নিশিকন্যা
লাকী ফ্লোরেন্স কোড়াইয়া
আজ আমার মন খুব ভাল।আজ আমার জ্বরের সাতদিন পূর্ণ হল।প্রচন্ড মাথা ব্যথা নিয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম। আমাদের বাড়িটা দো’তালা।সামনেই মিলাদের বাড়ি।ওদের এক তালার বাড়ির ছাঁদে দারুন ফুল ফুটেছে।হলুদ,বেগুনী, সাদা,লাল ফুল গুলোর দিকে তাকিয়ে মনটা ভালো হয়ে গেল।মাথার রগগুলো ব্যথা য় টনটন করছে।কিন্তু ফুল গুলোর সাথে খুব কথা বলতো ইচ্ছা হল।আমি ওদের বললাম,তোমরা কি জানো আমার ভীষণ জ্বর হয়েছে?ফুলগুলো ডানে-বামে মাথা নাড়িয়ে ‘না’ সূচক ইংগিত করল।সাথে সাথে ওদের শরীর থেকে কয়েকফোঁটা পানি ঝরে পড়ল।ওমা,তোমরা কাঁদছো?জানতে চাইলাম দরদভরা কন্ঠে।সব চেয়ে বড় হলদে যে ফুলগুলো,অলকানন্দা ওদের নাম।অলকানন্দারা বলল,না গো বেডি,কাঁদছি না। একটু আগে বৃষ্টি হয়েছে।জানো না বুঝি?আমি স্বাভাবিক ভঙিতেই বললাম,ও তাই বুঝি?ঘুমিয়ে ছিলাম কি-না,বুঝতে পারিনি গো।ঠিক এ সময় মা এসে দাঁড়ালেন।একা একা কি করছিস?কার সাথে কথা বলছিস?কেউ তো নেই এখানে?জিজ্ঞেস করল।একা কোথায়?ফুল গুলোকে দেখতে পাচ্ছো না?মানুষ কখরো একা থাকে না,শুধু নিজেকে একা ভাবে।এটা ভুল।আবার সবার সাথে থেকে ও নিজেকে পরিপূর্ণ ভাবে-এটা ও ভুল।ফুল গুলোর দিকে তাকিয়েই জবাব দিলাম।মা কি বলবে যেন ভাষা হারিয়ে ফেললেন।স্পাইডার ম্যানের মত এক লাফে আমার সামনে এসে দাঁড়ালো।মাথায় হাত দিয়েই চিৎকার করে বললেন,ও আল্লা,একি?জ্বর তো একশ দশ মনে হচ্ছে!আসলে কারো কখনো একশ দশ জ্বর হয়েছে কিনা মা জানে না।তাছাড়া মায়ের স্বভাবটা এমনই।সকালে স্কুলে যেতে দেরী হবে বলে ঘুম থেকে বলতেন,কিরে সাত টা বেজে গেছে, ওঠবি? নাকি ঘুমাবি?আজ আর স্কুলে যাওয়া হল না বুঝি।এই যে আগামীকালের বিশ টাকা জরিমানা রেখে গেলাম।আগামীকালের টিফিন বন্ধ।একবার তো বাবার স্টোক হবার উপক্রম করেছিলেন মা।আমাদের সাথে সময় বাড়িয়ে বলতে বলতে এমন অভ্যাস হয়েছিল যে মা মনে করতেন এটাই স্বাভাবিক।বরং সঠিক সময়ে সঠিক সময়টা না বলাই অস্বাভাবিক। সে-বার বাবা অফিসের কাজে খুলনা যাবে বলে মাকে বলেছিলেন পরদিন খুব ভোরে ডেকে দিতে।সকাল ৬টার সময় ফ্লাইট।রাতে হঠাৎ মা বাবাকে ডেকে বললেন,কিগো, ফ্লাইট কি মিস করবে নাকি?ছয়টা মনে হয় এখানেই বাজে!বাবা লাফ দিয়ে উঠে বসতে গিয়ে কোমরে চোট খেলেন।বুকের মধ্যে ও ধরফর করছিল।পাঁচ মিনিট চোখ বন্ধ করেছিলেন।মা ভয় পেয়ে পাশের রুম থেকে আমাদের ডেকে আনলেন।আমরা তিন ভাই বোন বাবার খাটের উপর গোল করে বসেছিলাম।কিছুক্ষণ পর চোখ খুলে মোবাইল চেপে দেখলেন,রাত ৩:১৫ মিনিট।আমাদের অসহায়ের মত তাকিয়ে থাকতে দেখে বাবা মাকে কিছু বললেন ন।বাবা কিছুটা স্বাভাবিক হতেই আমি আর নক্ষত্র নিজেদের রুমে চলে গেলাম।কিন্তু ছোট ভাই নীরব রয়ে গেল বাবা মায়ের রুমে।নক্ষত্র আর নীরব তখন একই রুমে এক সাথেই ঘুমাতো।আমার যখন জ্ঞান ফিরল তখন নিজেকে আবিষ্কার করলাম আমার চিরচেনা বিছানায়।কি হয়েছিল মনে নাই।তবে সম্ভবত মায়ের চিৎকারেই জ্ঞান হারিয়ে ছিলাম।
ধীরে ধীরে চোখ খুললাম।মা যেন বিজ্ঞ ডাক্তারের মত তাকিয়ে আছেন।বললেন দশ মিটিন পার হল।মায়ের দিকে চোখ পড়তেই একটু হাসলাম। বললাম,মা আজ আমার জ্বরের সাতদিন পূর্ণ হল।একটা কেক আনবে?জ্বরের এক সপ্তাহ পূর্তি পালণ করব।মা খুব স্বাভাবিক ভাবেই বললেন,বাইরে প্রচন্ড বৃষ্টি হচ্ছে।এখন কেক আনা যাবে না।আমি পুডিং বানিয়ে দিচ্ছি।ওটা দিয়েই কাজ চালিয়ে নিস।মা ফিরে যাচ্ছিল,কি মনে করে পিছনে ঘুরে বললেন,নিতুল,একটু এদিকে তাকাতো?কাকে নিতুল বলছ মা?নিতুল কে?জিজ্ঞেস করলাম।মা এবার একলাফে কাছে চলে এলেন।মাথার আলতো করে হাত রেখে ভীত কণ্ঠে বললেন,ওমা,কি কস এসব?এখানে আমি আর তুই ছাড়া আর কে আছে?কিন্তু আমার নাম তো “নিশিকন্যা”।তুমি নিতুল বলে ডাকলো কেন?আমি হাসিমুখে বললাম।মুখ বন্ধ কর মা,ঘুম দে।জ্বরে তোর মাথা ঠিক নাই।ঘুম দে তুই।আমি পুডিং করে আনছি।বুঝেছি মা ভয় পেয়েছে।সন্তানের অসুস্থতায় যুক্তিবাদী কঠোর মায়েরা ও দুর্বল হয়ে যায়।ভয় পায়।আমার মা সেই সব মায়েদের প্রতিচ্ছবি যেন!তবে আমি তো নিশিকন্যা-ই।মা কেন যে একথা ভুলে যায় বুঝি না।মাকে বললাম,মা “মেঘ বলছে যাবো যাবো”বইটা দিয়ে যাও।মা সেলফ্ থেকে বইটা এনে আমার হাতে দিয়ে বললেন,এই নে,তবে পড়িস না।তাহলে ঘুম হবে না।মা চলে গেলেন।বইটা খুলে চোখের সামনে মেলে ধরলাম।কী আশ্চর্য! বইয়ের পাতা থেকে শব্দগুলো সব উড়ে জানালা দিয়ে চলে যেতে লাগল।আরো অবাক হয়ে দেখলাম প্রত্যেকটা শব্দ একেকটা জোনাকিপোকা হয়ে উড়ে যাচ্ছে মিলাদের লেবু বাগানের দিকে।মুহূর্তে আমার ঘর জুড়ে অন্ধকার নেমে এল আর জোনাকিরা দলবেঁধে মনের আনন্দে অন্ধকার জুড়ে খেলা করতে লাগল।
সেই কবে একবার এসেছিলাম এই জায়গাটাতে-মনে করতে পারলাম না।অপূর্ব সুন্দর মায়াবী জায়গা।বাহারি ফুলগুলো যেন “স্বাগতম “বলে মাথা দোলাচ্ছে।আকাশে বিরাট রুপালি চাঁদ উঠেছে।যেন ঘন নীল শাড়ি পরিহিতা অপ্সরী কপালে রুপালি টিপ পড়ে সাদর সম্ভাবন জানাচ্ছে পৃথিবীর সব সৌন্দর্য পূজারিদের।আমি এগিয়ে যাচ্ছি বিরাট তরুবিথীর মধ্য দিয়ে।কী এক অদ্ভুত আকর্ষণ আমায় টেনে নিয়ে যাচ্ছে কোন অদৃশ্য অচিনপুরে! ডানদিকে চোখ পড়তেই মনটা রোমাঞ্চিত হল হলদেটে বাঁশঝাড় দেখে।চাঁদের আলোয় বাঁশঝাড় কেমন যেন সজীব হয়ে উঠেছে।আজকাল স্মৃতিশক্তি ও বড্ড বেশি খেয়ালিপনা করে।চাঁদের উজ্জ্বল আলোতে চোখে পড়ল সান বাঁধানো পুকুরঘাট।লক্ষ্য লক্ষ্য জোনাকিরা উড়ে বেড়াচ্ছে পুকুর জুড়ে।আমি চিনে ফেললাম জোনাকিদের।আমার বই থেকে উড়ে আসা শব্দমালা গুলো জোনাকি হয়ে উড়ছে।আমি মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে এগিয়ে যেতে লাগলাম পুকুরপাড়ের দিকে।
পুকুরের কাছাকাছি আসতেই চোখ বিস্ফারিত হল।সান বাঁধানো ঘাট আলোকিত করে সাদা পাঞ্জাবি পড়া একজনকে বসে থাকতে দেখলাম। এই নির্জন রাতে এই একাকী বসে থাকা কে ইনি?কৌতুহলী মন টেনে নিয়ে গেল তাঁর দিকে।কয়েক পা এগুতেই তাঁর শান্ত কন্ঠ কানে এল।এসো নিশিকন্যা,তোমার জন্যই অপেক্ষা আমার।আমার জন্য?তুমি কিভাবে জানো আমি তোমাকে খুঁজে বেড়াই?প্রশ্ন করলাম তাঁকে।কেন জানবো না?তোমার ভা্বনায়, সমস্ত সত্তায় মিশে আছি আমি।এসো,নিশিকন্যা,আমার মুখোমুখি বসো। আমি এগিয়ে গেলাম, মুখোমুখি হলাম তাঁর।অসাধারণ দৃষ্টি বসিয়ে দিল তাঁর সামনে।চোখ যেন তাঁর ভাষার সমুদ্র।আমি ডুবে যাচ্ছি।তাঁর অপলক দৃষ্টি আমাকে টানছে!তুমি কি আমায় টেনে এনেছো?জিজ্ঞেস করলাম। তোমার আবেগ তোমায় টেনে এনেছে এখানে!ভালবাসা কি আবেগ?প্রশ্ন করলাম!তিনি পুকুরের দিকে তাকালেন।আবেগের মধ্যে ভালবাসার বাস করে।ভালবাসা হল ভাল লাগার অনুভূতি,যা কখনো কখরো মানুষকে নিয়ন্ত্রণহীন করে তোলে।কখনো মানুষকে শান্ত করে দেয়,আবার কখনো অশান্ত করে দেয়।কখনো যুক্তিবাদীকে যুক্তিহীন, আর যুক্তিহীনকে যুক্তিবাদী করে তোলে।বড়ই বিচিত্র এই ভালবাসা!আমি অবাক হয়ে শুনছি তাঁর কথা।মনে হচ্ছে পুকুরের সমস্ত জল যেন ধোঁয়ার কুণ্ডলী পাকিয়ে উপরে উঠে যাচ্ছে।তিনি কথা বলছেন।প্রকৃতি জুড়ে ভয়ংকর নীরবতা নেমে এল।তিনি বলে যাচ্ছেন,তুমি প্রকৃতি ভারবাসো,চাঁদনী রাত ভালবাসো,ফুল,জোনাকি,লেবুর বাগিচা,গন্ধ ভালবাসো।ঐ তারা ভর্তি আকাশ তোমাকে হাতছানি দিয়ে ডাকে।তোমাকে কাছে টানে।
তুমি”নিশিকন্যা”।তুমি তরুণদের শিখাবে প্রকৃতিপ্রেম,বদলে দিবে তাদের ভাবনা।তাদের মনে জাগাবে নতুন ভাবনা। তারা ভালবাসবে জগৎকে।ভালবাসবে নিজেকে।তারা সৃষ্টিশীল হবে।তারা শব্দ নিয়ে খেলবে।তোমার লেখায় ঝরে পড়বে প্রকৃতিপ্রেম আর অদ্ভুত সব ভাবনা,যা পরবর্তী প্রজন্মকে ভাবতে শিখাবে।শীতল অনুভূতিতি শিহরিত হলাম।চাঁদের আলো তাঁর মুখের উপর। সামনে বসা এই মানুষটাকে যেন নতুন করে দেখছি।চোখ বন্ধ করলেই যার মুখখানা ভেসে উঠে, কলম ধরলেই যার লেখনী আমায় টেনে নেয়,সেই তিনি আমার সামনে!
ধীরে ধীরে চাঁদ ঢেকে যেতে লাগল।ধোঁয়ার কুন্ডলী পাকানো জলেরা ফিরে আসতে লাগল।পুকুরের এককোণে কদম গাছটা যেন চাঁদের আলোতে উদ্ভাসিত হল। হলুদের মধ্যে কদমের সাদা দাঁতগুলো চিকচিক করছে।তিনি তাকালেন সেদিকে।মৃদু হাসির রেখা ফুটে উঠল তাঁর ঠোঁটের কোণে।কদম আর কেয়ার গন্ধে ভাসছে চারপাশ।রিমঝিম শব্দ ভেসে এল কানে।ঠান্ডা অনুভব করলাম।ইজি চেয়ারের হাতলের উপরে রাখা নরম চাদর খানা তুলে নিয়ে চাপিয়ে দিলেন আমার গায়ে।সে এক অদ্ভুত অনুভূতি!তিনি তাকালেন আমার মুখপানে।বললেন,আমার ভাবনাগুলো তোমার মধ্যে জেগে থাকুক।নিভতে দিও না।আবেগের উষ্ণ স্রোতের ধারা বয়ে যাচ্ছে আমার গাল বেয়ে।চাঁদ ঢেকে গেল পূর্ণ কালো ছায়াতে।তাঁকে আর দেখতে পেলাম না। কিন্তু তাঁর উষ্ণতা আমাকে ঘিরে রেখেছে।দুর হতে কেউ বারো ব্যাটারির টর্চ লাইট নিয়ে এগিয়ে আসছে এমন মনে হল।সেই আলোতে ভেসে উঠল তাঁর মুখখানা।তাকিয়ে আছেন ভাবুক দৃষ্টিতে।জানিতে চাইলাম, কি দেখছ?তোমাকে দেখছি আমার নিশিকন্যা,আবেগ জড়ানো কন্ঠে এমন উত্তর আশা করছিলাম,কিন্তু তার আগেই মৃদু একটা ঝাঁকুনি খেলাম।চোখ মেলে তাকালাম।দেতে পেলাম আমার মা পুডিং হাতে দাঁড়িয়ে আছেন।পাশে নক্ষত্র, নীরব আর মিলা ও আমাদের বন্ধু ডাক্তার কাকাই।আমি উঠে বসলাম।মা অবস্ক হয়ে কপালে হাত রাখলেন।সাথে সাথে মায়ের স্বভাব সুলভ চিৎকার, ও আল্লা,জ্বর তো একদমই নাই।দ!জ্বর ছিল কিনা সেটাও মনে করতে পারলাম না।ডাক্তার কাকাই পকেট থেকে রুমাল বের করে হাত মুছলেন।পাশেই রাখা একটি জল ভর্তি বাটি আর ভেজানো রুমাল।বুঝতে পারলাম ডাক্তার কাকাই এতক্ষণ আমার মাথায় জলপট্টি দিয়েছেন।আমাকে তাকাতে দেখে ডাক্তার কাকাই হাসিমুখে বললেন,বাস্তব জগতে তোমাকে স্বাগতম, নিতুল।টেবিলের উপর রাখা প্রিয় কদমফুলের উপর চোখ পড়ল।মিলা এনেছে আমার জন্য।মিলা পাশে বসে বলল,তোর ঔষধ নিয়ে এলাম।মায়ের হাত থেকে পুড এল থালাটা নিয়ে আমার সামনে ধরে নক্ষত্র বলল,এই নে তোর পুডিং। এবার কোর জ্বরের এক সপ্তাহ পূর্তি পালণ কর।আমি জানি,আজ ১৩ ই নভেম্বর। আজ একজনের জন্মদিন। মনে পড়ল স্বপ্নের কথা।কানে ভেসে এল সেই কন্ঠ,ভালবাসা হল ভাললাগার অনুভূতি, যা কখনো কখনো নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পরে।
বড়ই বিচিত্র এ ভালবাসা!