কবিতা বিষয়ক গদ্য “এ মরণ দুপুরে ”লিখেছেন সভ্যতা গড়ার অন্যতম সারথি ওপার বাংলার কবি ও লেখক অ ল ক জা না।

516

এ মরণ দুপুরে

—————————————————————–
                                অ ল ক জা না

ভালোলাগা কবিতা ও কবিতার বিশেষ বিশেষ কিছু মন ছুঁয়ে থাকা লাইনের তালিকা আমার মতো অনেকের আছে, এবং সেটা আমি মনেপ্রাণে বিশ্বাসও করি। ব্রহ্মাণ্ডের এতকিছু কর্মকাণ্ডের মধ্যে আমি কেবল কবিতা লিখতে চেষ্টা করি মাত্র। এই নেশা আমার ক্ষেত্রে এতটাই অন্তর্মুখীনতার প্রলেপ দিয়েছে যে, তাকে ভেদ করে না হতে পারলাম যোগ্য স্বামী, না আদর্শ বাবা না জোটাতে পারলাম স্থায়ী রোজগারের কোন চাকরি। কবিতার জন্য এই ত্যাগ কৃচ্ছ্রসাধন বাংলাসাহিত্যে নেহাতি বিরল ঘটনা নয়। প্রচুর প্রচুর ল্যাইব্রেরি ভর্তি কাহিনি সংরক্ষিত। নিজেকে সেই রকম দৃষ্টান্তের স্রোতে ভাসানোর ধৃষ্টতা নেই বটে কিন্তু অনেকটাই ব্যতিক্রমী। তো “আশায় বাঁচে চাষা” প্রবাদের জায়গায় আমি বলি : “নেশায় বাঁচে কবি।” আশা এবং নেশা শব্দ দুটোর মধ্যে অর্থগত ও চরিত্রগত তফাত কতটা তা সবারই জানা। সুতরাং আমি ব্যক্তিগত ভাবে নেশায় বাঁচি। এই নেশা যেদিন আমার মধ্যে সমস্ত রকম সক্রিয়তা বাদ দিয়ে, আত্মসমর্পণ করে বিকারগ্রস্ত হয়ে পড়বে, সেদিন আর আমার কোন প্রয়োজনীয়তা থাকা উচিত নয় বলে আমি মনে করি। এই লেখালেখি অনেককিছু কেড়ে নিলেও যেটুকু দিয়েছে তার জোরেই তো এখনো বুকভরে শ্বাস নিতে পারি।

“এ মরণ দুপুরে /যদি কেউ একগোছা ফুল দেয় /ভালোলাগে তাকেও” যত দূর জানি এই পংক্তিটির বয়স প্রায় দুই দশক হবে। এই গুটি কয় শব্দকে দশ বিশ পাতা বিশ্লেষণ করলেও বোধহয় অন্তরে অতৃপ্তি থেকেই যাবে। শুধু বলি : এই কথাগুলো আমার কাছে এক পরমব্রত নেশার মতো কাজ করে। তার ফলে হয়তো জীবনযাপনের বহুকিছু বিধিনিষেধ সহ্য করে ক্ষমা পেতে ও ক্ষমা করতে পরিস্থিতি শিখিয়ে পড়িয়ে নিয়েছে। হোক সে আমার শত্রু। আমার চোখেরবালি। আমার অন্তহীন অসাহায়তার মাঝে সে যদি এসে আমাকে বেঁচে থাকার বিশ্বাসটুকু জোগায় তাকে না ভালোবেসে কীভাবে থাকি। যতই নিষ্ঠুর হোক না কেন মৃত্যুকালীন মানুষ নির্ভেজাল সত্য ও সুন্দরের পূজারি। তো সমস্তরকম ছলনা বাদ দিয়ে সে তো বার বার ছুঁয়ে থাকা হাতটা আঁকড়ে ধরতে চেষ্টা করবে এটাই স্বাভাবিক নিয়ম। সেদিক দিয়ে আগে বলা শব্দমালা সেই নিরাময় দিকেরই নির্দেশ করে বলে আমার মনে হয়।

যে জটিলতা নিয়ে প্রহর খরচ করছি আমরা তাতে সর্বাধিক একটা অসহায়তা যেন ছায়ার মতো সর্বক্ষণের সঙ্গী আমাদের । তাকে এড়িয়ে যায়, সাধ্য কার ? কাজেই এই দীর্ঘ খ্যানখেনে মুহূর্তের পাড় ভেঙে একটু স্বস্তি আসুক, একটু ভরসা নিজের খেয়ালে ডানা মেলুক কে না চায় ? আর তা যদি বিপন্ন মানুষ একবারটি পেয়ে যায় তবে সেই বহনকারী শত্রু হোক কী মিত্র হোক ঈশ্বরের সম্মানে তাকে বসাতে আমি অন্তত দুবার ভাববো না। ভাইরাস এখন বাস করেছে জলে, বাদুড়ে। কোভিদ-১৯ কাছে হার মেনেছে মনের পোষ্য যাবতীয় ভাইরাস। ফলত সবাই এখন সচেতন হতে শিখছে যে কে কতখানি সংক্রামক ভবিষ্যতের জন্য সঞ্চিত রাখবে। কারণ বিপন্ন হাতের নখ, আত্ম-পর ভুলে গিয়ে আঁচড়ে রক্তপাত করে। সংক্রমণের পরই আমাদের চেতনা ক্রাইসিস অনুভব করে বেশি। তখন সবকিছু প্রায় হাতের বাইরে চলে যায়।

প্রাগশূন্যদশকের কবি লক্ষ্মীকান্ত মণ্ডল যথার্থই লিখেছিলেন এই অমোঘ লাইন। আজ কত সত্যি এবং প্রাসঙ্গিক। প্রতিটি রাষ্ট্র দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে এই আর্তি আবেদন, যেন প্রতিটি মানুষের শেষ উচ্চারণ। কিচ্ছু চাই না, জমিবাড়ি টাকা দরকার নেই কেবল বাঁচতে চাই। অভিশপ্ত করোনা মুক্ত জীবন নিয়ে আমরা বাঁচবো। বাঁচতে দাও হে দয়াময় পৃথিবী ! সুতরাং মরণ দুপুর, অর্থাৎ অসহ্য অসহায় সময়ে, যদি কেউ নতুন ভাবে ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য ভরসার ফুল দেয়, তবে বাঁচার আনন্দে সুন্দর বা কুৎসিত মিত্র বা ভাইরাস যাই হোক না কেন তাকে ভালোলাগার ইচ্ছে একটি সহজাত সম্পদ। তো সুযোগ এলে তার যোগ্য ব্যবহার আমি করতে জানি।

Content Protection by DMCA.com

1 COMMENT

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here