অবচেতন ভালোবাসায় হরিণ বাস
আয়েশা মুন্নি
আমার বড় বোনের যখন বিয়ে হয় তখনো আমার স্কুলে যাওয়া শুরু হয়নি। বোনের শ্বশুরবাড়িতে সেসময়েও খুব সামান্য জমিদারী আবহ বিরাজমান ছিল। যদিও আমার প্রপিতামহ তাঁর সময়কাল পর্যন্ত জমিদার রেশ ধরে রেখে ছিলেন। আমার তা চোখে দেখা হয়নি।
সেবার প্রথম আমার শিশুচোখে হরিণের বশ্যতা দেখা। তালই মশাইয়ের বড় ভাই’র ছিল হরিণ পালনের শখ। আমার যতটুকু স্মৃতিতে আছে তখনো উনার তিনটে পালিত হরিণ ছিল। ভদ্রলোকের শোবার ঘর ছিল বিশাল আকৃতির। যেমনটা টেলিভিশনে দেখা যায় তেমন একটা বাদশাহী আমলের ইজি চেয়ার আর নিখুঁত কারুকাজ করা বিরাট একটা পালঙ্ক। দেখতে অনেটা পালকির মত। তাঁর শোবার ঘরের দেয়াল জুড়ে বেশ ক’খানা হরিণের চামড়া সাঁটানো ছিল। আর দেয়ালে ছিল একটা বন্দুক।
আমি খুব মন ভুলো মানুষ। তবে কি অবচেতনে আমার মনের মনিকোঠায় যত্নে ধারণ করা ছিল, ‘হরিণ’! আমার স্মৃতিতে কেন তবে হঠাৎ হরিণের মতো সেই বৃদ্ধ জ্বলজ্বল করে উঠলো!
ভদ্রলোক খড়ম পায়ে হাঁটতেন খুব অনায়াসে। খড়মের সম্মুখভাগে একটি বর্তুলাকার কাঠের গুটি থাকে। পায়ের বৃদ্ধা ও তর্জনী আঙ্গুলের ফাঁকে গুটি আঁকড়ে ধরে আমি একবার হাঁটার চেষ্টা করেছিলাম। খটখট শব্দ হয়! কাঠের ঠিক সেই রকম এক জোড়া খড়ম কিছু দিন আগে কুমিল্লার ময়নামতি মিউজিয়ামে দেখে এসেছি।
ক্রমেই হরিণের সংখ্যা কমে এক হলো। ভদ্রলোকের পালিত হরিণটি ছিল ভীষণ প্রভু ভক্ত। খুব বুদ্ধিমান ও বটে। হরিণের থাকার জন্য কোন খাঁচা ছিলনা। উনার আশপাশে সারা সময় ঘুরঘুর করতো। বয়স্ক মানুষ প্রায় অসুস্থ হতেন, তখন হরিণ মনের কষ্টে বাড়ি ছেড়ে হারিয়ে যেত। খুব খোঁজ চলতো কিন্তু পাওয়া যেতনা। তবে উনি সুস্থ হলে হরিণ টি ঠিক ফিরে আসতো। আবার আগের মত খাওয়া, ঘুম, পাশে থাকা। বৃদ্ধের মৃত্যুর পর হরিণটা আর ফিরেনি!!
২
আশির দশক পর নব্বই দশক…
অনেক বছর পর সেবার হরিণের চামড়া দিয়ে বানানো পার্স ব্যাগ দেখলাম। সেখানটায় সবেমাত্র একখানা ব্যাগ ছিল সংখ্যায়। আমি তখন সদ্য বিবাহিতা। সে সময়েও ডিমের হালি চার টাকা, ডিম প্রতি এক টাকা দর। হরিণের চামড়ার পার্স ব্যাগটার মূল্য- একুশ শত টাকা।
চিরকালের স্বভাবসিদ্ধ লেবাস খুলে স্বামীর কাছে বায়না ধরলাম এই ব্যাগখানা আমার চাইই। কিন্তু প্রথম দিন ফিরে আসি, অতগুলো টাকা ভেবে! রাতে ঘুম হয় না আমার। অন্য কেউ যদি কিনে নিয়ে যায়। দু’দিন নিজের সাথে যুদ্ধ করে আবার যাই, হরিণের চামড়ার ব্যাগের খোঁজে। না, আছে বৈকি তখনো। সে সময়ে তত বেশি শৌখিন বিলাসিতা খুব কারো ছিল না।
আহ্, আমার শখের হরিণের চামড়ার পার্স ব্যাগ আমার দখলে।
তবে কি আমার মনের খুব গহীনে লুকিয়ে ছিল আমার শৈশব? অনুভূতিতে জড়িয়ে ছিল হরিণের শরিরে হাত বুলানো মায়ার পরশ! তবে কি আমিও হরিণ ভালোবেসে ছিলাম! ভালোবাসাও কি তবে হরিণের মতো ধাবমান!
৩
বিংশ এরপর একবিংশ…
এই তো সেদিন বেড়াতে যাব। চিরায়ত স্বরূপ আমার পোশাকের সাথে মিলে রেখে নিজেকে বিন্যস্ত করা। আধুনিক যুগ, ড্রেসের সাথে পার্স ব্যাগে রঙের মিল খুঁজতে গিয়ে তুলে নিলাম একুশ বছর পেছনে ফেলা আসা হরিণের চামড়ার সেই পার্স ব্যাগ।
কিন্তু কি আশ্চর্য! সৌখিন আমি তো, কখনো একই পন্য দীর্ঘ দিন ব্যবহার করি না। কত একুশ শত ব্যাগ চলে গেছে কালের স্রোতে। অথচ এই হরিণের চামড়ার ব্যাগ টি এত বছর পরও ঠিক ঠিক আমার রয়ে গেছে! হিসেবে কম রেখে একুশ বছর ধরে গুণে নিলেও সাত হাজার ছয় শত পঁয়ষট্টি দিন!
এতো দীর্ঘ! এতো দীর্ঘ, সময় ব্যাগটি কালের স্রোতে তবে হারায়নি কেন!
তবে কি সময় হরিণের মতো ধাবমান!
কিন্তু এখন এই একবিংশ শতাব্দীতে হরিণের জন্য ভালোবাসা হোক ধরা ছোঁয়ার বাইরে, আত্মার অন্তরীক্ষে।
সংবিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ: বন্য প্রাণী আইনের সংজ্ঞায় পশুর চামড়া বা শরীরের যে কোন অংশকে ‘ট্রফি’ বলা হয়।
বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইন ও নিরাপত্তা ২০১২ অনুযায়ী হরিণ পালন ও রক্ষার ক্ষেত্রে জেল-জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে।