“স্মৃতি তুমি বেদনা ”গল্পটি লিখেছেন কলমযোদ্ধা শাহিদা ইসলাম

673
“স্মৃতি তুমি বেদনা ”গল্পটি লিখেছেন কলমযোদ্ধা শাহিদা ইসলাম

স্মৃতি তুমি বেদনা

                    শাহিদা ইসলাম

দূর থেকে হঠাৎ স্যারকে দেখতে পেলাম।লেকের ধারে একটা ফাঁকা বেঞ্চে বসে আছেন।একা,বয়েস কত হল? হিসেব কষে নেই মনে মনে।আমি সবে রিটায়ার করেছি।সিক্সটি প্লাস। নাইন্টিন সিক্সটিফাইভে পনেরো বা ষোল হবে যখন এইস এস সি পাস করে ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হলাম।তখন সবে স্যার জয়েন করেছেন।ঝকঝকে তরুণ, বয়স ত্রিশের নীচেই। ডক্টর আশরাফ আলি।আমাদের প্রিয় শিক্ষক,যেমন সুন্দর দেখতে, তেমন চমৎকার পড়াতেন।উনি নিতেন বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস। রোমান্টিক রবীন্দ্র কাব্য নয়,bongkim বর্ণময় উপন্যাস ও নয়।সাহিত্যের নীরস ইতিবৃত্ত। চর্ষাপদ থেকে মনসামঙ্গল পেরিয়ে মাইকেলের খটমট সনেট।সেই শুস্ক কান্ঠসমূহকে তিনি তরুবর বানিয়ে ক্ষান্ত হননি, অত্যাশ্চর্য ব্যাখ্যা এবং বাচনভংগির রসসিঞ্চনে শুকনো ডালে কিশলয় পর্যন্ত গজিয়ে তুলেছিলেন। ফুলের পল্লবে ঝলমল করে উঠতো তাঁর বক্তৃতার ডালি। চর্ষাপদ পাঠ করতেন এমন চমৎকার -সংগীত। মনসামঙ্গলের এক একটা অধ্যায় উদ্ভাসিত হয়ে উঠত ওঁর গাঢ় উচ্চারণে।
হিসেব করছিলাম ওঁর বয়সের।যখন জয়েন্ট ডিপিআই হিসাবে রাইটার্স থেকে রিটায়ার করলেন,তখন আমি সবে রিডার হয়েছি,পনোরো বছরের অধ্যাপনার অভিজ্ঞতা নিয়ে।অথৎ , আমি তখন চুয়াল্লিশ মতো।
রিসার্চের পর পিএইচডি ডিগ্রী নিয়ে কলেজে ঢুকতে দেরি হয়ে গিয়েছিল,প্রায় ঊনত্রিশ। এখন আমি অবসর নিয়ে ফেললাম।অথাৎ , উনি এখন পঁচাত্তরের আশেপাশে।বয়স অনুপাতে স্বাস্থটা ভালই আছে মনে হচ্ছে।আগে ক্লাশে দেখতাম ক্লিনসেভ, স্মার্ট হ্যান্ডসাম বয়।এখন লম্বা চুল দাড়িতে চমৎকার দেখাচ্ছে আর্য ঋষি।
কাছে গিয়ে খুব জানতে ইচ্ছে হচ্ছিল শুভর কথা, আমাকে নিয়ে বহুবার পালাতে চেয়েছিল,স্যারের আদর্শের কথা নিতীর কথা মাথায় ঘুরপাক খেতো।
যাক পুরানো ক্ষতটাকে খুঁচিয়ে আবার কিছুটা রক্তক্ষরণ হবে,কিন্তু স্যারের তো দোষ ছিল না,শুভ নিজে থেকেই আমার বুকের ভেতর চিরস্থায়ী ক্ষতটা তৈরি করে ফেলেছিল নিজের অজান্তেই। অল্প বয়সে দুজনাই দুজনার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছিলাম, কারণে, অকারণে মন খারাপ হতো,সহপাঠী দুজনা,তবু ওকে কার সংগে একটু ঘনিষ্ঠ হতে দেখলে মাথায় রক্ত উঠে যেতো,ক্লাশে আশরাফ স্যার এলে ক্লাশ হয়ে যেতো পিন পতন সাইলেন্স, কখন স্যার শুরু করলেন,আর কখন শেষ করলেন? তন্ময় হয়ে শুনতাম।সেই আমি হয়ে গেলাম অমনোযোগী।কারণ শুভ, সেই সময় থেকে আমি ছোট ছোট কবিতা, গদ্য পদ্য লিখে বন্ধু মহলে বেশ নাম করেছি,সবাই ডাকতো উঠতি কবি।
এই লেখালেখির কারণে স্যারদের নজরে পড়ে গেলাম,আমার ভক্তের সংখ্যা বাড়তে লাগল,প্রেরণা পেলাম শুভর,সেই আমাকে তাগাদা দিত,কই নতুন লেখা দাও, ক্লাশে ঢুকেই স্যার জানতে চাইতেন,মিনু তোমার নতুন কিছু ছাপা হয়েছে? লিটন ম্যাগাজিন, সচিত্র বাংলাদেশ, এমন কিছু নামীদামি পত্রিকায় আমার লেখা ছাপা হতো,কিন্তু সবার দেয়া খেতাম উঠতি কবি, এই কবি নামটা ঠিক আমার জন্য বেমানান মনে হতো,কবি হওয়া কি সহজ ব্যাপার? সেই যোগ্যতা অর্জন করা অসম্ভব, দুই চার লাইন লিখলেই কবির খেতাম পাওয়া যায় না,আজও। নিজেকে কবি ভাবতে পারি না।
অনার্স সেকেন্ড ইয়ার,হলের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে শুভ যে কবিতাটি আবৃত্তি করেছিল,সেটা এই অধমের রচনা।ওর উপস্থাপনার মুন্সিয়ানা নাকি আমার লেখার প্রাসাদগুণ,, তার পর থেকে ক্যাম্পাসে দু’জনাই বেশ বিখ্যাত হয়ে পড়লাম। সব চেয়ে মজার ব্যাপার যেটা কেউ কাউকে ঠিক মতো ভালোবাসার কথা বলতে পারতাম না। সহপাঠীরা বুঝতে পারত,কিন্তু শুভ কেমন যেন লাজুক প্রকৃতির ছিল,মাঝে মাঝে ক্যাম্পাসের মাঠে একা বসে থাকতাম,পাশে এসে বসে কবিতার প্রেমে পড়ে যেতো,আমি অপেক্ষা করতাম,ভালোলাগার মানুষটির সাথে একটু ফ্রি হোক, ভাল লাগা প্রকাশ পাক,মাঝে মাঝে অবাক হতাম,আমি দেখতে সবার নজর কাড়ার মত না হলেও সুন্দর মনের অধিকারী ছিলাম,অন্য ছেলেরা সাহস করে বসার ইচ্ছা প্রকাশ করতে পারতো না।
বাবার আদুরে দুলালি কন্যা,গাড়ি দিয়ে আসা যাওয়া করি,পোশাক একটা দুই দিন পরি না,এটা আমার বিলাসিতার মধ্যে পড়তো
ছোট বেলা থেকেই সৌখিন ছিলাম, তবে অহংকারী না,হিংসুক না,সবার প্রতি ভালোবাসা উদারতা ছিল অসীম।
আমার সহজ সরল ভালোবাসার মনে পুরাটাই জুড়ে নিল শুভ।শুভ আপন করে নিয়েছিল আমার কবিতাকে, আমাকে নয়।
শুভর ভিতরে জ্ঞান ছিল,মেধা ছিল।
ছিল না কোন বিলাসিতা, কোন প্রাচুর্য অতি সাধারণ ঘরের ছেলে।মেসে থেকে নিন্মমানের জীবন যাপন করতো।
শুভ আমার কাছে এলে মনে হতো রাজপুত্র, বুকের মধ্যে বাদল বেজে উঠতো,ইচ্ছে হতো শুভর হাত ধরে ঐ আকাশে উড়ি।এবং স্বপ্নভংগে প্রপাত ধরণীতলে ধপাস,বেশ কিছুদিন ধরে শুভর দেখা নেই,হঠাৎ একদিন হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলো,আমি ক্লাশে ছিলাম,আমাকে ইশারা করল, বাইরে এসো।
আমি ক্লাস শেষ করে বেড়িয়ে এলাম,কি সিনেমা দেখতে যাবে,জানতে চাইলাম। আমি ওঁর হাতে একটা কার্ড দেখতে পেলাম, তাতে কোন প্রোগ্রামের টিকেট ছাড়া কিচ্ছু না,আমার হাতে কার্ড দিয়ে বলল মিনু তুমি কিন্তু আসবে,আমি তোমাকে স্পেশাল ভাবে আশা করব,আমি কিছু বোঝার আগেই শুভ চলে গেল। কিছু বোঝার বা বলার অবকাশ রইল না। কার্ড খুলে পাত্রীর নাম দেখে চক্ষু চড়কগাছ,স্যারের সদ্য বিধবা বোনের নাম জেসমিন সুলতানা,
কি কারণে এই রকম একটা কাজ হতে যাচ্ছে যাকে চিনে নাই জানে নাই,তার সাথে বিয়ের সম্পর্ক।মনে মনে ভাবলাম,নিজের ইচ্ছায়? নাকি অভিভাবকদের যোগাযোগের পরিণতি – সেটা জিজ্ঞেস করে নেওয়ারও প্রবৃত্তি হল না।
আমি যাইনি।
তাতে কিছু যায় আসেনি। আমার মত মেয়ের বিয়েতে যাবার প্রয়োজন নেই,কার কাছে আমার কথা জানতে চেয়েছিল কিনা তাও জানতে চাই নাই।
আজ স্যারকে দেখে জানতে ইচ্ছা করছে আপনার বোন কেমন আছে? আবার রাগ ও হচ্ছে,যেই স্যারের প্রতু ছিল প্রচন্ড ভালোবাসা,সেই স্যারের প্রতি অশ্রদ্ধা জন্মাক এটা আমিও চাই না,কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে দেখলাম, বয়সের ভারে নুইয়ে গেলেও শক্ত আছে,আমাকে দেখেই বললেন বসুন না এই বেঞ্চে,অসুবিধা নেই, আমি বললাম, স্যার আপনি ভালো আছেন?আমাকে চিনতে পারছে না,কে আপনি? স্যার ধানমণ্ডির মিনু,স্যার আপনি আমাদের বাংলা সাহিত্যের ক্লাশ নিতেন। ওহ আচ্ছা, আমার কিচ্ছু মনে থাকে না, তো তুমি কোথায় থাকো? তোমার স্বামী, ছেলে মেয়ে? স্যার আমি একাই আছি এই বাংলোতে, আমি রিটায়ার করেছি,আপনার বিভাগেই ছিলাম, আচ্ছা, দেখ তাহলে আমার বয়স কত? ছাত্রী অবসরে গেছে, টিচার এখন ও বেঁচে আছে।
হঠাৎ মুখে এলো স্যার শুভর খবর কি? ও কি করছে? হঠাৎ স্যারের মুখ শুকনো হয়ে গেল।আমার বোনের বিয়ের পর স্বামী মারা গেল,বিধবা হল, তার পরেই আমি ক্লাসের মেধাবী ছেলে,
আর্থিক ভাবে অসচ্ছল শুভকে বলি,ভাল সুযোগ পাবে পড়ার জন্য বিদেশেও যেতে পারবে,তুমি রাজী থাকলে বল,তখন উপরে উঠার বাসনা চোখে চকচক করে জ্বলতে থাকল। হয়ে গেল বিয়ে। মাষ্টারস শেষ করে জার্মানি গেল,এখানে পি এইচ ডি করবে। আজ ও গেল, কাল ও গেল।আর এলো না,শুনেছি,জেনিফার নামে এক মেয়েকে বিয়ে করেছে।
স্যার আপনারা কোথায় থাকেন? সাথের ছেলেছি বলল পাহাড়ের নিচেই আমি মামা আর আম্মু থাকি,তার মানে এটা শুভর ছেলে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here