নোঙর
অলক জানা
পুরাদস্তুর আত্মমগ্নতা নিয়ে থাকলে একটি দীর্ঘ সময় কখন যে কিভাবে স্তব্ধতায় পেছনে চলে যায়, সত্যিই তা বোঝা কঠিন। প্রভাবিত করেনা বললে ভুল বলা হবে, তবে তার আয়ুষ্কাল অতি অল্প। ফলত সবকিছু ঝেড়েঝুড়ে আবার সেই চিন্তনের আবর্তে ডুবসাঁতার। এর নাম নিয়তি কিংবা প্রিয় দহনরেখা ! এখান থেকে কে বেরুতে চায় ? ভালোলাগা কি বলেকয়ে আসে, না তার চোখ থাকে ? না বয়স মানে। সবই আগেভাগে সাজানো, যাকে বলে পূর্বনির্ধারিত।
প্রিয় দহনের বরমাল্য গলায় ঝুলিয়ে মনমাঝি কেমন দুঃখব্যাপারী হয়ে ওঠে। তাকে আমৃত্যু বয়ে বেড়ানোর কষ্টের মধ্যে হয়তো অপার আনন্দ ছিলো। এই দহনই তো সবকিছুর যথার্থ চালিকাশক্তি। এত গান এত ছবি এত পদ্য কী এমনি এমনি, মনে দানা বাঁধে ? আর লিখে ফেলা অতিশয় সহজ কাজ ? নতুন বৌঠান, রাণু, নীরা, বনলতা সেন কিংবা ক্রমা সব জানে সব বোঝে। তাই তো কবি বিষপান করার দুঃসাহস দেখাতে পারে। আর অনাবাদী অন্ধকারে রুয়ে দিতে পারে আলোর গুচ্ছ গুচ্ছ বনস্পতি।
ক্রমা কে জানিনা তো ? যদ্দূর জানি, যদুপতি কৃষ্ণের সঙ্গে ওর দেখা হয়েছিল। বাকি থাকেননি বিসমিল্লা এবং যীশুও। তবে হ্যাঁ প্রতিদিনই আমাদের মুখোমুখি হয়তো দেখা হয়, আমার চোখ চিনতে পারে কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় এটাই, ক্রমা আমাকে চিনতে পারে না। নাকি চিনেও সচেতন এড়িয়ে যায়। ও তো জানে নিজেকে অনিঃশেষ বিলিয়ে দেয়ার মধ্যে কোন ক্ষয় নেই, কোন কৈফিয়ত কখনো কাওকে দেয়ার দরকার পড়েনা।
মন্দির থেকে মসজিদ, গির্জা থেকে পিরামিড ও ঘুরে বেড়িয়েছে আপ্রাণ। একই ঝুলিতে গীতা,কোরান, বাইবেল নিয়ে হেঁটে এসে জানান দিয়েছে : কেবল আমি এবং আমার প্রেমিক সত্য। বিকলভূত-রাষ্ট্র ও রাজনীতির ওপরে দাঁড়িয়ে বলতে শুনেছিঃ কাজ অমরত্ব পায়, শরীর নয়। ভোরের আজান আর সন্ধ্যারতির মতোই উদাস ও চির প্রাণবন্ত। তবুও আমাদের মধ্যে অটুট ব্যবধান, দীর্ঘ দালান কে আর পেরুতে চায় ? এই স্বচ্ছ দহনটা না হয় থাকলো নীরবেই। এখানেই আমি ও আমার মন থিতু। প্রেমে প্রত্যয়ে। সেই আদি অনন্ত যুগ থেকে আজতক। আমার আমি জীবিত পাগল নাকি একটা আস্ত উন্মাদ।
মনকে একটা জায়গায় থিতু করা মানেই তো কিছু বিরতি অথবা নোঙর করা। কত স্রোত, কত সময় পেছনে চলে যায়। আমিও আজকাল বুড়ো হচ্ছি। কতকিছুই না ভুলে যাই, ভুলে যেতে বসেছি। তবুও মনের অবস্থান একটি জায়গায় অনড়। যেন পণ করে বসে আছে এই নোঙর চিরকালের কিংবা অনন্ত সময়ের জন্য ব্যক্তিগত সত্যে অপরিবর্তিত ধ্রুবক। এ থেকেই যায় ললাটের বলিরেখার মতো। কোন দুষ্টুমি নেই, একে ত্যাগ করাও তো যায় না।
এই নোঙরের ভেতর সমস্ত পরমায়ু কেমন ক্রমশ আলতাপাটি চরের মতো ক্ষয় পেতে পেতে— একদা অদৃশ্য ডুবে গেলেই কাহিনিটি তীর্থমগ্ন হয়ে যায়। আগামীর পাঠক যদি কখনো কোনদিন কেঁচোগন্ডুষ করে প্রতিটি অন্তর্মুখী এই আত্মমগ্নতা একক নয়, সম্পূর্ণ সামগ্রিক। রবীন্দ্রনাথের নতুন বৌঠান কিংবা রাণু মুখোপাধ্যায়, জীবনানন্দের বনলতা সেন, সুনীলের নীরা একটা তীর্থের নাম কিংবা আত্মমগ্নতা। যেখানে মন চিরতরে থিতু, মানে নোঙর করে আজ আকাশের ধ্রুবতারা হয়ে গেছে।
সুন্দর লেখা। অভিনন্দন জানাই।🙏❤️