আব্বা আর ফিরলেন না
সাহানুকা হাসান শিখা
সেদিনের সেই ভোর বেলার কথা এখনও মনের
মাঝে সুখের মালা গাঁথা। এই বাড়িটি ছিলো
আমার মামানীর বাপের বাড়ি,আমার মামার শ্বশুর
বাড়ি। আমাদের সেখানে গিয়ে আশ্রয় নিতে হয়েছিল
স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়, আমি তখন খুবই ছোট
ছিলাম, তবুও ছোট বেলার কিছু কিছু স্মৃতি গভীর
ভাবে মনের মাঝে লুকিয়ে থাকে,এবং বিশেষ দিনে
বিশেষ মূহুর্তে এসে কড়া নাড়ে।
যুদ্ধে শুরু হয়ে গেছে,আব্বা আমাদের নিয়ে
খুব চিন্তিত, আমরা সবাই ছোট ছোট। আম্মা আমাদের নিয়ে একা একা কি করবেন ভেবে অস্থির।
আমার আব্বা ছিলেন,চা বাগানের একজন কর্মকর্তা।
আব্বা কোন অবস্থাতেই বাগান ছেড়ে যেতে পারছেন
না, সে সময় তিনি চা বাগানের ইনচার্জে ছিলেন
বাগানের সব হিন্দু স্টাফরা পাশ্ববর্তি সীমান্ত দিয়ে
ভারতে চলে গেছে, লেবাররাও সবাই চলে গেছে।
পুরো বাগান মানব শূন্য,যেন ভূতুডে নগরী।
বস্তির লোকেরা বাগানের জিনিস লুটপাট শুরু
করছে,আব্বার উপর অনেক দায়ীত্ব।
আব্বা সিদ্ধান্ত নিলে আমাদের মামার বাড়ি পাঠিয়ে
দিবেন, উনি বাগান নিয়েই থাকবেন।এক দায়ীত্ব
বান মানুষ যা করেন। আব্বা তাই করলেন।
আমরা চলে গেলাম সিলেটের ফেন্চুগন্জের কাজী
বাড়ি আমার মামার বাড়িতে। সেখানে মামা মামানী
খালা সবাই ছিলেন। বিরাট বড় বাড়ি।
আব্বা প্রতি সাপ্তাহে আসতেন আমাদের সাথে দেখা
করতে,একদিন থেকে আবার চলে যেতেন।
যাওয়ার সময় আমি আব্বার গলা জড়িয়ে ধরে কান্না
করতাম,আব্বাও পকেট থেকে সাদা রুমাল বের করে
চোখ মুছতে মুছতে মামার বাড়ির পুকুর পার দিয়ে
হেঁটে হেঁটে ট্রেইন স্টেশনের দিকে চলে যেতেন।
শনিবার এলেই পুকুর পারে গিয়ে দঁাডিয়ে থাকতাম
দুপুরের ট্রেনটি আসার সময় হলেই।
কখন আব্বা আসবেন, হঠাৎ চোখে পড়তো, আব্বা
সাদা সার্ট আর কালো পেন্ট কাঁদে বাদামী কালারের
বেগ ঝুলিয়ে, কালো ছাতা নিয়ে হাসতে হাসতে আসতেন, আমি দৌড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরতাম,
বুকে জড়িয়ে ধরে বলতেন,এত রোদে দাডিয়ে
কেন মা ? মাথা ব্যথা করবে তো!!
“”বাবা চলে যাওয়ার পর মাথার উপর দিয়ে কত রোদ চলে গেছে,কেউ আর কখনও বাবার মত করে বলে নাই, মাথা ব্যথা করবে তো।”
তারপর ধীরে ধীরে যুদ্ধ বাড়তেই থাকলো,রেল
সড়ক যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেল, ডাক, তার সব
বন্ধ। আব্বার সাথে আমাদের আর কোন যোগাযোগ
নেই,তখনকার যোগাযোগ ব্যবস্থা তো আর এখনকার
মত ছিলো না। আম্মা ভীষণ অশান্তির মধ্যে সময়
কাটাতে লাগলেন, কোথায় কোন জানা শুনা লোকের
খবর পেলেই সেখানে ছুটে যেতেন,আব্বার খবর
জানার জন্য।
হঠাৎ একদিন দুপুর বেলা আম্মা দৌড়াতে দৌড়াতে
এসে ঘরে ঢুকলেন, আর মামানীকে জড়িয়ে ধরে
বিলাপ করে কান্না শুরু করলেন,কিছুই বুঝতে পারলাম না আমরা,আম্মার সাথে সাথে কান্না শুরু
করলাম।সবাই আম্মার মাথায় পানি দিচ্ছে।
মামা বাজার থেকে এসেই সেই লোকটির কাছ থেকে
সত্যটা যাচাই করার চেষ্টা করলেন।
পাশের বাড়ির একটি লোক এসেছে ঐ জায়গা থেকে। সে সেখানকার একজন হুজুরের কাছে শুনেছে আব্বাকে মিলিটারীরা ক্যাম্পে নিয়ে গিয়ে গুলি করে হত্যা করেছে।
দিন যায় রাত যায় আব্বার সাথে আমাদের আর কোন যোগাযোগ হয় না। রাস্তা ঘাট সব বন্ধ
চারিদিকে পাকিস্তানী মিলিটারী ঘিরে রেখেছে।
যাই হোক আসল কথায় আসি, শুরুতে সেখানে পাকসেনাদের উৎপাত ছিলো কম, পরবর্তিতে
অবস্থা খারাপ হওয়ায় আমারা সেখান থেকে, মামানীর বাপের বাড়ি একটু গ্রামের দিকে, সেখানে
নিরাপদে আশ্রয় নেই।
দুইদিন আগে সেই বাড়িতে এসেছি,সবাই খুব ভালো
আমাদের অনেক আদর করেন।রোজ রাতে শুয়ে
শুয়ে আব্বার জন্য কান্না করতাম।
একদিন খুব ভোরে আব্বার গলার আওয়াজ শুনে ঘুম ভাঙ্গলো, বুঝতে খুবই কষ্ট হলো স্বপ্ন নাকি সত্যি।দৌড়ে বাইরে এসে দেখি সত্যিই তো আব্বা
বাগানের দুজন পাহারাদার কে সাথে করে নিয়ে
হাজির,সেই শমশের নগরের শুন ছড়া বাগান থেকে
পায়ে হেঁটে ফেন্চুগন্জের ঘিলাছড়া গ্রামে এসেছেন।
জড়িয়ে ধরে বললাম আব্বা আমরা এতীম ছিলাম
এতদিন। তুমি বেঁচে আছো কল্পনাও করতে পারি নাই
খুশিতে সেদিন যে কেমন লাগছিলো বলে বুঝাতে
পারবো না।
এরপর আরও একবার ১৯৮৩ পঁচিশে এপ্রিল খবর
পেলাম আব্বা নেই, আবারও কান্না করলাম।
কিন্তু আর কোনদিনই আব্বা ফিরে এলেন না
আজও অপেক্ষায় অপেক্ষায় চোখের জল ফেলি।
আর সেই ভোর আসে না আব্বার গলার আওয়াজ
শুনতে পাই না।
রাব্বির হামহুমা কামা রাব্বাইনি ছগিরা।