বিভূতিভূষণ স্মৃতি পুরস্কার প্রাপ্ত লেখিকা ও কবি সুজাতা দাস এর লিখা ছোট গল্প “জয়ী”

636
বিভূতিভূষণ স্মৃতি পুরস্কার প্রাপ্ত লেখিকা ও কবি সুজাতা দাস এর লিখা ছোট গল্প “জয়ী”

জয়ী

           সুজাতা দাস

আরে!! কখন থেকে ফোন করছি, রিং হয়েই যাচ্ছে ফোনটা তুলছো না কেন?
বলল অনিত-
শপিং করতে করতে ফোনটাকে ব্যাগের কোন পকেটে রেখেছিলাম খুঁজেই তো পাচ্ছিলাম না, তার উপর প্রায় এক ঘন্টা ধরে ট্যাক্সি স্ট্যান্ডে দাড়িয়ে আছি লট’বহর নিয়ে-
একটা কাজ করো ওখানেই দাঁড়াও, আমি আধ ঘন্টার মধ্যে চলে আসছি বলল অনিত-
প্রায় দু’ঘণ্টা হতে চলল কিন্তু তখনও অনিত এসে পৌছালো’না দেখে, প্রচন্ড রাগ হতে থাকলো প্রথমে তারপর ভয়-
প্রায় নটা বাজতে চলেছে দোকানপাট বন্ধের পথে, রাস্তাও ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে-
প্রচন্ড ইরিটিটিং লাগছিল এই দাঁড়িয়ে থাকাটা তনিমার কাছে,
পাঁচ বছর অনেকটা সময় কোলকাতা থেকে অনেকটা দুরে একা দিল্লিতে ছিল তনিমা কোনও ছুটি ছিলনা তাই আসতেও পারেনি কোলকাতায়-

চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে ভাবছিল অনেক পাল্টে গেছে কোলকাতা এই কয় বছরে, আজ নিউ মার্কেট এসে সেটা আরও ভালো করে বুঝতে পারলো তনিমা-
এই পাঁচ বছর বিশেষ ট্রেনিং এর জন্য কোলকাতায় আসতে পারেনি ছুটিতে তনিমা, কিন্তু অনিত চলে গেছে ঠিক দিল্লিতে ছুটি ছাঁটায়-
ভালো লাগতো খুব সেই সময় অনিতের সান্নিধ্য তনিমার, যদিও খুব সামান্য সময় দেখা করার পারমিশন মিলতো-
অনেক কষ্টকর ছিল এই বিশেষ ট্রেনিংএর সময়টা, হঠাৎ করে তাকেই কেন দেওয়া হলো এই ট্রেনিং কিছুই জানতে পারেনি প্রথমে তনিমা-
তবে ট্রেনিং শেষে যখন তার হাতে চিঠিটা এলো তখন অবাক হয়ে অফিসারের দিকে তাকিয়ে বলেছিল, স্যার আমি!!

হু আপনি, আপনাকেই সিলেক্ট করেছিল স্পেশাল ব্রাঞ্চ’ কারন আপনার মধ্যে সেই যোগ্যতা আছে মিসেস ভট্টাচার্য্য-
চিঠিটা হাতে নিয়ে ফিরে যাচ্ছিল পাঁচ বছর আগের সেই দিনটাতে, যেদিন জানতে পেরেছিল তাকে পাঠানো হচ্ছে বিশেষ ট্রেনিং’এর জন্য দিল্লি-
তখন সবে বিয়ে হয়েছে তনিমার, খুব মন খারাপ ছিল যেতে হবে বলে এই বিশেষ ট্রেনিং’এ-
একটা সময় চাকরি ছাড়ার কথাও ভেবেছিল তনিমা, শাশুড়ি কী ভাববেন যদি অপছন্দ করেন-
নানা ভাবনা তনিমাকে ঘিরে থাকতো,
তবে অনিত সবসময় সহযোগিতা করেছে এই ব্যাপারে-
একপর্যায়ে অনিতই জোর করে পাঠিয়েছিল এই ট্রেনিং নেওয়ার জন্য, বলেছিল নিজের জন্যও এই ট্রেনিং প্রয়োজন পরতে পারে কখনও তনিমা-
তাই প্রস্তুত হও, শাশুড়িও অনেক খুশি ছিল
তার এই চাকরির ব্যাপারে, এয়ারপোর্টের ঢোকার মুখেও বলেছেন ভয় কী মা ঠাকুর থাকবেন তোমার সাথে-জয়ী হয়ে এসো-

সম্বিত ফিরলে বারবার ফোন করতে থাকলো কিন্তু কিছুতেই পাচ্ছে’না অনিতের ফোন, রাত বাড়তে থাকায় অসহায় বোধ করতে থাকলো তনিমা-
আসলে অনেক বছর পর কোলকাতায় বলে হয়তো এই অসহায়তা-
এবার নিজেকেই বাড়ি ফেরার চেষ্টা করতে হবে মনে মনে ভাবলো তনিমা আর অনিতের জন্য দাঁড়ালে চলবে না-
ভেবে রাস্তায় পা বাড়াতে গিয়ে দেখলো, কয়েকটি ছেলে ওর দিকে তাকিয়ে কিছু বলছে নিজেদের মধ্যে-
না’দেখতে পাওয়ার ভঙ্গি নিয়ে এগোতে থাকলো ট্যাক্সিস্ট্যান্ডের দিকে তনিমা-
হঠাৎ ওদের মধ্যে থেকে দুটো ছেলে এগিয়ে এসে বলল, ম্যাডাম আসুন কোথায় যাবেন বলুন আপনাকে পৌঁছে দিচ্ছি সেখানে-
ভয়ে গলা শুকিয়ে গেলেও ঘুরে তাকিয়ে মিষ্টি হেসে বলল, তার দরকার হবেনা ভাই, আপনারা যান আমার স্বামী আসছেন-
হঠাৎ একটা ছেলে তনিমার হাত ধরে বলল আরে ভয় পাবেন’না, আমরা সত্যিই পৌছে দেবো আপনি যেখানে যাবেন-

প্রচন্ড রাগে তনিমা অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখলো সেই ছেলেটির দিকে যে তার হাত ধরেছিল, একটা বিশ্রী হাসি ছেলেটির সারা মুখে ছড়িয়ে পরছিল যেখানে কিছু নোংরা ইঙ্গিত ঘুরে বেড়াচ্ছে-
মুখের দিকে তাকিয়ে একটা ভয় তনিমার শিরদাঁড়া বেয়ে নামতে থাকলো কিছুক্ষণের জন্য, পরক্ষণেই এক হ্যাঁচকা টানে জামাকাপড়ের ব্যাগ শুদ্ধ মাটিতে শুইয়ে দিল ছেলেটিকে-
রাস্তায় শুয়ে অবাক হয়ে তাকালো ছেলেটি তনিমার দিকে, ততক্ষণে দ্বিতীয় ছেলেটি এগিয়ে আসতে শুরু করেছে তনিমার দিকে-
হঠাৎ প্রথম ছেলেটি উঠে দাঁড়াতে গিয়ে দেখলো দ্বিতীয় ছেলেটি নাক চেপে শুয়ে পরেছে রাস্তায়, তার আঙুলের ফাঁক দিয়ে গলগল করে রক্ত বেড়িয়ে আসছে-
ততক্ষণে যে’দুই একজন রাস্তায় ছিল তারা
ছুটে আসছিল তনিমার দিকে কী’হয়েছে দিদি বলে ব্যাপারটা বুঝতে-

হঠাৎ তনিমা চিৎকার করে অন্যদিকে দাড়িয়ে থাকা আরও দুই জনকে ডাকতে থাকলো ক্ষমতা থাকলে সামনে আয়, সব মহিলাই অসহায় নয় বুঝলি-
ছুটে আসা লোকগুলোর থেকে কয়েকজন বিপরীত দিকে ছুটলো ছেলে দুটিকে ধরার জন্য-
তাই দেখে ছেলেদুটি এই দুই জনকে ফেলে চোঁচা দৌড় দিলো নিজেদের বাঁচাতে, তবে দুজনেই অবাক হয়ে তনিমাকে দেখছিল পালানোর সময়েও-
রাস্তায় পরে থাকা দুজনকে ছুটে আসা লোকগুলোই পোস্টের সাথে শক্ত করে বেঁধে রাখলো, হঠাৎ পুলিশ ভ্যানের সাইরেনে চমকে তাকালো তনিমা-
এদের মধ্যে থেকেই কেউ থানায় খবর দিয়েছিল হয়তো-
ওখানকার থানার ডিউটি অফিসার সাথে সাথেই সেই জায়গায় এসে পরেছেন দেখলো তনিমা –
ততক্ষণে হাত ঝেড়ে তনিমা নিজের ছড়িয়ে যাওয়া ব্যাগগুলি গুছিয়ে তুলছিল রাস্তা থেকে-

জীপ থেকে নেমে, হঠাৎ কী হয়েছে এখানে? জিজ্ঞাসা করলো সেই অফিসার-
গলার আওয়াজ শুনে মাথা তুলে তাকালো তনিমা, তনিমাকে দেখে হঠাৎ ছুটে এলো ঐ অফিসার তনিমার দিকে-
ম্যাম আপনি এখানে কী করছেন?
একটু হেসে তনিমা বলল কিছুনা শপিং করতে এসেছিলাম অনিরুদ্ধ-
তাড়াতাড়ি তনিমার হাত থেকে ব্যাগ গুলো নিয়ে ডান হাত দিয়ে স্যাল্যুট জানালো অনিরুদ্ধ-
তনিমা অনিরুদ্ধর দিকে তাকিয়ে বলল ঐ দুটোকে লকআপে ঢোকানোর ব্যবস্থা করো অনিরুদ্ধ, সবকটা বড়লোক বাবার বখে যাওয়া ছেলে-
যেন বেল না’পায় কোনও ভাবেই-
সাথে যেগুলো ছিল তাদেরও ঢোকানোর ব্যবস্থা করো, কাল সকালে আমি আসছি
পুলিশ স্টেশনে-
আপনি কোলকাতায় কবে এসেছেন দিল্লি থেকে ম্যাম? জিজ্ঞাসা অনিরুদ্ধর-

দিন তিনেক হলো অনিরুদ্ধ, একটা মানুষকে পোষা’কী চাট্টিখানি কথা অনিরুদ্ধ বলে হাসতে থাকলো তনিমা-
কী’যে বলেন ম্যাম, বলল অনিরুদ্ধ হাসতে হাসতে-
আমার পোস্টিং কোলকাতায় হয়েছে অনিরুদ্ধ, পরশু থেকে মুখ্যমন্ত্রীর বডিগার্ড হিসেবে-
ম্যাম, আপনাকে আমি পৌছে দিচ্ছি বলল অনিরুদ্ধ,
উত্তর দিতে গিয়ে হঠাৎ খেয়াল করলো অনিত হাত দেখাচ্ছে গাড়ি থেকে, প্রচন্ড রেগে গিয়েও একটা সস্তির নিঃশ্বাস ফেললো তনিমা-
পিঠের শিরদাঁড়া বেয়ে নামা ঠান্ডা রক্তের স্রোতটাও যেন গরম হয়ে গেছে আস্তে আস্তে কখন যেন-

ততক্ষণে গাড়িটা একেবারে তনিমার সামনে, অনিরুদ্ধকে টাটা করে গাড়িতে উঠে বসলে অনিরুদ্ধ এসে প্যাকেটগুলো গাড়িতে দিয়ে অনিতের সাথে সৌজন্য মুলক কিছু কথা বলল-
সেই ফাঁকে তনিমা দেখলো ছেলে দুটিকে জিপে তুলে নিয়েছে কনেস্টবল দুজনে-
একটা হালকা অথচ জোরে নিঃশ্বাস নিলো তনিমা তারপর দরজা খুলে সামনে এসে বলল সরে বোসো আমি ড্রাইভ করি-
একটু হেসে সরে গেল অনিত ড্রাইভিং সিটে থেকে পাশের সিটে নিশ্চিন্তে, কারন ব্লাকবেল্ট হওয়ার সাথে সাথে ড্রাইভার ও খুব ভালো তনিমা তাই খানিকটা নিশ্চিন্তও।।

কপিরাইট@1443 সুজাতা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here