
সবার আলাদা আলাদা স্ট্রীম! অভীক তো ডাক্তারি পড়তে বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজে চলে গেল। বাকি সবাই কোলকাতায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে। কিন্তু দেখা হতো, চলতো হইহুলোড়। বছরে একবার সবাই মিলে শীতে ট্রেকিং করতে পাহাড়ে আসতোই। ছোট থেকেই রাইয়ের অভীকের প্রতি দুর্বলতা ছিল। বড় হওয়ার সাথে সাথে তা ডালাপালা মেলে প্রেমের আকার নেয়।সবাই জাকিরের ঘরে আড্ডা দিচ্ছে, রাতে জাকিরের মায়ের হাতের বিরিয়ানি খেয়ে এখানেই থাকার প্ল্যান সবার। হঠাৎ অভীক হাজির।
___ এই ডাক্তার তোকে তো কেও ডাকে নি।
তুই কোথা থেকে উদয় হলি ভাই! রাজ পকোড়া খেতে খেতে বললো।
____ तेरे बिन जीना नहीं ओ मेरी जाने वफा! তাছাড়া আমরা তোর সাথে কেও বিরিয়ানি শেয়ার করবো না, রাইয়ের প্লেট থেকে ভাগ বসাস। এনা ফুট কাটলো।
__ বেটা কখন এলি! যা আগে ফ্রেশ হয়ে নে। আমি তোর জন্য খাবার আনছি। ট্রেনে কিছু খাসনি নাকি? মুখটা শুকনো লাগছে। জাকিরের মা সস্নেহে বলে উঠলেন। সেই নার্সারি থেকে এদের বন্ধুত্ব। অভীক যে রাইয়ের টানে টানে ক্লাস কেটে এখানে এসেছে তাই বুঝতে উনার বাকি থাকলো না। কিচেনে চটপট লুচির ময়দা মাখতে মাখতে ভাবছিলেন মোহিনীর মা বাবা থেকে ও নেই। অভীক বিয়ে করবে তো রাইকে।
রাই এত ভালো মেয়ে ওকে যে পাবে তার ভাগ্য।
জকির কাছে মাঝে মাঝেই শোনে ওরা দুজন এদিক সেদিক ঘুরতে যায়। রাইয়ের মা থাকলে হয়তো সাবধান করতো। বাইরের ঘর থেকে হাসির ফোয়ারা ভেসে আসছে। সবকটা পাগল মেতেছে।
হঠাৎ কলকাতায় পাহাড় থেকে পড়তে আসা অপূর্ব সুন্দরী মোহিনীর মোহজালে অভীক আটকা পড়লো।এনার ইউনিভারসিটিতেই মেয়েটা সায়কোলজি নিয়ে পড়তো। কোলকাতাতে ও ওদের বাড়ি আছে।এনার বার্থডে পার্টিতেই মোহিনীর সাথে অভীকের আলাপ। সায়কোলজিতে ভালোই দক্ষতা ছিল বলে খুব তাড়াতাড়ি রাইকে সাইকো পেশেন্ট বানাতে সময় নিল না। সবার মনেই সন্দেহ হতো মোহিনী কে নিয়ে অভীকের বাড়াবাড়ি দেখে। অভীক যেন যেচে পড়ে মোহিনীকে সব ব্যাপারে হেল্প করে। রাই ছেলেবেলায় সব হারিয়ে অভীকের ব্যাপারে খুব পজেশিভ ছিল। মোহিনীর কথা উঠলেই ও যেন ক্ষিপ্ত বাঘিনীর মতো হয়ে অভীক কে আঁচড়ে কামড়ে এক করতো। এই সুযোগটা হাতছাড়া করতে চাইতো না মোহিনী। সে তখন অভীককে সমবেদনা দেওয়ার জন্য পাশে থাকতো।
___ সত্যি জাষ্ট আর নিতে পারছি না। আমি কতবার বলেছি আমরা জাষ্ট ভালো বন্ধু। ও কিছুতেই মানবে না। মোহিনী লেকের ধারে বসে অভীকের মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বলতো___ তুমি একবার ভাবো ওর অবস্থাটা! ওর তো তুমি ছাড়া আর কেও নেই। আহা বেচারী তোমায় বড্ড ভালোবাসে। বলেই মুখ দিয়ে একটা চুকচুক আওয়াজ করলো।
____ এমন ভালোবাসার চাপে আমি মারা পড়ছি। আমি ওর কাছ থেকে মুক্তি চাই। মুক্তি। একটু শান্তি!আমাকে কেও বুঝলো না। আমার বন্ধুরা ও না।মোহিনী এবার মোক্ষম চালটা দিলো __ কাউকে বোঝানোর ঠেকা তুমি নাও নি। আমাদের ওখানে চলো! এই রকম জায়গায় গিয়ে থাকলে তোমার মন ভালো হয়ে যাবে। মোহিনীর ড্যাডের সিকিম, দার্জিলিং, কালিংপং এর সব জায়গায় বড়ো বড়ো হোটেল আছে। অভীকের ততক্ষণে ডাক্তারি পড়া শেষ হয়ে গেছে। অভীক মোহিনীর প্রস্তাবে রাজি হলো। তাছাড়া তারো এইরকম বড়ো একটার খুঁটির প্রয়োজন ছিল। অভীকের বাবা রিটায়ার্ড সরকারী চাকুরে। পেনশনের টাকায় সংসার চলে। সবার আশা অভীক এবার হাল ধরবে।
কানাঘুষায় কিছু শুনে রাতে রাজ অভীকের বাড়ি গিয়ে ওর কলার চেপে ধরলো___ শালা! তুই এই গদদারি করবি, আমরা ভাবতেই পারছি না। ফুর্তি মারার সময় আজ দীঘা কাল ডায়মন্ড হারবার তখন রাইকে দরকার ছিল । বহু দিন শরীরের সুখ নিয়ে এখন ছিবড়ে করে ফেলে অন্য দিকে নৌকায় পা দিচ্ছো। বড় লোকের মেয়ে বলে লাল ঝোল গড়াচ্ছে । আজ তোকে আমি খুন করে ছাড়বো। কেও বাঁচাতে পারবে না। বলেই অভীক কে লক্ষ্য করে ঘুষি মারে। অভীক ছিটকে গিয়ে পড়ে, টেবিলের কোনায় ওর মাথায় লাগে, দরদর করে রক্ত বার হয়। চেঁচামেচি শুনে অভীকের বাবা মা ছুটে আসে।
অভীক তখনো মাটিতে বসে মাথায় হাত দিয়ে বলে___ তুই নিজে কি! সারাজীবন তো আমার জামা, আমার নোটস জাকিরের সাইকেল অনিন্দ্যর পকেটমানি নিয়ে দিন চালিয়েছিস। এনার পয়সায় সারাজীবন কলেজ ক্যান্টিনের পয়সা বাঁচিয়েছিস। নিজে ভিখারী, আবার আমায় বড়ো বড়ো কথা বলছিস।বেশ করেছি শালা। আমার যার সঙ্গে ইচ্ছে করবে তার সাথে প্রেম করবো কার বাপের কি।
রাজ রাগে কাঁপতে কাঁপতে বলল___ তুই এত হিসাব রেখেছিস! মেসোমশাই আমি এই বাড়িকে নিজের বাড়ি ভাবতাম বলে নিজের বলে মনে করতাম। আপনার ছেলেকে সাবধানে থাকতে বলবেন না হলে আমার হাতে খুন হয়ে যাবে। বলেই রাজ ঝড়ের বেগে বেরিয়ে গেল।
___ আমি তোকে আজ খুন করে দেব আমার পারফিউম তুই না বলে মেখেছিস। এনা তারস্বরে চেঁচাচ্ছে। রাই দেখলো তখনো এনা আর রাজের রাম রাবণের যুদ্ধ হচ্ছে। মৌ এসে রাইকে বললো__ বাংলোর বারান্দায় চল বনফায়ার করি। বহুদিন তোর গান শুনি নি। অনিন্দ্য হইহই করে বলে উঠলো___ হয়ে যাক! জাকির দেখ তো চৌকিদার বাবাজীবন সব ব্যবস্থা করতে পারবে কিনা।
কাল তোরা রডোড্রেনড্রনের আগুন দেখতে পাবি। আজ একফাঁকে পাহাড়ের কোল থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা টুকি দিয়েছিল,এনা পিক নিয়েছিস তো? কোলকাতায় গিয়ে সব দিবি।
অন্ধকারে দূরে পাহাড় দেখা যাচ্ছে। বনফায়ারকে ঘিরে ওরা পাঁচজন চেয়ারে বসে।রাজ বোতল খুলেছে। জাকির খায় না। বাকিরা সবাই কনননে ঠান্ডায় গলায় ঢালতে ঢালতে চলছে খুনসুটি। পুরোনো গল্প। এখন সবাই প্রতিষ্ঠিত। রাজজয় বড়ো কর্পোরেট সেক্টরে কাজ করে। জাকির হেলথের বেশ ভালো পোষ্টে আছে। অনিন্দ্য বাবার মেডিসিনের বিজনেস সামলায়।এনাক্ষী নামী ইংরেজি সংবাদপত্রের এডিটার আর মৌপিয়া সরকারি স্কুলের টিচার। শুধু রাইয়ের এত ট্যালেন্ট থাকা সত্ত্বেও সব কিছু শেষ হয়ে গেল । এনার ফটোগ্রাফির খুব শখ তাই এখানে সবসময় পটপট করে ফটোশুট করছে।
___ এই অন্ধকারে ক্যালনের মতো কি ফটো তুলছিস। কিছুই আসবে না।
___ এটা দামী ক্যামেরা বুঝলি! তুলতে জানতে হয় তুই আজ পর্যন্ত একটা সোজা ছবি তুলেছিস, খালি হাত কাঁপাস। রাজ হাসতে হাসতে বললো ___ দেখিস এসে থেকে যা ছবি তুলছিস। আমরা না সত্যি ছবি হয়ে যাই বলে নিজের রসিকতায় হো হো করে হেসে উঠলো।বনফায়ারের কাঁপা কাঁপা আলোয় সবার মুখগুলো কেমন যেন রহস্যময় লাগছিল।
রাই আনমনে মৌয়ের আবদারে গান ধরলো__
সখী ভাবনা কাহারে বলে
সখী যাতনা কাহারে বলে!
তোমরা যে বলো দিবস রজনী
গানের মধ্যে এমন দরদী এমন আবেগ ছিল যে সবাই মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনছিল।
রাজ খুব ইমোশনাল তাই গানের শেষে তাড়াতাড়ি বললো__ চল! এবার শরীরটা বেশ চাঙ্গা লাগছে। গান চালা একটু সেই কলেজের ফেস্টের মতো কোমর দোলাই। জাকির বললো__ রাজ আর খাস না, কাল ভোরে বেরোনো। এবার চল শুয়ে পড়ি।
___ দাঁড়া! কতদিন পরে আমরা একসাথে হয়েছি।
ফুলটুস মস্তি! মাইরি মালটা এত উঁচুতে থাকে কি করে। পালাতে পালাতে এত দূর বলেই চট করে রাই কে দেখে বলে উঠলো__ দাঁড়া মৌ আর এনার সাথে নাগিন ডান্সটা সেরে নিই।
রাতে রুমে মৌ এনা আর রাই শুয়েছিল। সবাই ঘুমিয়ে গেছে। শুধু রাই শুয়ে শুয়ে ভাবছিল এরা তো ওর শুধু বন্ধু নয় নিজের ভাইবোনের ও বাড়া।
অভীক যখন হঠাৎ করে কাউকে কিছু না বলে মোহিনী কে বিয়ে করে ওর বাবার ব্যাবসা দেখার জন্য পাহাড়ে চলে গেল। তখন রাই চারমাসের প্রেগন্যান্ট। রাই লুটিয়ে পড়েছিল অভীকের পায়ে___ আমায় ছেড়ে যেও না প্লিজ। আমি তোমায় আর বিরক্ত করবো না। তুমি যত খুশি মোহিনীর সাথে ঘোরো বেড়াও কিন্তু আমায় ছেড়ো না।
___ রাই আমার কোন দোষ নেই। নিশ্চয়ই তোমার ইচ্ছে না থাকলে এসব হতো না। আমি প্রিকশন নিয়েছিলাম, তারপর যদি কিছু হয় থাকে দ্যাটস নট মাই ফল্ট। কাল তোমায় ক্লিনিকে নিয়ে যাবো।
রাই কিছুতেই রাজি হচ্ছে না দেখে অভীক মিষ্টি কথায় ভুলালো যে এবার ওটা অ্যবরশন করিয়ে নিক। অভীক এম. ডি টা করে নিয়ে তারপর ওরা বিয়ে করে সংসার পাতবে। রাই ও ওর কথায় ভুলে ক্লিনিক গেল। কিন্তু বাড়ি ফিরে এসে রাইয়ের সাতদিন পরে ইনফেকশন হয়ে গেছে। ততক্ষণে অভীক কলকাতা ছেড়ে হাওয়া।
শোনা যায় প্রতি মাসে মোটা টাকা অভীক বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়, কিন্তু ছেলের এই অধঃপতনে ওর বাবার মানসিক ভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন। সবার কাছে বন্ধুরা শুনতে পায় যে অভীক মোহিনীর ড্যাডের রাবাংলার হোটেলের দেখাশোনা করছে প্লাস প্র্যাকটিস করছে। ওখানে কোলকাতার বন্ধুবান্ধবের সাথে দেখা হবার পর অভীক এড়িয়ে গেছে। পরে শুনেছে ওরা ইয়াম থাং ভ্যালিতে থাকে। মোহিনী কিন্তু বাবার হোটেল দেখাশোনা করার জন্য প্রায় সিকিমের সব জায়গায় যায়। বন্ধুবান্ধবদের সাথে ঘোরে, বেড়ায়। অভীক ওখানে স্থানীয় একটা ডিসপেনসারি খুলে পাহাড়ী মানুষদের আর ওখানে বেড়াতে আসা ট্যুরিস্টদের চিকিৎসা করে।এই তিনবছর পর রাইকিশোরী ওদের কথায় প্রথম কোলকাতার বাইরে গেল তাও অভীকের সাথে দেখা করার জন্য। রাইয়ের ঠাকুমা এই কথা জানে না। জানলে আসতে দিতো না।
তখন সূর্যের আলো ভালো করে ফোটে নি। কুয়াশার চাদরে মুড়ি দিয়ে পাইনগাছগুলো যেন জবুথবু হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। শিশির ভেজা রাস্তায় গাড়ির স্টিয়ারিং ধরে রাজ বসে আছে।
___ শোন, এখনো তোর হ্যাংওভার কাটে নি। অত রাতে শুয়েছিস, তাতে এত ভোরে ওঠা। চল সরে বস! জাকির ঠান্ডায় কাঁপতে কাঁপতে জ্যাকেটের পকেটে হাত ঢুকিয়ে বললো।
__ মর্নিং শোস দা ডে! এত সুন্দর সকালে আমি চালাবো। দেখ না বিকেলের মধ্যেই আমরা পৌঁছে যাবোই।গাড়ি পাহাড়ের উঁচুতে উঠছে। গাড়িতে বাজছে ____ बिजली चमके लिपट गए हम! बादल गरजे सिमट गए हम। इये हे कितना अच्छा सागुन!
सुन सुन सुन बारसात कि धून !!

গান শুনেই মোহিনীর বুকটা মুচড়ে উঠলো।
মনে পড়ছিল অঝোর বৃষ্টিতে সন্ধ্যায় ওদের বাড়িতে ক্লাস টুয়েলভের মেয়েটার অঙ্ক শিখতে শিখতে প্রথম চুম্বনের স্বাদ পাওয়া। সেই নোনতা স্বাদটা যেন এখনো মুখে লেগে আছে।
অনিন্দ্য হঠাৎ গান বন্ধ করে হেঁড়ে গলায় গান ধরলো_ ईयारौ दोस्ति बढ़ी हि अजीब हे”
সবাই হাততালি দিয়ে গাইতে শুরু করলো। রাই ও মৌয়ের চাপে গলা মেলালো। ওরা বোধহয় ওর মনের অলিগলি বুঝতে পারে।হঠাৎ একটা ঝাঁকুনি দিয়ে গাড়ি থেমে গেল।
সারা রাস্তায় ওরা দেখলো পাহাড়ের কোলে মাঝে মাঝে পেঁজা তুলোর মত বরফ তাতে থাকে থাকে আগুনের ফুলকি সাজানো। রাজ বললো___ দেখ! দেখ! এটা রডোড্রেনডন ।এনা পটাপট ফটো তুলছিল। পাহাড়ের গা বেয়ে সরু জলের স্রোত গায়ে ফুটে থাকা থোকা থোকা নাম না জানা ফুলগুলো কে ভিজিয়ে দিয়ে যাচ্ছে। এটা বোধহয় মেঘেদের রাজ্য, তাই এরা সবসময় দুলকি চালে এসে সবার গা ভিজিয়ে দিয়ে পালায়। মৌ একবার জানলা খুলতেই ছুরির মতো ঠান্ডা হাওয়া চোখে মুখে বিঁধলো! রাজ সাবধান করলো এখানে জানলা খুলে হাওয়া খাওয়া মানে নিউমোনিয়া কে সেধে ডেকে আনা।
ওরা রাস্তায় জিগ্যেস করে অভীকের ঠিকানা নিয়ে নিল। ছোট্ট জায়গা তো তাই খুঁজে পাওয়ার অসুবিধা নেই। ছবির মতো আঁকা একটা বড় বাংলোর গেট ঠেলে যখন ওরা ঢুকলো, তখন সন্ধ্যা নেমে গেছে।ডোরবেলটা মনে হয় কাজ করে না, চার বার বাজানোর পর ও যখন কেও খুলছে না তখন জাকির জোরে জোরেই দরজায় টোকা দিল।দরজা খুলে বেরিয়ে আসা মানুষটা অন্ধকারে এতগুলো ছায়ামূর্তি দেখে ঠিক ঠাউর করে উঠতে পারলো না। অভীক স্পষ্ট হিন্দিতে বলে উঠলো_ কৌন হো তুমলোগ?
____ শালা তোর মৎ! বলেই হাসতে রাজ এগিয়ে এলো।জাকির ম্যানেজ দেওয়ার জন্য বলে উঠলো___ তোকে কি রকম চমকে দিলাম বল! পুরো পল্টন হাজির। অভীক গলাগুলো শুনেই চমকে গেল।আমতা আমতা করে বলে উঠলো___ আমায় জানাতে পারতিস। আমি তোদের নিতে গাড়ি পাঠিয়ে দিতাম।অনিন্দ্য শ্লেষ মাখানো হাসি হেসে বলল___ বরযাত্রীর স্বাগতটা হয় নি বলে আফশোস না করে আপাতত ঢুকতে দে, না হলে ঠান্ডায় জমে কাঠ হয়ে যাবো। অভীক তাড়াতাড়ি। বলে উঠলো___ হ্যাঁ হ্যাঁ ! ভেতরে ঢোক।
বাংলোর ভেতরটা বিশাল। কে বলবে এই পাণ্ডববর্জিত জায়গায় এত বড় ঝাঁ চকচকে বাংলো কেও বানাতে পারে। অবশ্য মিস্টার জয়দেব সিনহার মতো পয়সওয়ালা মানুষের কাছে এসব বাঁ হাতের খেল। অভীক সবাইকে বিশাল ড্রইরুমে বসানোর তোড়জোড় করতেই জয় বলে উঠলো____ কি রে আমাদের গেষ্ট বানিয়ে দিলি। আমরা তো ঠুঁটো জগন্নাথের মতো বসতে আসি নি, বাড়িটা আগে ঘুরে ঘুরে দেখি। তারপর নয় তোর বেডরুমটা ওকপাই করবো কি বল!
অভীক হতাশ হয়ে কাঁধ ঝাঁকালো। এইভাবেই রাইকে নিয়ে ওদের হামলা ওকে কিংকর্তব্যবিমূঢ় করে দিয়েছে। রাই এসে থেকে একবার ও অভীর মুখের দিকে তাকায় নি। সে সোফা থেকে উঠে ঘুরে ঘুরে অভীর ঘরের বৈভব দেখছিল। লাল কার্পেটে মোড়া সিঁড়ি দিয়ে উঠতেই ল্যান্ডিংর দেওয়ালে বিশাল বাঁধানো ছবির দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। মোহিনী আর অভীর ছবি। দুজনে দুজনের দিকে তাকিয়ে হাসছে। সে হাসিতে ঝরে পড়ছে অটুট দাম্পত্যের চিহ্ন। অভীক পায়ে পায়ে রাইয়ের কাছে এসে দাঁড়ালো। ছিপছিপে গড়নের রাইয়ের ছোট থেকেই এক ঢাল চুল ছিল, এখন সে ছেঁটে ঘাড় অবধি এসেছে, অনেকটা হিমবাহের মতো লাগছে। বুকটা টনটন করে উঠলো। ইচ্ছে করছে রাইকে আগের মতো জড়িয়ে চুমুতে চুমুতে ভরিয়ে দেয়। কিন্তু ফেরার রাস্তা সে ডিনামাইটের দিয়ে উড়িয়ে দিয়েছে। বিয়ের পর অভীক বুঝেছে মোহিনী তাকে ভালোবাসে না। বড়লোকের আদুরে মেয়ের অভীকের মতো পয়সার তালে নাচার মতো একটা পুতুলের দরকার ছিল। পেয়ে গেছে! খেল খতম! অভীক নিজের ডাক্তারি নিয়ে আর হোটেলের দেখাশোনা নিয়ে থাকে। মোহিনী আজ সিকিম কাল দার্জিলিং তো কখনো বম্বে কখনো দিল্লি। অবশ্যই সাথে থাকে তার নিত্যনতুন সোকলড বয় ফ্রেন্ড। প্রথম প্রথম সে ব্যাপারটা ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করতো, অভীক যখন চেজ করে তখন শুরু হয় তুমুল অশান্তি। এখন তো কোন রাখ ঢাক না করেই বলে যায়। এবারে তো অক্ষয় বলে একটা মাড়োয়ারি ব্যাবসাদারের সাথে কোলকাতা গেছে। কি সব বিজনেস ডিল করতে। রাই ঘুরে তাকালো। ফ্লুরোসেন্ট কালারের নিয়নের আলোয় ওর মুখটা ফ্যাকাসে দেখাচ্ছে। বরাবর রাইয়েরএকটু চাপা গায়ের রঙ, চোখগুলো ভাসা ভাসা,নাক টিকালো, যাকে বলে শার্প ফিচার। কিন্তু এখন কেমন রক্তশূন্য লাগছে। রাই ওর দিকে তাকিয়ে বললো___ ছবিটা খুব সুন্দর, ভীষন জীবন্ত। অভীকের গলা কেঁপে উঠলো___ রাই তোমায় এত ফ্যাকাশে লাগছে কেন?
____সাবাস জিয়ো হাততালি দিয়ে এনা ওদের দিকে এগিয়ে এলো। লং কোর্টে হাত ঢুকিয়ে এনা চিবিয়ে বলে উঠলো____ পেটের জিনিসটা খালাস করে হাওয়া হয়ে গেলি। একবার ও মনে পড়েছে মেয়েটার শরীরের মনের কি অবস্থা হয়েছিল। ওকে তো তোর মোহিনী সাইকোলজিক্যাল পেশেন্ট বানিয়ে দিয়েছিল আমাদের নাকাচোবানি খেতে হয়েছে ওকে ফেরানোর জন্য। প্লীজ এই মেকি সিমপ্যাথি দেখাস না।
মৌ ততক্ষণে ওদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। অভীক একটু রোগা হয়ে গেছে মনে হচ্ছে, কেমন যেন শুকনো ভাব! পরক্ষনেই মনের দুর্বলতা ঝেড়ে বলে উঠলো তীব্র স্বরে বলে উঠলো___ অভী শুধু তোর জন্য ওর ক্যারিয়ার ওর ট্যালেন্ট সব ফিনিস।
___ তোরা কি এত দূর আমার বাড়ি এসেছিস আমায় অপমান করতে।
____ পাহাড় যখন মোহাম্মদের কাছে আসতে চায় না তখন ন্যাচারালি মোহাম্মদ কেই পাহাড়ের কাছে আসতে হয়। অনিন্দ্য কখন ওদের কাছে এসে দাঁড়িয়েছে কে ও বুঝতে পারে নি।
অভীক তাড়াতাড়ি কথা ঘোরানোর জন্য বলল__ তোরা যদি একটু খবর দিয়ে আসতিস, তাহলে আমার কুক কাম মালীকে দিয়ে রান্না করিয়ে রাখতাম।____ কেন তোর ডিনার করা নেই। মৌ বলল।অভীক আঙ্গুল মটকাতে মটকাতে বলল____ আরে আমি তো রাতে শুধু স্যুপ আর ব্রেড খাই।____ ফিগার মেনটেন করে বুঝলি না। যতই হোক বড়লোকের জামাই বলে কথা। এসব স্টেটাস আমাদের কাছে ঝেড়ে লাভ নেই। কিচেনে চাল ডাল আছে আমরা ফুটিয়ে খেয়ে নেব। তোকে কিস্যু ভাবতে হবে না। রাজ হাসতে হাসতে বলল।
অভীকের মাস্টার বেডরুমে সবাই খাটের ওপর বসে। টেবিলে রাখা আছে ধোঁয়া ওঠা কফির মাগ।
মৌ বানিয়েছে। ওরা আলো নিভিয়ে দিয়ে বেড ল্যাম্পটা জ্বেলেছে। জাকির জানলার কাছে দাঁড়িয়ে ধোঁয়া ছাড়ছে। অভীক তাড়াতাড়ি অ্যশট্রেটা পাশে দিয়ে দিল।রাজ বালিশে হেলান দিয়ে পা নাচাতে নাচাতেবলে উঠলো____ এই জকি এত সাজানো গোছানো ঘর নোংরা করতে হয়। কোন সেন্স নেই। এই রকম একটা বাড়িতে আরামে থাকার জন্যই তো অভী জয়েন্টে ভালো রেজাল্ট করেছিল, ডাক্তারি পড়েছিল। জয়েন্টের যেদিন রেজাল্ট বেরোলো আমার মনে আছে রাস্তার রাস্তায় ঘুরে ওকে মাথায় নিয়ে নেচেছিলাম। জাকিরের মা তো গোটা পাড়ায় মিষ্টি বিলি করেছিল। আমার মায়ের তো কালীঘাটে মানত ছিল।অভীক ভাবলো___ বড় কর্পোরেট সেক্টরে কাজ করলে হবে কি সেই কলোনী মার্কা স্বভাবটা রয়েই গেল। কথার মধ্যে এখনো কেমন বখাটে বখাটে ভাব।কোন এডিকেট নেই।
রাজ যেন অভীকের মনের কথা বুঝে বলে উঠলো___ মাইরি বলছি আমি না কর্পোরেট সেক্টরে চাকরি করে নিজেকে বদলাতে পারলাম না রে।আমি সত্যি চাই ও না। আমার সেই শহীদ কলোনীর ঘুনধরা দেওয়াল, মায়ের হলুদ লাগা শাড়ির আঁচল, বিকেলে ঘুড়ি ধরে ভোঁ কাট্টা! ফুটবল মাঠে ঘামে ভিজে যাওয়া জামা পড়েই চারটে কে দুটো করে চা খাওয়া। ভুলতে পারবো না রে। এখন অবশ্য বালিগঞ্জের ফ্ল্যাটে বাড়ির সবাইকে নিয়ে শিফট হয়েছি। কিন্তু ছুটিছাটার দিনে ওখানের বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতে বয়স্কদের সাথে দেখা করতে যাই।
একটু যেন আনমনা হয়ে রাজ বলে উঠলো____ অভী তোর মনে আছে মায়ের হাতের আলু পোস্ত আর বিউলির ডাল খেতে তুই কি ভালোবাসতিস।
তুই ভালোবাসতিস বলে বাবা রোজ দুলুকাকার দোকান থেকে পান্তুয়া কিনে আমার টিফিনে দিয়ে দিত। আমি তো টিফিনে কিছু আনতাম না তোদের থেকে সাঁটাতাম। পারলাম না ভাই! নিজেকে
বদলাতে। সবাই তো তোর মতো নিজের শিকড়কে ভুলতে পারে না।জোঁকের মুখে নুন পড়ার মতো অভীকের মুখের অবস্থা হলো। ____ কেন রাই তো তোর পরীক্ষার দিন অল ইন্ডিয়া ডান্স কম্পিটিশনে সিলেক্ট হয়ে ও কুইট করে নিল। তুই তখন বলেছিলি পরীক্ষার হলে ঢোকার সময় ওকে থাকতেই হবে। তোর জন্য খাবার বানিয়ে বর্ধমানে ছুটে যাওয়া। কাকুর তখন কি একটা অসুবিধা ছিল অ্যনাটমির ক্লাসের জন্য বেশ কিছু টাকার দরকার ছিল। রাই নিজের মায়ের দেওয়া কানের দুল আমায় সাথে নিয়ে বিক্রি করে তোর হাতে টাকা তুলে দিয়েছিল। তুই জয়েন্টের প্রিপারেশন ভালো করে যাতে নিতে পারিস তাই যত্ন করে ক্লাসের নোটগুলো টুকে রাখতো। কি চমৎকার হাতের লেখা ছিল। তোর সব প্রজেক্ট প্র্যাকটিকাল গুছিয়ে করে দিতো। এর জন্য ওকে টিচারদের কাছে কম ঝাড় খেতে হয় নি। একবার মনে আছে ফুটবল ম্যাচে মারামারি করে তুই কার নাক ফাটিয়ে দিয়েছিলি। সারা রাত এই মেয়েটা লক আপের সামনে বসে ছিল। সকাল হতেই থানায় তোকে ছাড়ানোর জন্য পুলিশের পায়ে পড়ে গিয়েছিল।আরো কত কত এমন কিছু তুই ফেরত দিতে পারবি।____ আমায় এইভাবে তোরা ইনসাল্ট করতে পারিস না। অভীক তোতলাতে তোতলাতে বলে উঠলো।
তোর আবার ইনসাল্ট ফিল হয়? জাকির ঘুরে ওর দিকে তাকিয়ে বললো। ___ শোন আমরা কোন প্রফেশনাল ড্রাইভার না নিয়ে এত দূর গাড়ি চালিয়ে এলাম। সেলিব্রেট করবি না!কথা ঘুরে যাওয়াতে অভীক খুশি হয়ে বললো__ দ্যাটস গ্রেট ইয়ার! সেলারে ফ্রান্স থেকে আনা রেড ওয়াইন আছে। চারমাস আগে গিয়েছিলাম , এখনো খোলা হয় নি। কিন্তু তোরা খুব রিস্ক নিয়েছিস। ফেরার সময় খুব সাবধানে।
জকি আর অনি চোখ চাওয়া চাওয়ি করে বলল__ লাইফে তো রিস্ক নিতেই হয় তাই না। রিস্ক নিলাম তাই তোকে পেলাম আর ফেরার টেনশন তো নেই। তুই তো আছিস।
অভীক কথাগুলো ঠিক বোধগম্য করতে পারলো না।
____ অভী মোহিনী কে ফোনটা করে ফেল!
আধশোয়া হয়ে রাই অদ্ভুত চাপা হাসি হেসে বলল। ব্রাউন কালারে জ্যাকেট আর চোখে রিমলেস চশমায় ওকে দারুন অ্যাক্টট্রাটিভ লাগছিল। বেড ল্যাম্পের নীলাভ আলোয় ওকে কেমন রহস্যময়ী লাগছে! অভীক ওর দিকে সম্মোহিতের মতো তাকিয়ে মোবাইলে কল করলো। ফোন বেজেই যাচ্ছে। ও পাশ থেকে কেও ধরছে না।
___ অভী শেষবারের মতো ওর সাথে কথা বলে নে! কথাটা বলেই রাই এনার চোখে চোখ রাখলো। ওদের যেন চোখে চোখে কথা হলো।
অভীকের সব কিছু কেমন গুলিয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ রাতে ওদের এইভাবে ওর বাড়ি আসা। সব থেকে বড় কথা ওদের সাথে কোন লাগেজ নেই, এতটা পথ তো ওরা একভাবে আসে নি। ব্রেক দিতে দিতে এসেছে। তিনটে মেয়ে সাথে কোন ব্যাগ নেই। কথাবার্তা ও কেমন যেন রহস্যময়। আবার ফোন করলো। কোন উত্তর নেই।জয় আড়মোড়া ভেঙে বলল___ ফোন ধরবে না তোর বৌ। তোর বৌ তো বয়ফ্রেন্ডের সাথে কোলকাতায় ফুর্তি করতে এসেছে।দেখ এখন হয়তো দুজনে বিছানায়!
অভীক চিৎকার করে উঠলো____ মাইন্ড ইয়োর ল্যাঙ্গুয়েজ রাজ! এনাফ ইস এনাফ! তখন থেকে তোদের বলতে বলতেই ঝুপ করে আলো নিভে গেল।___ শিট! জাকির তোর লাইটারটা দে না! আমার মোবাইলটা তো এক্ষুনি এখানেই ছিল । তোদের কারোর একটা জ্বালা না। পাওয়ার কাট হয়ে গেল। আমার ইনভাটারের সুইচ ড্রইরুমে আছে।অভীক বেশ জোরেই কথাগুলো বললো।
কোন উত্তর নেই। সবাই চুপ। চারিদিকের চাপ চাপ অন্ধকার অভীক কে গিলতে আসছিল। ____ কি রে তোরা চুপ কেন? অভীকের গলাটা কেঁপে উঠলো।গমগমে গলায় রাজ বলে চললো____ আলো জ্বালাস না অভী। খুব কষ্ট হচ্ছিল রে! তোকে তো এবার আমাদের সাথে যেতে হবে। তোর জন্য এত দূর এত কষ্ট করে এলাম। তোকে ছেড়ে যাই কি করে বল?অভীকের গলাটা শুকিয়ে গেছে___ মানে, ইয়ার্কি বন্ধ কর। একি মজাক নাকি। তোরা ঘোড়ায় জিন দিয়ে আসবি আর আমায় যেতে হবে।
____ যেতে তো হবেই, যেতে তো হয়। জাকিরের ধরা গলা শোনা গেল____ অভী তুই ভালো নেই। তুই আমাদের সাথে চল। তুই খুব ক্লান্ত। রাইয়ের কোলে মাথা রেখে শুবি। আমরা মাথা ফাটিয়ে ফুটবল খেলবো। ছোটবেলার মতো চিটিং করে তোকে রেসে হারিয়ে দেব। চল তোকে ডাকতেই তো এসেছি। আমাদের ডাকে সাড়া না দিয়ে তুই থাকতে পারবি না। মনে আছে একবার বাইক অ্যাক্সিডেন্ট করে তুই হসপিটালে ভর্তি ছিলি। ইমারজেন্সির জন্য তক্ষুনি রক্ত দরকার ছিল। রক্ত পাওয়া যাচ্ছিল না। আমার রক্ত ম্যাচ করায় তিনবোতল রক্ত তোকে দিয়েছিলাম। তার দাম আজ যে তোকে দিতে হবে ভাই! এতদিন তুই মরে বেঁচে ছিলি এবারে সত্যিকারের…. ওর কথা শেষ হওয়ার আগেই অভীক দেখলো ও অন্ধকারে সব কিছু দেখতে পাচ্ছে। ওই তো রাই কেমন ঝিম ধরা দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে দুহাত বাড়িয়ে ওকে ডাকছে। রাজের দিকে তাকাতেই দেখলো ওর মাথা থেকে টকটকে লাল রঙের তরল গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ছে। জাকিরের ঘাড়টা হেলে গেছে। এনার মুখটা চৌচির হয়ে গেছে। অভীক আতঙ্কে মুখ ঢাকা দিল । শুনতে পেল সমবেত কন্ঠে একটাই ডাক____ অভী আয়! তোর জন্য এত কষ্ট করে এলাম! আয় তোকে নিতে এসেছি। যেতে তো তোকেই হবে।
_______________________________________
পরদিন সংবাদপত্রের প্রথম পাতায় প্রকাশিত হলো ইয়াং থাম ভ্যালির তিন হাজার মিটার গভীর খাদে পড়ে সূদূর কোলকাতা থেকে আসা একটা সুমো দুর্ঘটনাগ্রস্থ হয়েছে। ছজন যুবক যুবতী এই জিপে ছিল বলে জানা গেছে তবে এখনো তাদের দেহ উদ্ধার হয় নি। অনুমান করা হচ্ছে এত গভীর খাদে পড়ে কারোর বাঁচার কোন সম্ভাবনা নেই। তবে উদ্ধার কার্য চলছে।
নীচের দিকে ছোট্ট একটি কলামে লেখা ইয়াং থাম ভ্যালিতে বিখ্যাত বিজনেসম্যান জয়দেব সিনহার জামাই অভীক বাসু আনুমানিককাল রাত দেড়টার
সময় হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। সকালে মালী এসে দরজা বন্ধ দেখে পুলিশে খবর দেয়। ঘটনাস্থলে পুলিশ দরজা ভেঙে তাঁর দেহ উদ্ধার করে।
© মিতার কলমে অগ্নি
( সমাপ্ত)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here