ভারত থেকে অক্ষরশিল্পী ও লেখক-উজ্জ্বল সামন্ত’র নির্বাক অন্তরের গল্প“বন্ধু তোমায়”

234
উজ্জ্বল সামন্ত’র নির্বাক অন্তরের গল্প “বন্ধু তোমায়”

“বন্ধু তোমায়…”
উজ্জ্বল সামন্ত

অনির্বাণ এখন স্বপ্নেই বেঁচে থাকে। সংসারের সুখ উপছে এখন নিঃসঙ্গ জীবন যাপন করছে। অফিস কাজকর্ম নিয়ে ব্যস্ত থাকতে চেষ্টা করে। স্কুলের বন্ধু বান্ধবীরা আজকাল সবাই ব্যস্ত। মোটামুটি প্রায় সবাই এখন সংসারী। যখন অবসরে তখন ওর ছেলেবেলা, স্কুল লাইফের কথা খুব মনে পড়ে। কি ভালো ছিল না সেই দিনগুলো। স্মৃতির পাতায় গেঁথে মনেই রয়ে গেছে। কত টুকরো টুকরো স্মৃতি এখন চোখে ভাসে।

কখনো কখনো হেসে ওঠে বা কখনো চোখে জল। মাঝে মাঝে রাতে যখন ঘুম আসে না তখন একাকী ডাইনিং এ বসে ডাইরির পাতায় খসখস করে লিখে যায়। কি লেখে ,কেন লিখে, অনির্বাণ কাউকে মুখ ফুটে বলতে পারে না তার দুঃখ কষ্ট যন্ত্রণার কথা। এভাবেই চলতে থাকে।

হঠাৎ একদিন শুনলো ওর বন্ধু ডা: মন্ডল মারা গেছেন। স্কুলের বন্ধু ওরা ক্লাস ফাইভ থেকে। যদিও যোগাযোগ কম ছিল বর্তমানে কিন্তু দেখা হতো মাঝে মাঝে। এই খবরটা শুনে বুকটা ছ্যাত করে ওঠে অনির্বাণের। অরুন আর নেই। সারারাত ঘুমাতে পারেনি অনির্বাণ । অরুনের সঙ্গে স্মৃতি ভিড় করে এলো চোখে। অরুন ছিল সংস্কৃতিমনস্ক। ছোটবেলায় ওরা দুজন খুব ভালো আবৃত্তি করতো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে। স্কুলের বার্ষিক অনুষ্ঠানে আবৃত্তিতে অরুণ ফার্স্ট অনির্বাণ সেকেন্ড হত। ছোটদের নাটক করত একসাথে সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান থেকে। অনেকবার বাইরে আমন্ত্রিত হয়েও নাটক মঞ্চস্থ করে এসেছে ওরা সাংস্কৃতিক সংস্থার সঙ্গে । বিজ্ঞান মঞ্চের অনুষ্ঠানে প্রদর্শনী সাইন্স মডেল নিয়ে জেলা স্তরে যেত। সাংস্কৃতিক অডিটোরিয়ামে মজার অনেক স্মৃতি রয়েছে ওদের। ছেলেবেলায় অনির্বাণের প্রথম প্রেমের অনুভূতিও জানতো অরুন।

ক্লাস ফাইভের পরীক্ষা শেষে নাটকের ফাইনাল রিহারর্সেল রবিবার বৈকালে । নাটক মঞ্চস্থ হওয়ার আগের দিন অনির্বাণের প্রথম প্রেমে পড়া। কি টেনশন অনির্বাণের। অরুণ ও সঙ্গী-সাথীরা কিন্তু সমানে মজা করে প্যাক মেরে যাচ্ছে। অনির্বাণের তাতে ভ্রুক্ষেপ নেই। ওর মাথায় একটা চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে।কি করে মেয়েটিকে বলবে যে , আমি তোমাকে প্রথম দর্শনেই ভালোবেসে ফেলেছি। সেও ছোট ক্লাস ফাইভে পড়ত। ছোট্ট মেয়েটি লাল পাড় সাদা শাড়ি পড়ে বন্ধুদের সঙ্গে, রবীন্দ্র সংগীতের তালে তালে নাচ ছিল। অপূর্ব। অনির্বাণ তন্ময় হয়ে দেখছিল। পাশের ঘরে ওদের নাটকের রিহার্সেল শুরু হবে কিছুক্ষণ পরে। তাপস দা এখনো আসেন নি। তাপস দা প্রশিক্ষণ দিতেন কিভাবে অভিনয় এর খুঁটিনাটি ফুটিয়ে তুলতে হয়। সেদিন অনির্বাণের মনটা অন্যমনস্ক ছিল। নাটকের মহরায় একটা দৃশ্যের অভিনয়ে অনির্বাণ বারবার ভুল করছিল। তাপস দা একটা মোটা লাঠি দিলে ছুঁড়ে। না অনির্বাণের গায়ে লাগেনি। অনির্বাণের এই দৃশ্যের অভিনয় নিখুঁত ভাবে ফুটিয়ে তুলতে পারে সেই চেষ্টাই করছিলেন। অনির্বাণ নিজেকে সামলে নেয়।

পরদিন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। বৈকাল তিনটার মধ্যে অডিটোরিয়ামে পৌঁছে যায়। সন্ধ্যা ৭ টায় ছোটদের নাটক শুরু হবে। অনির্বাণের প্রধান চরিত্র। এই প্রথম সে প্রায় হাজার খানেক মানুষের সামনে অভিনয় করবে। যত সময় এগিয়ে আসতে থাকে অনির্বাণের টেনশনে বুক কেঁপে ওঠে। মেকাপের দাদা হাঁক দিলে অনির্বাণ চলে যায় প্রস্তুত হতে। অরুণের মেকআপ হয়ে গেছে। অনির্বাণ বসে মেকআপ করছে হঠাৎ সেই মেয়েটি হাজির। ওদের চন্দনের বাটি খুঁজে পাচ্ছে না। যাই হোক কয়েকজন নৃত্যশিল্পীর মুখে চন্দনের অপূর্ব শিল্প এঁকে দিল মেকআপ দাদা। অনির্বাণ একদৃষ্টে মেয়েটির দিকে তাকিয়েছিল । ওর মনের মধ্যে তখন তুফান মেইল ছুটে চলেছে। হৃদস্পন্দন কানে শোনা যায় এমন অবস্থা। কোনোক্রমে নিজেকে সামলে নেয়। অনুষ্ঠানের প্রথমে সমবেত সঙ্গীত তারপর ছোটদের নৃত্য অনুষ্ঠান হবে। ওরা চলে গেল। অনির্বাণ বসে রইল মেকাপের ফাইনাল টাচের প্রতীক্ষায়। নাটকের শিল্পীদের সবারই মেকআপ শেষ হলো। অনির্বাণ গ্রীণরুমের আড়াল থেকে দেখতে থাকল মেয়েটিকে। দর্শকে অডিটোরিয়াম ভরে উঠেছে। নানা রকমের ফ্ল্যাশলাইট ,ফগ লাইট রংবেরঙের আলোয় স্টেজ বর্ণময়। প্রদীপ প্রজ্জ্বলন করে অনুষ্ঠান শুরু হলো একটি রবীন্দ্র সংগীত দিয়ে।

আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে…

একটি থালায় কয়েকটি প্রদীপ

ওই রবীন্দ্র নৃত্যের তালে তালে মেয়েটি অপূর্ব নৃত্য পরিবেশন করলো। অনির্বাণের মন ভরে গেল। শিশুমনে প্রথম ভালোবাসার ছোঁয়া হয়তো অনুভব করল এই প্রথম বার। নাচ গানে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান জমজমাট।

অনির্বাণ দের নাটক শুরু হলো এক ঘন্টা পর। চিচিঙ্গে এন্ড কোম্পানি। নাটকটির বিষয়বস্তু ছিল বর্তমান প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার প্রতি অবহেলা , অন্যমনস্কতা ইত্যাদি। যা বাবা মাকে কতটা বিড়ম্বনায় পড়তে হয়। প্রথম দৃশ্যের পর অনির্বাণের প্রবেশ। ওর ভয় গলা শুকিয়ে এল। ঢগ ঢগ করে জল খেল। ভয়ে পা কাঁপল। তাপস দা হাঁক দিলে মনে সাহস যুগিয়ে এগিয়ে গেল। জমে উঠলো নাটক। নাটক শেষে দর্শকের হাততালিতে গোটা অডিটোরিয়াম হল মুখরিত। প্রায় রাত ১০ টায় অনুষ্ঠান শেষ হলো।

মেয়েটির সঙ্গে অনির্বাণের বছরে দুই একবার দেখা হতো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের সময়। পড়াশোনার চাপ খেলাধুলা কমে আসলো। করুন চেষ্টা করেছিল বন্ধুকে সাহায্যের কিন্তু সফল হতে পারেনি। এভাবেই কয়েকটা বছর কেটে গেল। অনিবার সাহস করে কাউকে বলতে পারেনি, মেয়েটিকেও না। মেয়েটিকে দেখার জন্য অনির্বাণ ওর বাড়ির পাশে খেলার মাঠে যেত ক্রিকেট খেলতে। ভাগ্য ভালো থাকলে একবার হয়তো দেখাও পেত।

স্কুলের গন্ডি পেরিয়ে অনির্বাণ কলেজে উঠল। অরুন গেল ডাক্তারি পড়তে। মেয়েটিও তখন উচ্চমাধ্যমিক দেবে। ও পরীক্ষার সিট পড়েছে ওদের বয়েজ স্কুলে। একদিন মেয়েটিকে শুভকামনা জানানোর জন্য গেল কিন্তু মেয়েটি অনির্বাণকে দেখে মুখ ফিরিয়ে নিল। কোন অনুরণন তৈরি হয়নি। অনির্বাণ চলে আসে।

এরপর বছর দুই পর ওর বাড়ির ফোন নাম্বার জোগাড় করে ফোন করে ল্যান্ডফোনে। সাথীর সঙ্গে দু একটি কথা হয়। অনির্বাণ প্রপোজ করে। মেয়েটি চুপ করে থাকে কোন প্রতুত্তর দেয় না। তিন-চারদিন পর মেয়েটি প্রতুত্তর দেয়। অনির্বাণ একদিন সাথীকে দেখা করতে বলেন। সাথী জানায় ওর অসুবিধার কথা। অনির্বাণ বারবার অনুরোধ করতে থাকে। কেন দেখা করতে চায়, জানতে চায়? অনির্বাণ জানায় ওকে সামনাসামনি প্রপোজ করবে। ওর জন্য একটি গিফট কিনে রেখেছে। সাথী কিন্তু অন্য ধরনের , অনির্বাণ কে বলে বসে : তোমার দেওয়া উপহার আমি একসেপ্ট করব, এটা তুমি ভাবলে কি করে?

অনির্বাণ আর কোন কথা বলতে পারেনি। কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থেকে ফোন কেটে দেয়। অরুন কে জানায় গোটা ব্যাপারটা। অরুণ বলে তুই ওর আশা ছেড়ে দে। জীবনটা তৈরি কর। কিন্তু ভাগ্যের বিরম্বনায় অনির্বাণের ভালোবাসা অচিরেই শুকিয়ে যায়।

অনির্বাণ নিজের পায়ে দাঁড়ানোর লড়াই শুরু করে। দূরের রাজ্য থেকে পুলিশ অফিসারের পরীক্ষায় ডাক আসে। ২২ বছরের অনির্বাণ একা চলে যায়। স্বপ্ন পূরণের লক্ষ্যে। কিন্তু কোনো এক অজ্ঞাত কারণে মেডিকেলের পর , নিয়োগ স্থগিত হয়ে যায়। অনির্বাণ ফিরে আসে। তার লড়াই চলতে থাকে।বছর চার পর সাথীর বিয়ে হয়ে যায় ঠিক অরুন এর মত একজনের সঙ্গে।

দুই বন্ধুর দেখা , অনির্বাণ প্রতিষ্ঠিত। অরুন হোমিওপ্যাথি ডাক্তারী পাশ করে নিজস্ব চেম্বারে প্র্যাকটিস করে। মাসে হয়তো একবার অরুণের চেম্বারে আড্ডা দিতে যায়। ওদের আরো দুই একজন বন্ধু আসে। অনির্বাণ ও ওর বন্ধুরা একে একে সংসারী হয়। অনির্বাণের বিবাহ সুখের হয় না। অনির্বাণ নিজের অভিশপ্ত জীবন থেকে মুক্তি পেতে বিচ্ছেদের আবেদন জানায়। আর অরুণ ব্যাচেলর ই থাকে। নিজের চেম্বার নিয়েই ব্যস্ত।

হঠাৎ সেই অভিশপ্ত দিন, যেদিন শোনে অরুন আর এই পৃথিবীতে নেই। অতিমারিতে শ্বাসকষ্টে ভর্তি ছিল হসপিটালে, ওখানেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে। চুল্লীর কালো ধোঁয়ায় আকাশ কিছুটা কালো হয়ে যায়। কিন্তু এভাবে তো চলে যাওয়ার কথা ছিল না অরুনের… অনির্বাণের চোখে কয়েক ফোটা জল গড়িয়ে পড়ে, বন্ধুর প্রতি এটাই হয়তো তাঁর শেষ শ্রদ্ধা জানায়…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here