বাউণ্ডুলে ১০ টি কবিতা
আয়েশা মুন্নি
১
এক ভরা বর্ষার প্লাবিত হাসি
আয়েশা মুন্নি
কবি’র কাছে এসে বাউণ্ডুলে মুচকি হাসল
এক ভরা বর্ষার প্লাবিত হাসি,
কিছুই বুঝতে না পেরে কবি নিজেও হাসল।
কবি’র চুলে গোঁজা ছিল কাঁঠালিচাঁপার ফুল;
বুকে রাখা কিংশুক ঘ্রাণ,
চোখে স্বর্গীয় দীপ্তি।
বাইরে তখন ঝিরিঝিরি বৃষ্টির গান…
মন্ত্রমুগ্ধ মাতাল হাওয়া,
চারদিকে বৈশাখী প্রলয়ের পূর্বাভাস।
কবি’র শাড়ির আঁচল নিয়ে বাউণ্ডুলের কৌতুহল ছিল…
শাড়ির ভাঁজে লুকিয়ে থাকা একহারা গড়নে তীক্ষ্ণ মায়া,
যেন গুরুদক্ষিণার প্রবল উচ্ছ্বাস।
কবিতা ছুঁতে যেয়ে আঙুলে ছোঁয়া…
কবি- চকিত, চমকিত
অতঃপর – অবিরত ক্যামেরার টিক শব্দ।
সেই থেকে কবি’র অজান্তে
হৃদয়ের অণুতে অণুতে
বাউণ্ডুলের বসবাস।
২
এ প্রেম শাশ্বত
আয়েশা মুন্নি
হে যুবক,তোমার বর্ণিল হৃদয়ে
আমার লালপেড়ে নীল শাড়ির মায়া,
লৌকিকতার চোখে দেখা
মানবিক প্রেম নয়,
বাউণ্ডুলে,এ প্রেম শাশ্বত।
তোমাকে ভালোবাসা
এ আমার গুণাবলী নয়,
তুমিও ভালবাসতে শিখ
দেখবে পৃথিবী মুষ্টিবদ্ধ…
মুক্ত চারণভূমিতে প্রেম খোঁজ না
অন্তর বিকশিত কর ধ্যানে
সুখ ঘুরপাক খাবে নিভৃতে
নিজেকে জানো,জানবে আমাকে।
তোমার শার্টের বোতামগুলো
আমার কবিতার অন্তমিল,
তোমার পদচিহ্নের ছাপে
ঢেলে দিয়েছি সবটুকু প্রেম…
বাউণ্ডুলে, এর পরেও আমি কী প্রেমিকা নই?
৩
প্রেমানন্দ
আয়েশা মুন্নি
তোমার সাথে রোজ দেখা নাই হোক,
অন্তত প্রতিদিন কথা তো হোক ।
তুমি শুধু রোজ বলবে ভালোবাসি– প্রেমানন্দে ভিজে যাবে তৃষ্ণার্ত মন…
দেখ বাউণ্ডুলে- ভালোবাসি না বললেই
আমার আকাশে দারুণ মেঘ জমবে
বজ্রবৃষ্টিতে পুড়ে যাবে তুমি,
তখন,কী করে সামলাবে এ আকাশ?
আমি তোমারই প্রেমী
তোমারই প্রেম পূজারী,
নতুন আবেশে মনোভূমে
নতুন প্রেমের প্লাবন।
সুতরাং,তোমাকে ভালোবাসি বলতেই হবে
নিয়ম করে প্রতিদিন কথা বলতেই হবে।
আমার তৃষ্ণার্ত এ মন তোমার গহীনে
জিইয়ে রেখো– ভিজিয়ে রেখো– আদরে।
৪
বাউণ্ডুলে মন
আয়েশা মুন্নি
তুমি বরং তোমার মতই থাকো
বাউণ্ডুলে মন নাইবা বেঁধে রাখো।
শত শত অলিগলি ঘুরে
আসিও আবার ফিরে।
বরং ভাল আর হবে না দেখা
রেস্তোরাঁতে দু’জন বসে থাকা ।
এই শহরে একাই তুমি ভেবো
আমিই বরং অন্ধ হয়ে যাবো।
আর হবে না তোমার কন্ঠ শোনা
পথটি চেয়ে তোমার সময় গোনা।
কিংবা তোমার হাতের ছোঁয়া পাওয়া
পোড়া মনে উঠছে প্রবল ধোঁয়া।
আজ আমি দুঃখে বিহ্বল
দুচোখ বেঁয়ে গড়িয়ে পড়ে জল।
রক্তচাপের যন্ত্রণাতে জেগে থাকি রোজ
নিচ্ছ না আর কেমন আছি কিংবা ঘুমের খোঁজ।
৫
ভালোবাসায় পাগলামি
আয়েশা মুন্নি
যদি চাই…
আমার হাসি দেখার পর তুমি অন্ধ হয়ে যাও
তবে কি ভুল হবে?
যদি চাই…
আমাকে স্পর্শ করে তুমি বোধটুকু হারিয়ে ফেল
তবে কি চাওয়াটুকু বেশি হবে?
ধর চাইলাম…
তোমার বুকে শুধু আমাকেই রেখ প্রশ্রয়ে
তবে কি তুমি আমাকে স্বার্থপর বলবে?
মনে কর…
তোমাকে জড়িয়ে ধরার আকাঙ্খা নিয়ে
যদি তলিয়ে যাই অতল গহ্বরে…
তোমার কি আফসোস হবে ?
তুমি কি আমাকে খুঁজবে?
আমাকে হারানোর দুখে বাউণ্ডুলে হবে?
আমার গোপন ইচ্ছেদের সাক্ষী হবে?
অকাল মৃত্যুর সাক্ষী হবে?
আচ্ছা — মনে কর…
আমার জন্য তোমাকে সবসময় ব্যস্ত রাখি…
এমন পাগলামি চাওয়ার নাম কি ভালোবাসা?
৬
সুখানুভূতির মৃত্যু
আয়েশা মুন্নি
তোমাকে ভালবেসে ইদানীং মরে যেতে ইচ্ছে হয়
আমাকে আলিঙ্গন করছে যেন মৃত্যু দূত
সেই মৃত্যু হয়তো সুখানুভূতির মৃত্যু।
আমার কানে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে আমারই কণ্ঠস্বর
তোমাকে ভালোবাসি, ভালোবাসি
বাউণ্ডুলে,তোমাকে ভালোবেসে আমি মৃত্যুই চাই।
৭
ভূমিপুত্র
আয়েশা মুন্নি
বুকের বদ্ধভূমিতে শতাব্দীর শূন্যতায়
প্রেমময় প্রহরে তুমি স্বস্তির নিঃশ্বাস।
মেঘ ভাঙা গহীন গন্তব্যের ধোঁয়াশা পথে
অদ্ভুত নক্ষত্রের আলোয় তুমি জোৎস্নার ঘ্রাণ।
উৎক্ষিপ্ত অধ্যায়ের বাউণ্ডুলে পঞ্জিকার পাতায়
কস্তুরী সুবাসে তোমার ধ্রুপদী পদচিহ্ন।
হে ভূমিপুত্র…
তোমার হৃদয় নিংরানো ভালবাসায়
সাজিয়ে দিও আমার সমাধি সৌধ।
৮
দ্বৈতাশ্রয়
আয়েশা মুন্নি
ভালো লাগার দৈর্ঘ্য প্রস্থে
মধুময় স্মৃতির রেখা টেনে দিয়ে
তুমি যখন গিলে খাচ্ছিলে সংযমী হৃদপিন্ড
তখন আমার অভূক্ত আবেগী মন
কখন যেন উদাসী হয়ে গেল।
তুমি বললে – ভালোবাসি, ভালোবাসি তোমায়।
আমি জানি না কতটা ভালোবাসা দিলে,
ভালোবাসা কতটা ভালোবাসতে শেখায়।
কখনো ডুব সাঁতারে ডুব দাও চুপিসারে
অভিমানে আমি তোমাকে দেই আড়ি
তখনো তুমি হেসেই বল, ‘বাউণ্ডুলে আমি
তবে ভালোবাসি সত্যিই ।
অন্য জীবনে…
বেঁচে থাকা মানে
অভ্যাসের সুখ।
তীব্র আকাঙ্ক্ষা…
চোখে মুগ্ধতা দেখা,
রূপের গুণকীর্তন শুনার।
সম্পর্কের বোঝাপড়ায়
কেবল জাগতিক প্রেম।
তবুও
কোথায় যেন সুতোর বন্ধন…
কোথায় যেন পিপাসিত টান…
ভালোবাসার জল জোছনায়
গাণিতিক সুত্রে চির অমিল।
অবশেষে,
দ্বৈতাশ্রয়ে জীবন।
জীবন কত ধুম্রময়।
৯
আমি আবার আমি হবো
আয়েশা মুন্নি
আমি এবার ভীষণ ভালো থাকবো, বাউণ্ডুলে।
মুছে দিবো অভিমানের দেয়ালের ধুলোপড়া স্মৃতি।
অবহেলার রঙিন চাদরে মুড়ে পোস্টারে পোস্টারে ঢেকে দিবো কষ্টের সেই দেয়াল।
যেন স্পষ্ট দেখা যায় তোমার মিথ্যা আশ্বাসের আঁকিবুঁকির সোপান।
আমি সব ভুলে যাবো ভীষণ ভাবে…
মুছে দিবো তোমার নামের উচ্ছলতা,
চির পরিতাপে।
আমি তোমার কাছে চেয়েছিলাম একটা চকচকে রোদ্দুর সকাল।
টলটলে জলে পদ্মফুল, যে নরম রোদে নেতিয়ে পড়ে নিশ্চিন্তে।
চেয়েছিলাম সেই সহজ জীবনের ধারাপাত। ভুঁইচাপার মতো সামান্য যত্নে বেঁচে থাকা…।
তোমাকে ভালোবেসে হতে চেয়েছি বিদূষিত,
হতে হয়েছি চন্দ্রমুখী, বিনোদিনী, হৈমন্তী।
আমি চেয়েছিলাম পার্বতীর অহংকারে অহংকারী হতে।
তাই,যে মরিচিকা ভালোবেসে ভুলেছি নিজেকে,ভুলেছি সবকিছু…
তা ছুড়ে ফেলে দিয়ে আমি আবার আমি হবো।
১০
অতঃপর দীর্ঘশ্বাস
আয়েশা মুন্নি
(ক্রিং ক্রিং ক্রিং)….
– হ্যালো, আমি পিউকাহা বলছি।
কেমন আছো, মনি ?
আশ্চর্য! চিনতে পারোনি তো ?
– খুব চিনেছি। মনি!
এই নামে পৃথাবীর একজনই আমাকে ডাকে। এতোদিন পর মনে পড়লো আমায় ?
– মনেই যার বাস, তাকে আবার নতুন করে মনে পড়বে কেন?
– আমায় তো দূরে ঠেলে দিয়েছ।
– দূরে আর যেতে পারলে কই?
– কাছেই বা আছি কই !
– কতবার ভেবেছি, দূরত্বকে কেটে হাওয়ায় উড়িয়ে দেই। যেভাবে তোমার দূরন্ত বাইকে তুমি দাপিয়ে বেড়াতে শহরময়। ঠিক ওভাবেই সময়ের দূরত্ব উড়ে বেড়িয়েছে আকাশময়, মেঘেদলের ভেলায়।
আর আমি ডানাকাটা আহত পাখির মতো ডানা ঝাপটিয়েছি। কিন্তু উড়তে পারিনি। জোর করে তোমাকে ভুলে থাকতে চেয়ে বুকের গহীনে বয়ে বেড়াচ্ছি ক্ষতচিহ্ন।
– এ তোমার অনুযোগের অনিচ্ছা। উড়ে চলার সক্ষমতা তোমার আছে।
– তা হয়তো আছে। উড়বার মত একটি আকাশ তো চাই, অনন্ত আকাশ। সে আকাশটাই তো আমার নেই।
– আছে। আকাশ আছে আকাশেই। পৃথিবীর উঁচু পাহাড়গুলোকে তুমি আকাশ ভেবে ভুল করছো। এ দৃষ্টির সীমাবদ্ধতা তোমার কখনোই শেষ হবার নয়।
– আমার দৃষ্টি তো চিরকালই সীমাবদ্ধ। পাখির ডানায় উড়ার সাধ থাকলেও উড়ে বেড়াবার সাহস আমার নেই, কোন কালেই ছিল না।
– হঠাৎ দীনতা প্রকাশ করলে যে? -আক্ষেপে !
– আমার দীনতার চরম সত্যগুলোই আমার দূর্বলতা, অক্ষমতা।
– এমন হতাশায় কি পুরোটা জীবন পার করে দিবে?
– ওই যে বললাম, কন্টক পথে হাঁটার মত সাহস আমার নেই। খোলা চোখে আর কতটাই বা দেখা যায়, বল? দৃষ্টি অনিত্য, কল্পনা নিত্য, অসীম।
– আমি তা স্বীকার করি না।
– তুমি তো চিরকালই বাউণ্ডুলে, তাই খণ্ড খণ্ড সু-সময়ের গহ্বরে নিজেকে ডুবিয়ে রাখতে পারো।
– জীবন তো একবারই।
ফেলে আসা অবারিত সু-সময় থেকে কয়েক খণ্ড না হয় নিজের ভালো লাগার অংশে রাখো।
– সে সাহস যে আমার নেই। আচ্ছা মনি, খানিকটা রবিবাবুর সেই-ই কবিতার মতো করে যদি বলি – আমাদের যা গেছে একেবারেই কি তা গেছে?
– পৃথিবীতে কোনো কিছুই একেবারে শেষ হয় না । যাওয়ার চেয়ে স্মৃতিতে থেকে যাওয়াটাই বেশি।
– হা হা হা। তুমি ছেলেভোলানো কথার মতো বললে। আমার মনে হয় কোন কিছুই অবশিষ্ট নেই। সবই কেবল গেছে আর গেছে।একটা আস্ত আয়ুষ্কাল গেছে।
– যা গেছে, তা নিয়তিতে যাওয়ারই ছিলো। যেটুকু সুখস্মৃতি, সেটুকুই চিরন্তন।
– আমি বুঝিনি। বোধগুলোও মরে গেছে হয়তো!
– আচ্ছা। আমাদের কী কী গেছে বলো তো?
সমাজ সংসারের ভয়ে দূরত্ব বেড়ে গেছে।
ক্রমান্বয়ে হাত ধরে মুখোমুখি বসে থাকা গেছে। স্পর্শ গেছে।
শিহরিত আবেগ গেছে। রাগ অভিমান, ভুল বোঝাবুঝি গেছে।
আমি তোমার কাছে আসবো বলে দেরি হওয়া অপেক্ষার প্রহরগুলো গেছে।
কিন্তু প্রেম? প্রেমও কি গেছে?
তোমার বুকে আমার জন্য বিন্দু বিন্দু জমিয়ে তোলা প্রেমও কি পুরোপুরি শেষ হয়ে গেছে মন থেকে?
অতঃপর…
– ওপাশে শোনার অপেক্ষা।
– এপাশে দীর্ঘশ্বাস।
– মনি, রাখছি … ভালো থেকো।
– তুমিও….