মিষ্টি বকুল
-আবির হাসান সায়েম
এখন সকাল না সন্ধ্যা তা বোঝা যাচ্ছে না। জেলের ভিতর আলো ঢুকে না। অনেকগুলো পাখিদের আওয়াজ শুনা যায়। সকালে যখন পাখিরা তাদের নিত্যদিনের কাজে বের হয় তখন আওয়াজ করে আবার সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরবার কালে আওয়াজ করে৷ দু’সময় আওয়াজ করে বলে সকাল না সন্ধ্যা পাখির আওয়াজে তা বোঝ মুশকিল। হাবিলদার মোকাদ্দেসকে জিজ্ঞেস করা যায়। তিনি খুব অমায়িক রকমের মানুষের। খুব ভালো ব্যবহার, কিছু চাইলে সাথে সাথেই ব্যবস্থা করেন। অল্পদিনের মানুষের প্রতি সবাই হয়তো একটু দরদ দেখায়। সারাদিন পান খান। ভাত খাওয়ার পর পান না খেলে নাকি তার বদহজম হয়। তার ভাষ্যমতে, “পানের মধ্যে আছে সাতটা শিরা৷ সাত শিরার মধ্যে মধ্যমটা বিষ। বাকিগুলা অমৃত। মধ্যমটা বাদ দিয়া খাইলে শরীরের জন্য ভালো। ভাই একটা দিমু? খাইবেন?”
সুজন প্রতিবারই মানা করে। আজ কেনো যেনো পান খেতে খুব ইচ্ছে করছে। হাতে কয়দিন আছে কে জানে? একটা তেলাপোকা কোনায় জমে থাকা পানি খাচ্ছে। তেলাপোকা পানি খায় চো চো শব্দ করে কিন্তু খুব নিস্তব্ধ হলেই তা শুনা সম্ভব। সুজন গভীর রাতে একবার চু চু শব্দ শুনে ধরমর করে ঘুম থেকে জেগে উঠে। তারপর আপছা আলোতে দেখে একটা তেলাপোকা পানি খাচ্ছে।
সুজনের চোখ ঝাপসা হয়ে এলো। সে কল্পনায় ডুবে যাচ্ছে। কেনো এমন হচ্ছে। মানুষের দিন ফুরিয়ে এলে কি অতীতের সব কল্পনা মাথায় এসে হানা দেয়? অতীতের কথা মনে পরলে পৃথিবী ছেড়ে যাবার কথা ভাবলেও গা শিওরে উঠে।
বিয়ের পরেরদিন নাস্তা শেষে ফাতেমা সুজনের সামনে এক গ্লাস কি যেনো রাখল। সুজন হাতে নিয়ে চুমুক দিয়ে ফাতেমাকে জিজ্ঞেস করল,
“এইটা কি জিনিস? ”
“এইটা হলো বকুল ফুলের শরবত। ”
” বকুল ফুলের শরবত বানালে কি করে? ”
” যেভাবে, বকুলের ফুল থেকে সুগন্ধি বানানো হয় সেভাবে। এতো কথা না বলে খাও তো। ”
“খেতে তো খুব ভালো। এই জিনিসের আলাদা কোনো নাম নেই?”
“বললাম না, বকুলের শরবত। ”
” ছোট্ট সুন্দর কোনো নাম নেই?”
ফাতেমা হালকা হেসে বলল,
“না নেই। তুমি একটা রেখে দাও নাম। ”
” এই শরবতের নাম ‘মিষ্টি বকুল ‘।খুব সুন্দর না নামটা?”
“হ্যা খুব সুন্দর। ”
সুজন আর ফাতেমা দু’জনই হেসে উঠল। কি অমায়িক দৃশ্য। এমন দৃশ্য কি আর কখনো দেখা যাবে? ফাতেমা কি আবার সুজনকে ‘মিষ্টি বকুল’ বানিয়ে খাওয়াবে?না খাওয়াবে না তা আর সম্ভব না।
সুজন তখন একটা প্রাইভেট কম্পানীতে চাকরী করে। খুব ভালো চাকরী। দুই বছর বয়সি একটা মেয়ে আছে তার। নাম শিলা। যেদিন শিলা’র জন্ম হয়, সেদিন খুব শিল বৃষ্টি হচ্ছিলো। তাই সুজন মেয়ের নাম রাখল শিলা। খুব ভালো চলছিলো দিনকাল। মানুষ এতো ভালো সময়ের কথা শুধু কল্পনাই করতে পারে । ফাতেমা খুব সুন্দর করে সংসারটাকে আগলে রেখেছে। কাজের অনেক চাপ, অনেক সময় সুজনের রাতে অফিসে থেকে যেতে হয়। অনেকসময় ঢাকার বাইরে যেতে হয়। একা ফাতেমাকে সব সামালাতে হয়। কিন্তু এ নিয়ে তার কোনো ক্ষোভ নেই। কখনো কিছু নিয়ে গলা উচিয়ে কথা বলে না। এমন স্রী কয়জনের ভাগ্যে জোটে? অফিসে সুজনের টেবিলে একটা ফ্রেম রাখা আছে। ফ্রেমে পাশাপাশি শিলা আর ফাতেমার ছবি। মাঝে মাঝে কাজের ফাকে সুজন যখনই সময় পায় তখন-ই ছবিটা হাতে নিয়ে আদর করে। বাসায় একটা টেলিফোন কিনতে হবে তাহলে যেকোনো সময় কথা বলা যাবে।
সুজনদের বাড়িটি দু’তলা। নীচতলায় তারা থাকে। উপরে একটা ছোট্ট চিলেকোঠার মতো ঘর। একবার সুজন ব্যাঙ্গালোরে একটা কাজে গিয়েছিলো। বাড়ি ফিরে দেখে ফাতেমে একজনকে বাড়ি ভাড়া দিয়েছে। লোকটা নাকি চাকরির সন্ধানে ঢাকায় এসেছে। বউ-বাচ্চা সব গ্রামে থাকে। ছয় বছর বয়সি একটা ছেলে আছে। থাকবার কোন জায়গা নেই। ফাতেমা’র সামনে কেঁদে ফেলায় সে আর মানা করতে পারে নি। সুজন লোকটাকে ডেকে এনে কথা বলেছে। লোকটার নাম বারসাত। সুজনের বেশ পছন্দ হলো লোকটাকে। কথায় বেশ একটা আন্তরিক ছাপ আছে। সুজন যে সময় কাজে বের হয়, বারসাতও সে সময় চাকরির খোজে বের হয়। ফাতেমার কাছে শুনেছে, ফিরার কোনো ঠিকঠিকানা নেই। মাঝে মাঝে তাড়াতাড়ি ফিরে মাঝে মাঝে দেরি করে। প্রায় তিন মাস পর কাজে ছয়দিনের জন্য সুজনকে সোঁনারগায় যেতে হলো। ছয়দিনের কাজ দুইদিনেই শেষ হয়ে গেলো। সোঁনারগায় কাসা-পিতলের মেলা হচ্ছিলো ফাতেমার আবার পিতলে জিনিস খুব পছন্দ। কয়েকটা জিনিস কিনেই অনেক ওজন হয়ে গেলো।
সুজন ফাতেমা-কে চমকে দেয়ার জন্যে বেল না টিপে স্পেয়ার কি দিয়ে দরজা খুলে ভিতরে ঢুকল। ফাতেমা দেখে কতই না আশ্চর্যিত হবে৷ ভাবতেই সুজনের মুখ আনন্দের হাসিতে ভরে গেলো। শোবার ঘরের দরজার সামনে যেতেই সুজন থমকে গেলো, তার পায়ের নীচ থেকে মাটি বোধহয় খানিকটা সড়ে গেছে। বারসাত আর ফাতেমাকে সে এমন অবস্থায় দেখল, যা দেখলে কোনো স্বামীই মনে হয় না দাড়িয়ে থাকতে পারবে। সুজনের হাত থেকে ব্যাগটা পরে গেলো। বারসাত সুজনকে দেখে আঁতকে উঠল। সুজনকে ধাক্কা দিয়ে একদৌড়ে বারসাত রুমে বাইরে চলে যাচ্ছে, এমন সময় সুজন ব্যাগ থেকে একটা কাসার মগ বের মরে বারসাতের দিকে ছুড়ে মারল। সারাঘর রক্তে ভেসে যাচ্ছে। শিলা ঘুমিয়ে ছিলো। বারসাতের চীৎকারে, সে উঠে কান্না শুরু করল। ফাতেমা শান্ত চোখে তাকিয়ে আছে সুজনের দিকে। সুজনে নিজেই পুলিশকে খবর দিলো। একবছর ধরে কেস কোর্টে চলল। ফাতেমা সুজনের বিরুদ্ধে সাক্ষী দিলো। কি সুন্দর শান্তভাবে মিথ্যা বলে যাচ্ছে, সুজন তাকিয়ে রইলো। এতটা ছল -এতোটা কপটা একটা নারীর পক্ষেই করা সম্ভব। রায়ে সুজনের ফাঁসি হলো। চারদিন আগে কনডেম সেলে এনে রাখা হয়েছে, যেকোনো দিন ফাঁসি হতে পারে।
সুজন জেলের সিক ধরে দাড়িয়ে একটু গলা উচিয়ে বলল,
“মোকাদ্দেস সাহেব আছেন নাকি?”
হাবিলদার মোকাদ্দেস এলেন। পানের রস ঠোঁটের কোনা দিয়ে গড়িয়ে পরছে। এই কিৎসিত দৃশ্যটিও সুজনের দেখতে ভারী ভালো লাগছে। জীবনের শেষ বিকেলে এই জগতের সবকিছুই ভালো লাগতে শুরু করে৷
“জ্বি ভাই বলেন। ”
“ভাই আপনি আমাকে কোথাও থেকে বকুলের শরবতের ব্যবস্থা করতে পারবেন? ”
“বকুলের শরবত কি জিনিস ভাই? এই জিনিসে কথা তো আগে কখনো শুনি নাই। কেও খাইতেও চায় নাই। ”
“এইটা বকুল ফুল দিয়ে বানায়। খেতে মিষ্টি। ভালো নাম……..
সুজন কথা শেষ করতে পারল না, দূর থেকে অনেকগুলো মানুষের পায়ের শব্দ শুনা যাচ্ছে। সুজনের বুকটা ধক করে উঠল। তবে আজই কি…….…।
মানুষ কি তার মৃত্যুর আগমন আগেই শুনতে পায়?একটা বড় ফাকা দিয়ে দেখা যাচ্ছে, আকাশটায় আলো কমে আসছে। প্রকৃতি আস্তে আস্তে তার নিজের আলো কমিয়ে নিচ্ছে।